ওহাবি মতবাদঃ ২৭ তম পর্ব

ওহাবি মতবাদঃ ২৭ তম পর্ব
ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে সমকালীন আলেমগণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। তাঁরা মুসলিম সমাজের জন্যে ইবনে তাইমিয়াকে বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। তার কারণ আলেম সমাজ ইবনে তাইমিয়ার ভ্রান্ত মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গির জবাব দিতে গিয়ে যতো প্রকার তথ্য প্রমাণই দিতেন সেগুলোর কোনো প্রভাবই তার ওপর পড়তো না এমনকি তার ভ্রান্ত আকিদার বিরুদ্ধে যতো রকমের প্রতিবাদই জানানো হতো সে সেগুলোকে তোয়াক্কাই করতো না। উল্টো বরং নিজেকেই খাঁটি মুসলমান বলে মনে করতো। ইবনে তাইমিয়ার সমকালীন বিখ্যাত আলেম "তাকি উদ্দিন সুবকি" (মৃত্যুঃ৭৫৬ হিজরি) ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে লিখেছেনঃ "ইবনে তাইমিয়া কোরআন এবং সুন্নাহর অনুসরণের আড়ালে ইসলামি আকিদায় বেদয়াত ঢুকিয়ে ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলোকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সে মুসলমানদের সামগ্রিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।" ইবনে তাইমিয়া নিজেকে একজন হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী বলে দাবি করতো। কট্টর ও গোঁড়ামিপূর্ণ চিন্তার অধিকারী ছিল সে। দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা যৌক্তিক কোনো আলোচনায় সে বিশ্বাস করতো না। আলেম সমাজ ইবনে তাইমিয়ার লেখা বইগুলো পর্যালোচনা করে বলেছেন আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর সত্ত্বাসহ ইসলামের অন্যান্য বিধান সম্পর্কে তার যে বক্তব্য সেগুলো একান্তই শিশুসুলভ। তার সেইসব বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় ইসলামের গভীর এবং মূল্যবান তত্ত্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। আলেমদের এই দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থই ছিল বলতে হবে। কেননা ইবনে তাইমিয়া যুক্তিতর্ক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিকে দূরে ঠেলে রেখে অতি দ্রুত বাহ্যিকতা এবং বস্তুজাগতিকতার রসাতলে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ এবং তাঁর একত্ববাদ সম্পর্কে তার পদক্ষেপগুলো ছিল একেবারেই নড়বড়ে। সে আসলে কল্পনাবিলাসী ছিল। নিজেকে একজন মুসলমান বলে মনে করতো আর তার বিরোধিতাকারীদেরকে অতি সহজেই গালি দিত, এমনকি তাদেরকে মুশরিক, দ্বীন থেকে খারিজ হয়ে গেছে ইত্যাদি বলে মনে করতো।
ইবনে তাইমিয়া বিচিত্র বেদায়াতের জন্ম দিয়ে ওহাবিয়াত নামের উগ্র এবং ভয়ংকর একটি ফের্কার সৃষ্টি করে। এই ফের্কাটি জন্মের সূচনা থেকে এখন পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি, হত্যাকাণ্ডসহ মুসলিম বিশ্বে শত শত অপরাধ সংঘটিত করেছে। এইসব খেয়ানত থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় কেন ইসলামে বেদায়াতের জন্ম দেওয়া এবং ধর্মের ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেওয়াকে কবিরা গুনাহ বলে গণ্য করা হয়। হযরত আলি (আ) বলেছেনঃ "বেদায়াতের মতো আর কোনো জিনিসই দ্বীনকে বিরান করে নি।" কোরআনে কারিমেও নিজের মিথ্যা বক্তব্যকে আল্লাহর বলে যে বেদায়াতের জন্ম দেওয়া হয় তাকে ভৎর্সনা করা হয়েছে। সূরা ইউনূসের ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "বলো! আমাকে জানাও! আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা কিছু রিযিক পাঠিয়েছেন,তোমরা কেন তার কিছু অংশ হালাল আর কিছু অংশ হারাম সাব্যস্ত করে নিলে? বলো, আচ্ছা আল্লাহ কি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন নাকি তোমরা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করছো?"
ধর্মের ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেওয়া, ধর্মীয় বিধি বিধানে কিছু সংযোজন করা বা কোনো কিছু বিয়োজন করার মানেই হলো আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করা। অন্যভাবে বলা যায়, যে-কোনো ধরনের দখলদারিত্বের টার্গেট যদি হয় দ্বীন এবং তার মাঝে যদি পরিবর্তন আনা হয়, তাহলেই তা ধর্মের ওপর মত চাপানো বলে গণ্য হবে। আর যদি কোনো ব্যক্তি তার এইসব কর্মকাণ্ডকে আল্লাহর কিংবা রাসূলে খোদার বলে দাবি করে তাহলে তার ঐসব কর্মকাণ্ড বেদয়াত হিসেবে গণ্য হবে। বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ মোহসেন আমিন আমেলি বেদয়াতের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ "বেদায়াত হলো দ্বীনের অংশ নয় এমন কোনো বিষয়কে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা। একইভাবে হারামকে মোবাহ মনে করা কিংবা মোবাহকে হারাম করা। ফরয নয় এমন বিষয়কে ফরয বলে গণ্য করা এবং মোস্তাহাব নয় এমন বিষয়কে মোস্তাহাব বলে গণ্য করা।"
অন্যভাবে বলা যায় ঐশি বিধি বিধানে কোনো কিছু সংযোজন করা কিংবা বিয়োজন করার নামই বেদয়াত। আর বেদয়াতকারী ইসলামী শরিয়ত এবং আল্লাহর বন্দেগির বৃত্তের বাইরে চলে যায়।
বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞ। কীসে মানুষের কল্যাণ আর কীসে অকল্যাণ তিনিই সবার চেয়ে ভালো জানেন কেননা তিনিই সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। সেজন্যে অপার দয়াময় আল্লাহ মানুষের সর্বোত্তম জীবন যাপনের জন্যে এবং মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে উপযুক্ত সকল বিধি বিধান দ্বীনে ইসলামে দিয়ে দিয়েছেন। এইসব বিধান মানুষের সমগ্র জীবনের জন্যে পরিপূর্ণ এবং সর্বোৎকৃষ্ট জীবন বিধান। কোরআনে কারিমে এই বিধানের গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছে মানুষের জন্যে জীবন বিধান দেওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহরই রয়েছে। সূরা ইউসূফের চল্লিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "বিধান দেওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে তোমরা শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদাত করবে, আর কারো ইবাদাত করবে না, এটাই সরল সঠিক দ্বীন।"
ইবনে তাইমিয়া আসলে তৌহিদের নামে তার ভ্রান্ত আকিদার ভিত্তিতে আল্লাহ সম্পর্কে, যিয়ারত, তাওয়াসসুল, শাফায়াতের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে উল্টাপাল্টা ধারণা দিয়েছে এবং সেই ধারণাকেই মৌলিক ইসলাম বলে প্রচার করেছে। তার এবং মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি গভীর মনোনিবেশ করলে দেখা যাবে তারা আসলে চেয়েছে একজন মুসলমানের সাথে আল্লাহর অলিদের আধ্যাত্মিক সম্পর্ককে পুরোপুরি মুছে ফেলতে, বিশেষ করে নবী করিম (সা) এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক। ইসলামের আবির্ভাবের শুরুতে এবং রাসূলে খোদার ওফাতের পর ইসলামের শত্রুরা যে কাজ করেছিল ইবনে তাইমিয়ার কর্মকাণ্ড তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এইসব ওহাবি আলেমদের মতো বেদয়াতি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। সূরা বাকারার উনআশি নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "তাদের জন্যে আফসোস, যারা নিজ হাতে বই লেখে আর বলে বেড়ায়-এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে....."
মজার ব্যাপার হলো,ইবনে তাইমিয়া সারাজীবন যেসবের বিরোধিতা করেছেন, মৃত্যুর পর তার সাথে সেই কাজগুলোই করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে তার প্রচারিত মতবাদ নিজ অনুসারীদের ওপরেই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় নি। কেননা বিখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসির বলেছেনঃ
"মৃত্যুর পর তার অনুসারীদের একদল তার লাশের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াৎ করেছিল, বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে তাকে দেখে চুমু খেয়েছিল। এছাড়া একদল নারীও তাই করলো...লোকজন বরকতের উদ্দেশ্যে তাদের টুপি, পাগড়ি, জামা কাপড়ে ইত্যাদি তার লাশের ওপর ফেলেছিল।....কেউ কেউ তাকে গোসল দেওয়ার জন্যে আনা পানির অতিরিক্ত অংশ পান করলো আবার অনেকেই গোসলের জন্যে আনা কাপূরের অবশিষ্ট অংশ ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছিল।"
যেই ওহাবি মতবাদ নিজেই দ্বীনের ভেতর বহু বেদায়াতের জন্ম দিয়েছে, সেই মতবাদই আবার অন্যদেরকে বেদায়াতের ব্যাপারে অভিযুক্ত করছে এমনকি নতুন নতুন উদ্ভাবনীর ব্যাপারেও। অথচ মানুষের অভ্যন্তরীণ সৃজনশীলতা বিকশিত হয় নতুন নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এবং এই উদ্ভাবনী মানুষকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। যেমন যোগাযোগ সরঞ্জাম বা পরিবহণ সামগ্রি অর্থাৎ গাড়ির মতো মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তৈরি করা...যেগুলো মানুষের কল্যাণে লাগে, সেগুলো কোনোভাবেই বেদায়াত হতে পারে না এবং এগুলো ব্যবহার করা গুনাহের কাজ নয়। নতুন নতুন আবিষ্কার যদি ইসলামের জন্যে ক্ষতির কারণ না হয় সেগুলোকে ইসলাম স্বাগত জানায়। অথচ ওহাবিরা তাদের বিকৃত এবং ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোকে বেদায়াত বলে মনে করে। তারা বলে এগুলো মানুষকে আল্লাহ বিমুখ করে তোলে, তাই এগুলো ব্যবহার করা শেরেকি।

সৌদি আরবে মহিলাদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ এ ধরনের আরো অনেক প্রতিবন্ধকতার কারণে আধুনিক টেকনোলজির কল্যাণ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। কিছুদিন আগেও সৌদিআরবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা 'শের্‌ক' হিসেবে গণ্য ছিল। এ পর্যন্ত বহু টেলিফোন সেন্টারে হামলা হয়েছে। এখনো ওহাবি আলেমদের দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক অনেক প্রযুক্তির ব্যবহার হারাম। ইসলামী গবেষকগণ ওহাবিদেরকে খারেজি সম্প্রদায়ের সাথে তুলনা করেছেন। আলী (আ) সময় খারেজিরা তাঁর বিরোধিতা করেছিল এবং নিজেদেরকে আলী (আ) এর চেয়েও বেশি ইমানদার বলে মনে করতো। এরা ছিল গোঁড়া সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি। খারেজিদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে তারা ছিলো ঐশী খেলাফত, কোরআন এবং ইসলাম সম্পর্কে ভুল উপলব্ধি বা চিন্তাধারার অধিকারী। এরাও ছিল ওহাবিদের মতোই দ্বীনের ভেতর বেদায়াত সৃষ্টিকারী। খারেজিরাও নিজেদের মূর্খতার কারণে মুসলমানদেরকে কাফের বলে গণ্য করতো এবং তাদের মালামাল ও রক্তকে মোবাহ বলে মনে করতো।

অথচ প্রকৃত ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলে আকরাম (সা) এর সুন্নাতের অনুসরণ। এ সম্পর্কে রাসূলে খোদা (সা) বলেছেনঃ 'সবোর্ত্তম বস্তু হলো আল্লাহর কিতাব, সবোর্ৎকৃষ্ট দিক নির্দেশণা হলো মুহাম্মাদ (সা) এর হেদায়াত ও দিক-নির্দেশণা, আর সর্বনিকৃষ্ট জিনিস হলো বেদায়াত, আর সকল বেদায়াতই গোমরাহী।' আল্লাহ সবাইকে সর্বপ্রকার গোমরাহি থেকে রক্ষা করুন।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন