রেনেসাঁর কবি ইকবাল -১০
রেনেসাঁর কবি ইকবাল -১০
পাঠক ! ইকবালের জীবনেতিহাসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন দিক নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে খানিকটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনাদের ভালো লেগে থাকবে। তাঁর শিক্ষা জীবন,ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের সাথে তাঁর যোগাযোগ এবং এ ভাষায় তাঁর লেখালেখি চর্চার ইতিবৃত্ত নিয়েও কথা বলেছি আমরা। বিশেষ করে ইরানী বিখ্যাত কবিদের প্রভাব তাঁর ওপর কীভাবে পড়েছে তা নিয়েও খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইকবালের কবি হয়ে ওঠার বিষয়টি নিয়ে খানিকটা কথা বলা দরকার বলে মনে করি। আজকের আসরে আমরা তাই এ বিষয়টি নিয়ে খানিকটা কথা বলার পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলবো।
কবি ইকবাল লাহোরী ছোটো বেলাতেই তাঁর জন্মস্থান শিয়ালকোটের পুরোণো মাদ্রাসায় নিয়ম অনুযায়ী ইসলামী জ্ঞান এবং ঐশীগ্রন্থ আল-কোরআনের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পান। তারপর তিনি স্কটল্যান্ডের খ্রিষ্টান মিশনারীদের প্রতিষ্ঠিত âস্কচ মিশন' নামক স্কুলে যান। স্কুলটি শিয়ালকোটেই অবস্থিত ছিল। সেখানে যাবার পর নতুন নতুন জ্ঞানের সাথে পরিচিত হন। কবি ইকবালের পিতা ছিলেন শেখ নূর মোহাম্মাদ। তিনি ছিলেন সেলাই কাজের পেশায় নিযুক্ত। তিনি সাহিত্য ভালোবাসতেন। আধাত্মিক সাহিত্য ও কবিতার সাথে তাঁর ভালো পরিচয় ছিল। বিশেষ করে শেখ আকবর,মহিউদ্দিন ইবনে আরবীর ওপর তাঁর ভীষণ অনুরাগ ছিল। তিনি তাঁর বাসাতেই ফুসুসুল হুক্ম এবং ফাতুহাতে মাক্কিয়ে নামক বিখ্যাত গ্রন্থগুলো পড়েছেন।
পিতার এই অনুরাগের সুবাদে পুত্র ইকবালও সেই ছোটবেলাতেই আধ্যাত্মিকতা নামক শব্দ বা এই পরিভাষাটির সাথে পরিচিত হন। শেখ নূর মোহাম্মাদ ছিলেন কাদেরিয়া সিলসিলার অনুসারী। সেজন্যে কবি ইকবালও কৈশোরে এই তরিকার অনুসারী হয়ে পড়েছিলেন। কবি হবার কারণে ইকবাল সেই কৈশোরেই বিভিন্ন আসরে কবিতা পড়তেন,সাহিত্য সভায় যেতেন। সেই কৈশোরেই স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। লেখালেখিতে তাঁর শিক্ষক সাইয়্যেদ মীর হাসান ইকবালকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা দিতেন। উর্দু কবিতা ও সাহিত্যের শিক্ষক দাগ দেহলভিও এব্যাপারে ইকবালকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করতেন।
ইকবাল মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শেষ করার পর ১৮৯৫ সালে লাহোরে যান এবং সরকারী কলেজে পড়ালেখা শুরু করেন। এ সময় তিনি ফার্সি ভাষা,আরবি ভাষা,ইংরেজি সাহিত্য ও ইউরোপীয় নতুন সাহিত্য ধারার সাথে ভালোভাবে পরিচিত হন। সেইসাথে পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে তাঁর প্রাথমিক পরিচয় ঘটে এখানেই। দর্শন ছাড়াও তিনি ইতিহাস, অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিষয়েও পড়েন। এ সময় তিনি আব্দুল কারিম জিলীর দৃষ্টিতে âইনসানে কামেল' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর শিক্ষক প্রফেসর আর্নল্ডের অনুপ্রেরণায় ইকবাল অর্থনীতি বিষয়ক একটি ইংরেজি বই উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি নিজেও অর্থনীতি বিষয়ে একটি বই লেখেন।
বিশ শতকের শুরুর দিকে ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতা চিন্তা, মুক্তিকামিতাসহ চিন্তাজগতে ব্যাপক তোলপাড় ছিল। তাই তরুণ বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক কদর ছিল তখন। ইকবাল এ সময় লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য ও কবিতার আসর বা এ বিষয়ক সংস্থাগুলোতে কাটাতেন। তাঁর বয়স কিন্তু খুব বেশি ছিল না,তিরিশ ছুঁই ছুই। অথচ তখনি তাঁর কবিতা সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতে শুরু করে। তাঁর কবিতা এক হাত থেকে অপর হাতে ঘুরতে ঘুরতে তিনি ভারতের লখনৌ,দিল্লীসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। এই সময়ে তাঁর লেখায় আধ্যাত্মিকতার প্রাথমিক রং লেগেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক-ধর্মীয় ও সামাজিক পরিস্থিতির কারণে সমাজ সচেতন কবি ইকবালের কবিতা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ও সামজিক রূপ পরিগ্রহ করে।
কবি ইকবালের ব্যক্তিত্বে এ সময় যিনি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর নাম হলো মৌলভি নজির আহমদ দেহলভি। লাহোরে ইকবাল ১০ বছর কাটিয়েছেন। এই ১০ বছরে তিনি মৌলভি নজির আহমদের কাছে নিয়মিত যাওয়া আসা করতেন। আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলাম আয়োজিত বৈঠকে ইকবাল বক্তৃতা দিতেন। এই আঞ্জুমানের কাজের ব্যাপারে ইকবাল যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং সকল আসরেই কবিতা পাঠ করতেন। নজির আহমদ তখন থেকেই ইকবালের কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করতেন এবং ইকবালের কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত থাকতেন। খুদিচিন্তা,পাশ্চাত্য দর্শন কিংবা তাসাওউফের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ইকবাল যেসব সমালোচনা করতেন সেগুলো মূলত মৌলভি নজির আহমদের প্রভাবেই।
ইকবাল যখন মাওলানা জালালুদ্দিন বালখিয়ে রুমির কবিতার সাথে পরিচিত হন তখন থেকে আধ্যাত্মিকতার সাথে পুনরায় তাঁর নিবীড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইকবালের বাকি জীবনে এই সম্পর্কচ্ছেদ আর ঘটে নি। আরমুগানে হেজায, আসরারে খুদি,জাভিদনামা,বালে জিব্রাঈল প্রভৃতি গ্রন্থে রুমি যেন ইকবালের আধ্যাত্মিক মুরব্বি হিসেবে সবসময় তাঁর মন এবং মননে আসীন ছিলেন। ইউরোপ যাবার পর নীৎসে, শোপেনহাওয়ার,বার্গসঁ প্রমুখ দার্শনিকের সাথে পরিচিত হবার পর ইকবালের দর্শন চিন্তা বিশেষ করে তাসাওউফ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে খানিকটা পরিবর্তন আসে। প্লেটোর মতো দার্শনিকদের চিন্তারও সমালোচক হয়ে ওঠেন তিনি। গাযযালিকে তিনি তখন কান্ট থেকে আলাদা ভাবতেন না। চিন্তাজগতে এই পরিবর্তন সত্ত্বেও মাওলানা রুমির ব্যাপারে কিন্তু ইকবালের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনোরকম পরিবর্তন আসেনি।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন