রেনেসাঁর কবি ইকবাল-১১

রেনেসাঁর কবি ইকবাল-১১


পাঠক! আগেও বলেছি যে মানুষ,বুদ্ধি-বিবেক এবং প্রেম-এগুলো বিশ্বের বিখ্যাত কবি এবং লেখকদের অনিবার্য বিষয়। প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষই মানুষের পরিচয়,মানুষের মন-মানসিকতা,তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং প্রজ্ঞা ও প্রেম সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। খুব কম কবি বা লেখককেই পাওয়া যাবে যিনি এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন নি বা কথা বলেন নি। মুসলমানদের কাছে মানুষের মর্যাদা অনেক উন্নত পর্যায়ের। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং মানুষকে তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব বলে উল্লেখ করেছেন। কেবল সৃষ্টির সেরাই নয় বরং পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে মর্যাদার শীর্ষে আসীন করেছেন। তাই বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক বা দার্শনিকমাত্রই মানুষ সম্পর্কে বিশেষ করে পরিপূর্ণ মানুষ অর্থাৎ ইনসানে কামেল সম্পর্কে কথা বলেছেন।
ইকবালের কবিতায় বিষয়গত বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তবে সেসব বিষয় মানব জীবনকেই সার্থকতা দিয়েছে। পূর্ববর্তী সকল বিখ্যাত কবিই মানব জীবনকে নশ্বর বলে মেনে নিয়েছেন এবং দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়া স্বল্পায়ু জীবনের কথা বলেছেন। সেইসাথে জীবন বা আয়ুষ্কালের ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় কিছু নেই বলে নিজস্ব অসহায়তার কথা প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে সবাই নিঃসন্দেহ যে মানুষ মরণশীল এবং সবাইকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই বলে মৃত্যুর কথা ভেবে ভেবে নিজের সকল কাজকর্ম বা চেষ্টা-প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়ে দুশ্চিন্তার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে পড়াটা কি ঠিক? ইকবালের কবিতার সমালোচকগণ বা বিশ্লেষকগণ মনে করেন যে মানুষ এবং সমাজ হলো কবি ইকবালের কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়।
ইকবাল হলো মানুষের কবি, জীবনের কবি। তিনি ছিলেন স্বল্পায়ু। জীবনাভিজ্ঞতার শীর্ষে উপনীত না হয়েও তিনি জীবন নিয়ে কথা বলেছেন। সমাজের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক তা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। মানুষ তার সমতা এবং সৃজনশীলতা দিয়ে উন্নত বিশ্ব গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করুক ইকবাল তা চাইতেন। ইকবালের দৃষ্টিতে মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই এই বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ছিল। ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্জাগরণ নামক গ্রন্থে তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন।
ইকবালের দৃষ্টিতে নবীজীর যে মেরাজ তা কেবল মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা) এর ই মেরাজ ছিল না,বরং এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে মানুষের পে আকাশের পর আকাশ পাড়ি দেওয়া সম্ভব এবং মহাশূন্য পাড়ি দেওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব। তারার মাঝে মানুষ যেন ভাগ্য খুঁজে না বেড়ায় সে কথা ইকবাল বলেছেন,তাঁর মতে তারাদের এমন কোনো শক্তি নেই যে মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে খবর দেয়,বরং সে নিজেই মহাশূন্যে ভাসমান। ইকবালের মতে মানুষ তার কর্মকাণ্ড দিয়ে বিশ্বে তার ভাগ্য নির্মাণে সৃষ্টিশীল ভূমিকা রাখবে-এটাই স্বাভাবিক। মানুষ হবে আত্মনির্ভরশীল। সে তার রুটি-রুযির জন্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাবে। কারণ মানুষের স্থান ফেরেশতাদের উর্ধ্বে।
মানুষ আল্লাহর সবচে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। তারা কোনো কারণ ছাড়া বা কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছাড়াই পৃথিবীতে এসেছে এমনটি গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষের জন্মের একটা কারণ অবশ্যই রয়েছে। মানুষকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। ইকবালের মতে মানুষের জীবন সুস্থির এবং প্রশান্ত হওয়া ঠিক নয়। মানব জীবন জুড়ে বিচিত্র চড়াই-উৎরাই থাকবে যাতে সেসব অতিক্রম করে যাবার জন্যে মানুষ তার মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে। জীবন হলো দ্বন্দ্বময় একটি ময়দান। চুপ করে থাকা বা আত্মসমর্পন করার নাম জীবন নয়। প্রকৃত জীবন হলো নিরন্তর উড়াল এবং ভ্রমণের আস্বাদ। স্পন্দনহীনতা মৃত্যুরই প্রতিশব্দ। মানুষ হলো মেধার ভাণ্ডার। আল্লাহ তাকে এই যে মেধা দিয়েছেন তাকে কাজে লাগিয়ে আত্মোন্নয়ন ঘটানো মানুষের কর্তব্য।

تو شب آفريدي ، چراغ آفريدم
سفال آفريدي، اياغ آفريدم
بيابان و راغ آفريدي
خيابان و گلزار و باغ آفريدم
من آنم كه از سنگ آئينه سازم
من آنم كه از زهر نوشينه سازم

তুমি সৃষ্টি করেছো রাত্রি,আমি করেছি বাত্তি
তুমি মৃত্তিকা বানিয়েছো আর আমি পেয়ালা
তুমি সৃষ্টি করেছো মরু প্রান্তর আর সবুজ বনানী
আমি বানিয়েছি রাস্তা আর ফুলেল বাগ-বাগিচা
আমি তো সে যে পাথর থেকে বানিয়েছে কাঁচ
আমিই তো সে যে বিষ থেকে বানিয়েছে মধু

ইকবাল তাঁর কবিতার পরতে পরতে মানুষের বিচিত্র গুণ এবং মেধার পরিচয় দিয়েছেন। তবে সেসবই গণমানুষের সাধারণ গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আদর্শ মানুষ বা ইনসানে কামেল বলতে ইকবাল ভিন্ন আরেকটি পরিচয় তুলে ধরেছেন। তিনি একমাত্র রাসূলে আকরাম (সা) কেই ইনসানে কামেলের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতায় এ বিষয়টি সহজলভ্য।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন