রেনেসাঁর কবি ইকবাল -৩
রেনেসাঁর কবি ইকবাল -৩
যাবুরই আজামÂ (পার্সিয়ান সাম্স) কবি ইকবাল লাহোরির অপর একটি কাব্য গ্রন্থ। যাবুর একটি ঐশী গ্রন্থের নাম। বনী ইসরাইলীদের নবী হযরত দাউদ ( আ ) এর ওপর এই আসমানী কিতাবটি নাযিল হয়েছিল। হযরত দাউদ (আ) খুব সুন্দর কণ্ঠে এই গ্রন্থটি পাঠ করতেন। ইকবাল তাঁর একটি ফার্সি কাব্য গ্রন্থের নাম রেখেছেন যাবুরই আজাম। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে প্রথমবারের মতো বইটি ছাপা হয়। এতে গযল, টুকরো কবিতা এবং দুই পংক্তি বিশিষ্ট কবিতা বা মাসনাবি রয়েছে। একটি হলো গুলশানে রযে জাদিদ বা নতুন রহস্যের পুষ্পোদ্যান এবং বান্দেগি নমেহ বা ইবাদাতনামা। ইকবাল শেখ মাহমুদ শাবেস্তারী এবং তার মূল্যবান সাহিত্যকর্ম গুলশানে রয এর সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। এটিকে তাঁরই নতুন রহস্যের পুষ্পোদ্যান বলে মনে করা যেতে পারে,কেননা ইকবাল শাবেস্তারির গুলশানে রযের স্টাইলেই গুলশানে রযে জাদিদ লিখেছেন। প্রশ্নোত্তরের রীতিতে এটি লেখা হয়েছে।
বান্দেগি নমেহ ইকবালের যাবুরে আজামের দ্বিতীয় অধ্যায়। বান্দেগি নমেহ'তে কবি ইকবাল প্রাঞ্জল ফার্সি ভাষায় লেখা কবিতায় সৃষ্টিশীলতা, শিল্প,মিউজিক,কবিতা,ভাস্কর্য এবং মজলুম জাতিগুলোর সাহিত্যের ব্যাখ্যা এবং সমালোচনা দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন। তবে বান্দেগি নমেহ্'তে ইকবালের সার্থকতা হলো তিনি কেবল দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে বা চিত্র এঁকেই ক্ষান্ত হন নি,বরং তিনি ঔপনিবেশিকতার জাল ছিন্ন করার উপায় বা পন্থাটাও পাঠক-শ্রোতাদের দেখিয়ে দিয়েছেন।
মাসনাবির পর আসরারে খুদি ওয়া রমুযে বি খুদি এবং জভিদ নমেহ হলো ইকবাল লাহোরির উল্লেখযোগ্য ফার্সি রচনা। ইকবাল তাঁর জভিদনামায় মৌলাভির মাসনাবির প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এ বইতে তিনি নিজেকে যেন্দে রুদ বা জীবন্ত নদী বলে অভিহিত করেছেন। জভিদ নমে হলো কাল্পনিক এক সফরের ব্যাখ্যা। এ গ্রন্থে তিনি তাঁর পীর-মুর্শিদ মৌলাভির সাথে সকল আসমান,বেহেশত এবং দোযখ সফর করেন এবং কালজয়ী কিছু ব্যক্তিত্বের সাথে কথাবার্তা বলেন। ইরানের বিখ্যাত অভিধান প্রণেতা মরহুম ডক্টর মোহাম্মাদ মঈন ইকবালের জভিদ নমেহ সম্পর্কে বলেছেনঃ ইকবাল এই সফরে সানাঈ গাযনাভি,আবুল আলা মোয়াররী, মহিউদ্দিন ইবনে আরবি এবং ইতালীর দান্তের মতো বিখ্যাত কবি ও দার্শনিকদের মতোই নিজস্ব সৃষ্টিশীল শক্তিমত্তা দিয়ে কাব্যিক মেরাজে গেছেন এবং নিজস্ব মেরাজনামা বা উর্ধ্বারোহনের কাহিনীকে জভিদনমে নাম দিয়েছেন। আধ্যাত্মিক এই সফরে ইকবালের পথপ্রদর্শক এবং মানসিক রাজপথে ছিলেন ইরানের বিখ্যাত মরমী কবি মাওলানা জালালুদ্দিন মোহাম্মাদ বালখিয়ে রুমি।
ইকবাল সমগ্র জীবনব্যাপী যেই লক্ষ্য এবং চিন্তাকে সামনে রেখে কাজ করেছেন তাহলো,জাতির শত্র"র বিরুদ্ধে সংগ্রাম। যেসব শত্র" ভারত ভূখণ্ডকে বিদেশীদের হাতে সোপর্দ করেছে এবং মুসলমানদের ওপর তাদের আনুগত্য চাপিয়ে দিয়েছে,সেইসব শত্র"র বিরুদ্ধেই ছিল ইকবালের সংগ্রাম। ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদের মুক্তির জন্যে একজন দূরদর্শী নেতার খোঁজে ছিলেন। এ বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে তাঁর মুসাফির এবং âতাহলে কী করা উচিত হে প্রাচ্যবাসী' তে। পশ্চিমা বিশ্বের ধর্মহীন বস্তুতান্ত্রিকতাও তাঁকে ভীষণ কষ্ট দিতো।
ইকবাল লাহোরীর প্রথম উর্দু কবিতার বই হলো বঙ্গ্-ই-দারা। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে এটি মুদ্রিত হয়। বঙ্গে দারা হলো ঘণ্টাধ্বনি। যেই ঘণ্টাধ্বনি উটের পায়ে বাঁধা হয় যাতে উটের পদক্ষেপ বোঝা যায়। এই শব্দ একদিকে উটের অস্তিত্বের ঘোষণা দেয় অপরদিকে জনগণকে জাগ্রত রাখে। ইকবাল এই গুণগুলোর কথা কবিতায় উল্লেখ করেছেন। বঙ্গে দারা ইকবালের কবিকর্মের প্রাথমিক দিককার রচনা। তরুণ বয়সে তিনি এসব কবিতা লিখেছিলেন এবং আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলামে পড়েছিলেন। এই বইতে জাতীয় চেতনাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
'বলে জিব্রাইল' বা জিব্রাঈলের ডানা গ্রন্থটিও উর্দুতে লেখা। এটি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। ১৯৩৫ সালে এই গ্রন্থটি ছাপা হয় লাহোরে। এই গ্রন্থটি দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে গযল এবং দু'লাইনের কবিতা। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে,বিচিত্র কাব্যকাহিনী। এইসব কাব্যকাহিনীর বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে সাসকিনামা এবং কর্ডোভা মসজিদসহ স্পেনে তিনি যেসব মুসলিম ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখেছেন সেগুলোর বর্ণনা। বলে জিব্রাঈল হলো উর্র্দু ভাষায় ইকবালের কবি মানস বিকাশের মাধ্যম। ইকবাল এই গ্রন্থে চমৎকার সব গযল লিখেছেন। সেইসাথে মুমিনের গুণাবলী এবং ইসলামের সঠিক পরিচিতি,ইনসানে কামেল এবং মুসলমানদেরকে ইসলামী বিধি-বিধান দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকার কথা প্রাঞ্জল ভঙ্গি ও ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
যারবে কালিম ( দ্য রড অব মোজেজ ) উর্দু ভাষায় লেখা তাঁর অপর একটি গ্রন্থ। ১৯৩৬ সালে লাহোরে বইটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি ইসলাম এবং মুসলমান, শিক্ষা-দীক্ষা, নারী, সুকুমার শিল্প ও সাহিত্য, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে। বইটির নামকরণ করেছেন কোরআনের একটি আয়াত অনুসরণে। আয়াতটি হলো âঅকুল্ নাদরেব্ বি আসাকাল হাজার।' এই নামটি নির্বাচন করার উদ্দেশ্য ছিলো,তিনি মনে করতেন তাঁর বক্তব্য মুসলমানদের অন্তরের পাথরের ওপর মূসার লাঠির মতোই কাজ করবে এবং ঐ পাথর থেকে পানি পানি ফুটবে। আরমুগানে হেজাজ তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ। এটি তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়। এখানেও তিনি ঔপনিবেশিকতা এবং মুসলমানদের মুক্তি নিয়েই ভেবেছেন। কবি বাবা তাহের হামেদানির ছন্দশৈলীকে এ গ্রন্থে কাজে লাগিয়েছেন। দুই পংক্তি বিশিষ্ট কবিতায় মক্কা এবং মদীনা যিয়ারতের ইচ্ছে প্রকাশিত হয়েছে। শয়তানের সংসদ নামের ব্যঙ্গ কবিতাংশ বর্তমান বিশ্বের রাজনীতিবিদদের সমালোচনায় মুখর।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন