অর্থনৈতিক মুক্তির দিশারী ইমাম খোমেনী
অর্থনৈতিক মুক্তির দিশারী ইমাম খোমেনী
উন্নয়ন আধুনিক বিশ্বে অতি পরিচিত একটি বিষয়। এর সংজ্ঞা নিয়ে নানা মত থাকলেও সাধারণভাবে উন্নয়ন বলতে এমন কাংখিত অবস্থায় উপনীত হবার প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যে অবস্থায় উপনীত হলে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার হযরত ইমাম খোমেনী (রঃ) উন্নয়ন সম্পর্কেও অত্যন্ত ভারসাম্যমূলক, যৌক্তিক এবং বিপ্লবী ধারণা পোষন করতেন। এবারে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো ।
মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) উন্নয়নকে নিছক একটি অর্থনৈতিক বিষয় মনে না করে একে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের আলোকে দেখতেন । অবশ্য তিনি মানুষের জীবনোপকরণ বা দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মেটানোর সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিকেও গুরুত্ব দিতেন। যেমন- তিনি কৃষিকাজ, শ্রম ও শ্রমিকের গুরুত্ব, জনকল্যাণ, দারিদ্র ও বৈষম্য দূর করা, দরিদ্র শ্রেণীর জন্যে বাসস্থান বা আবাসনের ব্যবস্থা করা, শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন - প্রভৃতি অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। ইমাম খোমেনী অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে যে কোনো ধরনের চরম পন্থার বিরোধী ছিলেন। সমাজ বা দেশ তার সব শক্তি যেন শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন কিংবা শুধু ভোগ-বিলাসের জন্যে নিয়োজিত না করে, সে ব্যাপারে তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন । তিনি মনে করতেন পরাশক্তিগুলোর হাতে কুগিত নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে গরীব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরাশক্তির ওপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে ইমাম খোমেনী (রঃ) আরো বলেছেন, "ইসলাম সীমিত মালিকানার প্রতি শ্রদ্ধাশীল । মালিকানা ও ব্যয় সম্পর্কে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি মেনে চলা হলে সুস্থ অর্থনীতির চাকাগুলো সচল হয়ে উঠবে এবং একটি সুস্থ রাষ্ট্রের জন্যে জরুরী বলে বিবেচিত সামাজিক ন্যায় বিচারও প্রতিষ্ঠিত হবে।"
ইসলামী ইরানের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) সার্বিক উন্নয়ন তথা সর্বাত্মক উন্নয়নের কথা বলতেন, তবে তিনি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ওপর । তিনি বলতেন সাংস্কৃতিক উন্নয়ন অর্জিত না হলে উন্নয়ন হবে ভারসাম্যহীন এবং ত্রুটিপূর্ণ । সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ছাড়া সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয় বলেও তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন; কারণ, তাঁর মতে সংস্কৃতি হলো মানব সমাজের মূল প্রাণশক্তি। মানব সম্পদের উন্নয়নও নির্ভর করে সাংস্কৃতিক উনড়বয়নের ওপর । এ সব কিছুর আলোকে উন্নয়নের লক্ষ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) বলেছেন, "অবকাঠামোগত অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরী হলেও এসবই উন্নয়নের একমাত্র লক্ষ্য নয়, বরং বাহ্যিক অর্থনৈতিক দিকগুলো মানুষ ও সমাজের আধ্যাত্মিক উন্নতির ক্ষেত্রে তৈরির উপাদান এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সারা বিশ্বে শান্তি, ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও আধ্যাত্মিকতা প্রতিষ্ঠার ভূমিকা মাত্র । ইমাম খোমেনী (রঃ) সমাজের জনগণকে সব বিষয়ে সচেতন ও সুশিতি করে তোলাকে মানব সম্পদ উন্নয়ন তথা উন্নয়ন জোরদারের প্রধান পন্থা বলে মনে করতেন । তিনি বলতেন, রাষ্ট্রের কল্যাণ ও পরিচালনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলার ওপর নির্ভর করে । পুঁজি ও পুঁজি বিনিয়োগ সম্পর্কেও ইমাম খোমেনী ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে তুলে ধরেছেন । ইসলামী রাষ্ট্রের পুঁজি বিনিয়োগ বৃটেন ও আমেরিকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতো শুধু মুনাফাকামী বা অন্যদের ওপর শোষণের মাধ্যম হওয়া উচিত নয় বলে তিনি মনে করতেন । কারণ, এ ধরনের পুঁজিবাদীরা দিন দিন মানুষের প্রতি নির্দয় হতে থাকে এবং তাদের চরিত্রও কলুষিত হতে থাকে। একইসাথে ইসলামের পুঁজি ব্যবস্থা কমিউনিজমের অনুরুপ নয় বলেও তিনি ঘোষণা করেছেন। কারণ, কমিউনিজম ব্যক্তি মালিকানাকে মোটেই স্বীকার করেনা। ইসলাম শুধু মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে এবং দারিদ্র্যও বঞ্চনা দূর করার লক্ষ্যে পুঁজি বিনিয়োগকে সমর্থন করে এবং সে পুঁজিও হতে হবে সৎ বা হালাল উপায়ে অর্জিত । এ ধরনের পুঁজি বিনিয়োগ মানুষের আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা ও সংস্কৃতিকে উন্নত করে । ইসলাম যে কোনো বিশেষ শ্রেণী বা পরিবারের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত হবার বিরোধী সেটাও তিনি স্মরণ করিয়ে দেন । ইসলাম যাকাত, খোমস,সদকা ও বিভিন্ন কর প্রদানের মাধ্যমে বিশেষ শ্রেণীর পুঁজি ও সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে । পুঁজি বা সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিরা যেন ইসলামী রাষ্ট্রের কাঠামো এবং নীতি নির্ধারণে কোন প্রভাব ফেলতে না পারে সে বিষয়েও ইমাম খোমেনী(রাঃ) সতর্ক করে দিয়েছিলেন । কারণ, সম্পদের অধিকারী লোকেরা যদি ইসলামী রাষ্ট্রের নীতিমালাকে প্রভাবিত করতে সম হয়, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রের মহান আদর্শ ও লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত হবে না ।
পুঁজির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কিত ইমাম খোমেনী (রঃ)'র নীতিমালা বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ)'র নীতিমালারই প্রতিচ্ছবি । মহানবী (সঃ) বলেছেন, "সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পদই সৎ মানুষের জন্যে মানানসই বা গ্রহণযোগ্য । পানি ছাড়া নৌকা বা জাহাজ চলেনা, আবার পানির অপপ্রয়োগ নৌকা বা জাহাজকে ডুবিয়ে দিতে পারে, ঠিক তেমনি পুঁজির বৈধ ও সঠিক ব্যবহার মানুষের জন্যে কল্যাণকর এবং পুঁজির অনৈতিক ব্যবহার মানুষের জন্যে ধ্বংসাত্মক ।"
ইমাম খোমেনী (রঃ)'র মতে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জনগণ ও সরকার -এ দুইয়ের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ । এ ছাড়াও মুনাফাকামী পুঁজিবাদী দেশের মতো ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনীতি মূলত বড় বড় কিছু কোম্পানীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে না, বরং ইসলামী রাষ্ট্রের কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও অন্যান্য পেশার সব মানুষই দেশের অর্থনীতিতে মৌলিক ভূমিকা রাখবে । ইমাম খোমেনী (রঃ) বলেছেন, " সরকার যদি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জনগণকে শরীক করতে না পারে এবং দেশের ব্যক্তি মালিকানার খাতগুলো দরিদ্র ও বঞ্চিত শ্রেণীসহ সব শ্রেণীর মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত সহযোগিতা না পায়, তাহলে সে সরকার ব্যর্থ হবে । ইসলামী রাষ্ট্রে যদি কোনোভাবে এক শ্রেণীর মানুষ তাদের অর্থ ও যোগ্যতার বলে বেশী সম্পদের অধিকারী হয়ে যায় এবং বঞ্চিত শ্রেণীর লোকেরা কোনো কারণে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে তাহলে সমাজকে ধনী ও দরিদ্রের দ্বিমুখী মেরুকরণ থেকে রার জন্যে ইসলামী সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে বলেও ইমাম খোমেনী (রঃ) দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন ।
অর্থনৈতিক দিক থেকে ইরান যাতে বিশ্বের মুক্তিকামী জাতিগুলোর কাছে আদর্শে পরিণত হতে না পারে সে জন্যে ইসলামী বিপ্লবের পর আমেরিকা ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে । কিন্তু ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ইরান আমেরিকার এ চাপের কাছে বিন্দুমাত্র নতি স্বীকার করেনি, বরং আমেরিকার এ শত্র"তার ফলে ইরান স্বনির্ভর হবার পথে আরো দৃঢ়-সংকল্প হয় । ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ সম্পর্কে মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) বলেছিলেন, "আমেরিকার মতো দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে আমাদের কি লাভ হবে-যারা আমাদের দেশে লুটপাট করতে চায়? আমাদের সাথে ওদের সম্পর্ক কি লুটেরা বা শোষকের সাথে শোষিতের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কিছু? কেন আমরা আমেরিকার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে যাব, যে আমেরিকা সমস্ত দরজাগুলো বন্ধ করে আমাদের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছে?
মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) দরিদ্র ও বঞ্চিত শ্রেণীর অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্যে কাজ করাকে বড় ইবাদত বলে মনে করতেন এবং দরিদ্রদের সুদবিহীন ঋণ দিয়ে ও বিভিন্নভাবে তাদের মেধার বিকাশ ঘটিয়ে এই শ্রেণীকে স্বনির্ভর করতে জোর দিয়েছেন। তিনি পৃথিবী থেকে দারিদ্রকে নির্মূল করার জন্যে গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথা বলতেন । এ জন্যে তিনি দরিদ্র জাতিগুলোকে হতাশা ভুলে আত্মবিশ্বাসী হবার পরামর্শ দিয়েছেন । ইমাম খোমেনী(রঃ) অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ সব ধরণের উন্নয়নের জন্য গবেষণা ও নব-উদ্ভাবনের উপরও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায় বিচারও যে পরস্পরের সাথে অবিচ্ছেদ্য সূত্রে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত এবং এ দুইয়ের একটিকে অপরটির জন্যে বিসর্জন দেয়া উচিত নয়-ইমামের এ দৃষ্টিভঙ্গীকে ইসলামী অর্থনীতির প্রধান সূত্র বলা যায়। সমাজ দরিদ্র থেকে গেলে, সেখানে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা বা সম্পদ ও সুযোগের সমবন্টনের কথা বলা অর্থহীন। অর্থাৎ দরিদ্র সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার অর্থ দারিদ্রের সুষম বন্টন ছাড়া অন্য কিছু বোঝায় না। মরহুম ইমাম খোমেনী(রঃ)এর এসব বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে বলা যায়, তিনি ছিলেন সমকালীন বিশ্বে অর্থনৈতিক মুক্তি, সংস্কার ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার এক মহান দিশারী এবং অর্থনৈতিক জিহাদের অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন