ওহাবি মতবাদঃ ৩০ তম পর্ব

 

ওহাবি মতবাদঃ ৩০ তম পর্ব

হজ্বের সময় সৌদি সরকার ওহাবি মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে বই এবং ম্যাগাজিন ছেপে যিয়ারতকারীদের মাঝে বিলি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেন্টারও সৌদি আরব জুড়ে ওহাবি মতবাদ প্রচার প্রসারের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ওহাবিদের কিছু ধর্মীয় কেন্দ্রও আহলে সুন্নাত তথা হাম্বলি, শাফেয়ি, হানাফি এবং মালেকি মাযহাবের মতো বিখ্যাত মাযহাবগুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন ফতোয়া জারি করে থাকে। দুঃখজনক বিষয়টি হলো জনগণ এইসব ফতোয়া মানতে বাধ্য। এসবের বাইরেও ওহাবি মতবাদ প্রচার প্রসারের আরো গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো গণমাধ্যম। ওহাবিরাও এই গণমাধ্যমের গুরুত্ব বুঝতে পেরে এক্ষেত্রে ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠেছে। সৌদি আরব থেকে বহু স্যাটেলাইট চ্যানেল এখন ওহাবি মতবাদ প্রচারের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এইসব চ্যানেলে অন্যান্য মুসলমানদেরকে কাফির বলে প্রচার করা হয় আর ওহাবিদেরকেই কেবল খাটিঁ মুসলমান বলে গণ্য করা হয়।

'আলআরাবিয়া' নিউজ চ্যানেলটিও সৌদিআরবের আন্তর্জাতিক চ্যানেলগুলোর একটি। এই চ্যানেলটি নিউজধর্মী পরিচয়ধারী হলেও তাদের রিপার্টে কিংবা নিউজ ভিত্তিক প্রোগ্রামগুলোতে ওহাবি মতবাদ প্রচারের চেষ্টা করে এবং এই মতবাদের বিরোধীদের প্রতি বিশেষ করে ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী প্রতিরোধের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ইন্টারনেটও যেহেতু সহজলভ্য এবং এর ইউজার প্রচুর সেজন্যে এটিও ওহাবিদের গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ইসলামের বিভিন্ন মাযহাবের বিরুদ্ধে বর্তমানে ওহাবিদের বহু সাইট তৎপর রয়েছে। ওহাবি অনেক ধনকুবের এবং সৌদি সরকারের আর্থিক সহায়তায় এগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সৌদিআরবে ওহাবিদের বৃহৎ ছয়টি লাইব্রেরি রয়েছে। সেইসাথে ১১৭ টিরও বেশি প্রকাশনাকেন্দ্র ও ছাপাখানা সৌদিআরবে বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও বই প্রকাশের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এইসব প্রকাশনা সংস্থা বা ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত বইগুলোর বহু অধ্যায় জুড়ে থাকে ওহাবি মতবাদের বিরোধীদের আকিদা প্রত্যাখান করা। এ ক্ষেত্রে তারা শিয়া সুন্নি নির্বিশেষে ভিন্ন মাযহাবকে অযৌক্তিক ও অবমাননাকর ভাষায় তুলে ধরে। 

দুঃখজনকভাবে মুহাম্মাদি খাটিঁ ইসলাম যেখান থেকে সূচিত হয়েছে সেই সৌদি আরবই এ ব্যাপারে উদাসীন। ইসলামের ঐশী বিধিবিধানগুলো ওহি নাযিলের স্থানেই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। ভালোবাসা সেখানে সহিংসতায় পরিণত হচ্ছে, ইসলামী ঐক্য পরিণত হচ্ছে বিভিদে আর স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তা সেখানে রূপ নিচ্ছে গোঁড়ামিতে। আলে সৌদ সরকার ওহাবি মতবাদের বিকৃত ও ভ্রান্ত শিক্ষাদর্শের ভিত্তিতে মুসলমানদের মাঝে রহমতপূর্ণ, দয়াপূর্ণ, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এক স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার পরবির্তে ইসলাম বিরোধী বলদর্পী শক্তিগুলোর হাতে হাত মিলিয়ে তাদের নীতিই ওহাবি মতবাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায় আলে সৌদ সরকার এবং সৌদি আরবের ওহাবি মতবাদ হচ্ছে মুসলিম বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো আধিপত্যবাদী সরকারগুলোর শক্তিশালী নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। 

সৌদিআরব সরকারের সমূহ পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাষ্ট্রীয় সহায়তা পেয়েও ওহাবি মতবাদ কিন্তু আলেম সমাজের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়ে এসেছে। এই মতবাদটি গড়ে ওঠার সূচনাতেই চারদিক থেকে সমালোচনার মুখে পড়ে। 'শেখ জাফর কাশেফ আলগাত্তা'র কিংবা 'সাইয়্যেদ মোহসেন আমিন আমেলি'র মতো বিখ্যাত আলেমগণও ওহাবি মতবাদের আকিদা বিশ্বাসকে ভ্রান্ত ও বিচ্যুত বলে প্রমাণ করে বই লিখেছেন। আলগাত্তার 'মিনহাজুর রাশাদ' এবং আমেলি'র 'কাশফুল এরতিয়াব' নামক বইগুলোতে ওহাবিদের আকিদাকে দলিল প্রমাণের সাহায্যে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তাঁরা আরো দেখিয়েছেন, ওহাবি মতবাদের অনুসারীদের আচরণ কেবল সহিংসতাপূর্ণই নয় বরং তাদের চিন্তা চেতনাও উগ্রতা, গোঁড়ামি আর অযৌক্তিকতায় ভরপুর। যুক্তি, তথ্য ও জ্ঞানপূর্ণ এ ধরনের সমালোচনা এমন একটা সময়ে হয়েছিল,যে সময় দ্বীন বিরোধী ওহাবি মতবাদটি মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। ওহাবিরা সীমাহীন ত্রাস ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের মালামাল লুট করে তাদের ঐ ভ্রান্ত মতবাদটিকে আজ পর্যন্ত চালু রেখেছে।

 

অবশ্য ওহাবি ফের্কার নেতাদের ভাগ্য খুবই প্রসন্ন ছিল বলতে হবে। কেননা তারা অঢেল প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের মাধ্যমে অর্জিত সমৃদ্ধ অর্থনীতির অধিকারী দেশ সৌদি আরবের সার্বিক সহায়তা পেয়েছে। তাছাড়া মুসলমানদের পবিত্র স্থাপনা হারামাইন শরিফাইনও সৌদিআরবে অবস্থিত হবার সুবাদে সেদেশের সরকারই সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। আর সেখানে ওহাবিরা সরকারী আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় সেগুলোকে নিজেদের আকিদা প্রচারের কাজে লাগাতে পারছে। সেইসাথে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে তারা সমগ্র মুসলিম জাতির মাঝে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাতে পেরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা সরকারগুলোর জন্যে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের মতো অনুগত একটি সরকারের খুবই প্রয়োজন।

 কারণটা হলো অন্যান্য আরব দেশগুলোর সাথে যেহেতু সৌদি আরবের গোত্রীয় এবং সাংস্কৃতিক অভিন্নতা রয়েছে,তাই মধ্যপ্রাচ্যের ঐসব দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব সহজেই সৌদি সরকারের মাধ্যমে তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি এবং লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে কিংবা চাপিয়ে দিতে সক্ষম। ওহাবি নেতারা অবশ্য নিজেদেরকে খাটিঁ এবং মূল ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করে থাকে এবং এ দাবির পেছনে তারা ভিত্তিহীন অনেক বড়ো বড়ো দলিলও তুলে ধরার চেষ্টা করে থাকে। অথচ বাস্তবতা হলো এই যে, ওহাবি মতবাদের শিক্ষাগুলো উপনিবেশবাদীদের লক্ষ্যগুলোই বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে আর হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর খাঁটি ইসলামকে নির্মূল করতে সহায়তা করছে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি'র প্রফেসর হামিদ আলগারের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আলোচনার। 'ওহাবিজম' নামে তিনি গবেষণামূলক একটি বই লিখেছেন। ঐ বইতে তিনি বলেছেনঃ"দুটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। প্রথমটি হলো ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বা ইসলামের সমৃদ্ধ চিন্তাদর্শে ওহাবিজম বিশেষ কোনো স্থানের অধিকারী নয়। এই দলটির অবস্থান বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলিক চিন্তাধারার বাইরে। তবে তাদের সৌভাগ্য হলো এই, সৌদিআরবের মতো দেশে এবং মুসলিম বিশ্বের ভৌগোলিক মূল কেন্দ্র হারামাইনের কাছে এই মতবাদটির উত্থান হয়েছে। দ্বিতীয় দিকটি হলো,..তাদের সৌদি পৃষ্ঠপোষকগণ বিংশ শতাব্দিতে তেলের বিশাল সম্পদের অধিকারী হয়। ঐ সম্পদের একটা অংশ কেবল...মুসলিম বিশ্বে ওহাবি মতবাদ প্রচারের কাজে লাগানো হয়। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা যদি না থাকতো তাহলে ইতিহাসের পাতায় ওহাবি মতবাদ গুরুত্বহীন এবং দৃঢ়তাহীন একটি ফের্কা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকতো।" ইসলাম নিয়ে আরো বেশি চর্চা,গবেষণা করা হলে এই সত্য সবার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন