রেনেসাঁর কবি ইকবাল-১

রেনেসাঁর কবি ইকবাল-১


পাঠক ! আপনারা পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি ইকবাল লাহোরীর নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। আল্লামা ইকবাল উর্দু,ফার্সি বিচিত্র ভাষায় কবিতা লিখেছেন। তো এ আসরে আমরা কবি ইকবাল,তাঁর কবিতা বা লেখালেখি এবং তাঁর দর্শনের সাথে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। সেইসাথে ইকবাল এবং ইরানের ইসলামী দর্শন,ইকবাল এবং মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রভৃতি বিষয়েও কথা বলার চেষ্টা করবো। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
এখনো ঘাসের পরে দেখি না বন্ধু কোনো
আমিই বসন্তের প্রথম পুষ্প যেন
পানপাত্রে তাকালে দেখি শুধু নিজেকেই
এ ভাবনায় যদি অন্য কাউকে পেয়ে যাই
জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে যে তুলি নির্দ্ধিধায়
লিখেছে সে এক বার্তা এ জীবনের রঙীন পাতায়
কবি ইকবাল লাহোরী ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ই নভেম্বরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন। ইরানের বিখ্যাত গবেষক প্রফেসর ফারিদানীর মতে বহু যুগ পরে ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদেরকে অলস-নিদ্রা থেকে জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। ইকবালের বাবা নূর মোহাম্মাদ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি জ্ঞানী-গুণীদের আসরে বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে ভালোবাসতেন। তাঁর কর্মক্ষেত্র একটা শিক্ষাকেন্দ্রে পরিনত হয়েছিল। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি যাদের অনুরাগ ছিল তাদের অনেকেই সেখানে সমবেত হতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করতেন। তিনি পবিত্র চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং কোরআন তেলাওয়াতকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের উপায় বলে মনে করতেন। তিনি তাঁর ছেলে ইকবালকে উপদেশ দিয়ে বলতেন যে, কোরআন এমনভাবে পড়ো যেন আল্লাহর সাথে কথা বলছো।
ইকবালের মাও ছিলেন একজন পুণ্যবতী এবং দ্বীনদার রমনী। এ ধরনের একটি পরিবারে কবি ইকবাল লালিত পালিত হন,বেড়ে ওঠেন। ফলে তাকওয়ার শিক্ষা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের শিক্ষা তিনি নিজ পরিবারেই লাভ করেন। একেবারে ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর পারিবারিক পরিবেশে ইরানী বিখ্যাত মরমী কবি সানাঈ, আত্তার, ইরাকী, জামি, হাফেজ, মৌলাভি এবং সাদি'র কবিতার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পান। শৈশবকালীন বা প্রাথমিক শিক্ষা তিনি তাঁর জন্মস্থান পাঞ্জাবের শিয়ালকোটেই অর্জন করেন। সেখানেই তিনি কোরআন শেখেন,পড়তেও শেখেন,লিখতেও শেখেন। পড়ালেখার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের প্রথম পর্ব শেষ করেই তিনি শিয়ালকোটের স্কট্স মিশন কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে তিনি প্রচলিত জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি,ফার্সি এবং আরবি ভাষাও শেখেন।
শামসুল উলামা নামে খ্যাত মৌলভি সাইয়্যেদ হাসানের কাছে তিনি ফার্সি এবং আরবি ভাষা ছাড়াও উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করেন। শামসুল উলামা ছিলেন তাঁর বাবার বন্ধু। তাঁর সাহচর্যে ইকবাল কবিতা সম্পর্কে এতোই ভালো ধারণা অর্জন করেন যে মাত্র ১৯/২০ বছর বয়সেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর সেই যুবক বয়সের কবিতাও অগ্রজ উর্দু কবি সাহিত্যিকদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। তাঁরা ইকবালের কবিতার প্রশংসা করেন।
ইকবালের চিন্তা-চেতনা ছিল ব্যবসায়িক চিন্তার অনেক উর্ধ্বে। তাই তিনি বাবার ব্যবসায়িক উত্তরাধিকার না হয়ে চলে গেলেন লাহোরে,শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে। প্রফেসর ফারিদানীর মতে-‘তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে তাঁর ওপর এমন এক গুরুদায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে যে,তাঁর উচিত ঐ দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করা।' তিনি শিয়ালকোটকে এই কাজের জন্যে ক্ষুদ্র মনে করলেন,তাই লাহোরে চলে গেলেন এবং সেখানকার সরকারী কলেজে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ. অর্জনের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন।
ইসলাম গবেষক প্রফেসর টমাস আর্নল্ডের কাছে তিনি এবার শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে গেলেন। দর্শনের ব্যাপারে কবি ইকবালের সৃষ্টিশীলতা,প্রেম এবং চিন্তার উৎকর্ষ এতো গভীর ছিল যে, স্বয়ং তাঁর শিক্ষক আর্নল্ড এক সময় বলেছিলেন-‘এই ছাত্র, শিক্ষককে গবেষক এবং গবেষককে মহাপণ্ডিত বানিয়ে ছাড়বে।' ১৯০৫ সালে ইকবাল ইংল্যান্ডে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যান। সেখানে ইরান বিশেষজ্ঞ দুই জন মধ্যপ্রাচ্যবিদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। একজন হলেন এডওয়ার্ড ব্রাউন এবং অপরজন হলেন নিকলসন। এই দুই শিক্ষকের সাথে উঠাবসার সুবাদে ফার্সি সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর ভালো একটা ধারণা জন্মে। ফার্সি কবিতা পাঠের জন্যেও তাঁর কণ্ঠ পরিপক্ক হয় এবং সম্ভবত এ সময়টাতেই তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাচেতনা প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার প্রেরণা পান। যাই হোক, ইকবাল এখানে দর্শন এবং আইনশাস্ত্রে পড়ালেখা শেষ করে দর্শনের ওপর পড়ালেখা চূড়ান্তভাবে শেষ করার জন্যে জার্মানীতে যান।
ইউরোপে কয়েক বছর কাটানোর ফলে ইকবাল প্লেটো থেকে বার্গ সঁ পর্যন্ত বিভিন্ন দার্শনিকের চিন্তা ও কর্মের সাথে পরিচিত হন। তবে পাশ্চাত্য দর্শন তাঁকে তুষ্ট করতে পারে নি। কেননা পাশ্চাত্য দর্শনে তিনি সমাধান-অযোগ্য বহু বিষয় দেখতে পেয়েছেন। এ সময় তিনি পাশ্চাত্যের দার্শনিক মতবাদগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেন এবং তাঁর নিজস্ব চিন্তাদর্শ অর্থাৎ ইসলামী আদর্শকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন অগ্রগতি বা দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করার সুযোগ পান। এই প্রচেষ্টারই সোনালী ফসল হলো "দ্য ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পারসিয়া" বা পারস্যে অধিবিদ্যার উন্নয়ন নামক গ্রন্থটি। এটি ছিল তাঁর একটি গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্র বা থিসিসটি তিনি জমা দিয়েছিলেন মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে। ঐ ইউনিভার্সিটি তাঁকে এই থিসিসের জন্যে দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছিল। থিসিসটি প্রকাশিত হয় লন্ডনে। সেই থেকে ইকবাল ইউরোপীয় সাহিত্যিক , রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী মহলে প্রাচ্যের একজন দার্শনিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
ইকবাল তাঁর এই থিসিস বা অভিসন্দর্ভটি তৈরী করার প্রয়োজনে বহু ফার্সি বই তাঁকে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে আধ্যাত্মিকতা,দর্শন,নীতি-নৈতিকতা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ফার্সি অনেক বই পড়েছেন। আর এসব বই পড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ফার্সি ভাষার সাথে তাঁর পরিচয়টা নিবীড় হয়েছে। এরপর তিনি ফার্সি ভাষার বই-পুস্তক প্রায় নিয়মিতই পড়তেন। এই পড়ালেখা বা পরিচিতির প্রভাবে যা হয়েছে তাহলো,তাঁর আধ্যাত্মিকতা বা দার্শনিক চিন্তা প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষাটা উপযোগী হয়ে উঠেছিল। এ জন্যেই লক্ষ্য করা গেছে যে,কবি ইকবাল তাঁর বহু বই ফার্সি ভাষায় লিখেছেন।
লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া এবং আরবি ভাষার শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর কবি ইকবাল লাহোরে ফিরে যান এবং লাহোর কলেজে দর্শনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৯১১ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি যেমন প্রচুর লেখালেখি করেন,তেমনি প্রচুর পড়াশোনাও করেন। মামলা সংক্রান্ত ফাইলপত্রাদি এবং আইন নিয়েও পড়াশোনা করেন। ফলে বাধ্য হয়েই তাঁর দেশের রাজনৈতিক সমস্যা ও সঙ্কট নিয়ে তাঁকে লড়তে হয়। এভাবে তিনি ভারত ,ইউরোপ এবং আমেরিকায় খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। ১৯২৬ সালে তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমান প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন।১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের বার্ষিক সভার সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব ওঠে। ১৯৩৩ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। তারপর থেকেই শুরু হয় ইকবাল জবিনের কষ্টকর অধ্যায়। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন তিনি। ঐ সাদামাটা জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই ১৯৩৮ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন