রেনেসাঁর কবি ইকবাল -৭

রেনেসাঁর কবি ইকবাল -৭


পাঠক ! আল্লামা ইকবালের জীবন ও কর্ম ভিত্তিক ধারাবাহিক আলোচনার আজকের পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আশা করি আপনারা যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। গত আসরে আমরা বলেছিলাম ইকবাল তাঁর ইসলামী জ্ঞানের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে তাঁর কাক্সিক্ষত আদর্শ সমাজ গঠনের চেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁর এই আদর্শ সমাজ চিন্তার মূলে ইসলামের যেসব মৌলিক উপাদান কাজ করেছিল তা হলো তৌহিদ,নবুয়্যত,কোরআনের শিক্ষাসমূহ, মক্কা কেন্দ্রিকতা,খুদির উন্নয়ন এবং অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়-আশয়। আরো বলেছিলাম যে ইকবালের কবিমনে বিখ্যাত অনেক কবির মাননিক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে ইমাম আলী ( আ ) এর বাণী। এর প্রভাব এতো গভীরে যে সহজে তা অনুমেয় নয়। যাই হোক,এরি ধারাবাহিকতায় আজ আমরা কথা বলবো।
ইকবাল তাঁর কবিতায়,তাঁর প্রবন্ধে এবং তাঁর বক্তৃতায় সবসময় ইতিহাসের পাতার ভাঁজে ভাঁজে পড়ে থাকা ইসলামের মহান ব্যক্তিত্ব এবং মুসলিম বীরদেরকে মুসলমানদের চোখের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ইকবালের কলমে মহান এইসব মনীষীর মধ্যে সর্বপ্রথম যাঁর নামটি উঠে এসেছে তিনি হলেন হযরত মুহাম্মাদ ( সা )। এরপরের সারিতে রয়েছে রাসূলে খোদার আহলে বাইতের সদস্যদের স্বর্ণোজ্জ্বল নামগুলো,যার শীর্ষে রয়েছেন হযরত আলী ( আ )। ইকবাল তাঁদের স্মরণে অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং পরিপূর্ণ সততার সাথে কবিতা লিখে তাঁর কবিতাকে সুগন্ধিপূর্ণ করেছেন।ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের প্রফেসর ডক্টর রদফার বলেছেনঃ ‘আমরা যখন আলী ( আ ) কে নিয়ে লেখা ইকবালের কবিতা পড়বো, তখন আমাদের মনে হবে যে ইকবাল হলেন সত্যিকারের একজন আলী বিশেষজ্ঞ।'
ইকবাল আলী ( আ ) কে অনেক বড়ো মাপের একজন মানুষ বলে মনে করেন। ইকবালের দৃষ্টিতে মুমিন ব্যক্তি হলেন তিনি, যিনি কথা ও কাজে ভারসাম্যপূর্ণ এবং মিতাচারী। ইকবাল তাঁর ‘যারবে কালিম' নামক গ্রন্থে মুসলমান এবং মুমিন ব্যক্তির পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে লিখেছেনঃ যদি কারো মধ্যে শক্তিমত্তা, পবিত্রতা, মহানুভবতা এবং উদারতা-এই গুণগুলো একত্রে থাকে তাহলে সে স্পষ্টতই মুসলমান......মুমিন ব্যক্তি হলো সেইসব কুয়াশাবিন্দুর মতো যে টিউলিপের বেদনাহত অন্তরকে শীতল করে দেয়। আবার সেই তুফানের মতো যেই তুফান সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলে। তার দিন এবং রাত্রি হলো চিরন্তন আধ্যাত্মি সংগীতের মতো,যেই সংগীত কেবল স্রষ্টারই গুণ গায় এবং যেই সুরেলা সংগীতের মাধুর্য সূরা আর-রাহমানের মতো।'
ইকবাল এই যে মুসলমান এবং মুমিনের গুণাবলীগুলো উল্লেখ করলেন, এই বর্ণনা ইসলামের বিখ্যাত মনীষীদের বর্ণনার সাথে বিশেষ করে হযরত আলী ( আ ) এর বর্ণনার সাথে মিলে যায়। ইকবাল যারবে কালীমের অন্যত্র লিখেছেন,"মুমিন ব্যক্তি বন্ধুদের মাঝে সিল্কের মতো নরম ও ভদ্র স্বভাবের আর শত্র"দের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন।" ইকবালের দৃষ্টিতে পূর্ণ মুমিন ব্যক্তির মানদণ্ড হলেন হযরত আলী (আ)। তিনি একদিকে ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের প্রতীক,যাঁকে মোকাবেলা করার মতো সাহস কারো ছিল না। অপরদিকে অসহায় এতিমদের ব্যাপারে তিনি এতো বেশী কোমল প্রকৃতির ছিলেন যে তাঁর মতো সহায়তা দানকারী ইতিহাসে বিরল। এইসব গুণ লক্ষ্য করেই ইকবাল লিখেছিলেন :
দার বারোবারে সাখ্তি সাখ্ত আস্ত্
ভা দার বারোবারে র্নামি মোলায়েম.....
আব্রিশাম দার বায্মে ওন্স
ভা ফুলদ দার রায্ম্গহে হাক্ক্ ও বতেল......
অর্থাৎ হযরত আলী ( আ ) কঠোরতার বিরুদ্ধে কঠোর এবং নরমের বিপরীতে নরম কোমল। বন্ধুত্বের আতিথেয়তায় তিনি সিল্কের মতো কোমল,আবার সত্য মিথ্যার যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ইস্পাতের মতো কঠিন। হযরত আলী ( আ ) এর জ্ঞান সম্পর্কে নবী করীম ( সা ) একবার বলেছিলেন,আনা মাদিনাতুল এলম,ওয়া আলীয়্যূন বা..বুহা অর্থাৎ আমি হলাম জ্ঞানের নগরী আর আলী হলো সেই নগরীর দ্বার। এই হাদীসটির ভিত্তিতে ইকবাল একটি কবিতা লিখেছিলেন। তার দুটি পংক্তি এরকমঃ
জা'তে উ দারভযেয়্যে শাহরে উলুম
যীরে ফারমনাশ হেজাজ ও চীন ও রোম
আল্লামা ইকবাল ভালো করেই জানতেন যে ইমাম আলী ( আ ) সামাজিক, অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক এবং বিশ্বাসগত সকল ক্ষেত্র থেকেই জাহেলি যুগের কালিমাগুলো অপসারণ করতে চাইতেন এবং যার যার উপযুক্ত মর্যাদা দিতে চাইতেন। ইকবাল হযরত আলী ( আ ) এর মাঝে তিনি উচ্চতরো রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা, সামাজিক সচেতনতা, ইবাদাত বন্দেগী, সাংসারিক বিষয়-আশয়, সন্তান প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণ, বীরত্ব , তাকওয়া, ন্যায়নিষ্ঠা ইত্যাদি গুণাবলী। এইসব গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে ইকবাল সমকালীন মুসলিম জনগোষ্ঠীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন-তোমরা এরকম মহান ব্যক্তিত্ববর্গের গুণগুলোর মধ্য থেকে কতোটা অর্জন করেছো ?
কবি ইকবাল তাঁর ‘বঙ্গে দারা' গ্রন্থে বলেছেন,তোমার অস্তিত্বের ঐ মৃত্তিকায় যদি স্ফুলিঙ্গ থাকে তাহলে ধনী-গরীবের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিও না। কেননা যবের রুটি খেয়ে সাদাসিধে জীবনযাপন করেই হযরত আলী ( আ ) হায়দারী শক্তিমত্তা অর্জন করেছিলেন। ইকবাল আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং রাসূলে খোদার দরবারে মোনাজাত করেছেন মুসলমানদেরা যেন হযরত আলী ( আ ) এর চরিত্রের রঙ্গে রঙ্গীন হতে পারেন।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন