ওহাবি মতবাদঃ ২৬ তম পর্ব

ওহাবি মতবাদঃ ২৬ তম পর্ব
ওহাবি মতাদর্শের লেখক হাফেজ ওহাবা এই মতবাদকে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করেছেন এভাবেঃ
"ওহাবি ফের্কা হলো অবৈধ এবং বিদায়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং যুদ্ধ করা। বিশেষ করে সেইসব বেদায়াত যেগুলো শিরকের শামিল। যেমন যিয়ারত করা, তাওয়াসসুল করা, অলি-আওলিয়াদের ব্যবহৃত বিচিত্র সামগ্রীকে তাবাররোক বা পবিত্র উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা, কবরের পাশে নামায পড়া, কবরে বাতি জ্বালানো, কবরের ওপর লেখা, আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো কসম খাওয়া, খোদা ছাড়া অন্য কারো কাছে আরোগ্য বা সাহায্য চাওয়া এবং শাফায়াত প্রার্থনা করা ইত্যাদি।
ইবনে তাইমিয়াও বলেছেনঃ "কবরে চুমু দেওয়া বা কবর মোসেহ করা শের্‌ক,যদি তা নবী করিম (সা) এর কবরও হয়ে থাকে। নবীজীর কবরের ওপর হাত রাখা এবং কবরে চুমু দেওয়া জায়েয নেই এমনকি তা তৌহিদের খেলাফ।"
এই বক্তব্যগুলোই আসলে বিদয়াত। কেননা;রাসূলে খোদার সময়ে সাহাবায়ে কেরামগণ নবীজী এবং তাঁর ব্যক্তিগত বিচিত্র বস্তুকে তাবাররুক হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে উদগ্রিব থাকতেন। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্রকে তাঁরা অত্যন্ত পবিত্র মনে করে সেগুলোকে পবিত্র উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করতেন। নবীজীও কখনো সাহাবাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করেন নি। সিহহা সিত্তার অন্যতম বোখারি শরিফের সংকলক ইমাম বোখারি (রহ) এর বক্তব্যের একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছেন, 'ওরওয়া বিন মাসউদ' নামে রাসূলে খোদা (সা) এর একজন সাহাবি বলেন "খোদার কসম! নবী করিম (সা) এর ওজুর পানি সাহাবাগণ কখনোই নিচে পড়তে দিতেন না, সব পানি পড়তো সাহাবিদের হাতে,তাঁরা ঐ পানি নিজেদের চেহারা ও শরীরে মাখতেন...যখনই নবীজীর ওজু করার সময় হতো সাহাবিরা তখনই ওজুর পানি হাতে নেওয়ার জন্যে প্রতিযোগিতায় নেমে যেতেন।"
হজ্বের সময় রাসূলে আকরাম (সা) যখন তাঁর চুল কাটতেন, সাহাবাগণ তখন নবীজীর কর্তিত চুলগুলো জমা করতেন পবিত্রতা ও বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে। একইভাবে নবীজী যখন কোনো পানির মশকের মুখ দিয়ে পানি খেতেন সাহাবিগণ ঐ মশকের মুখ কেটে নিতেন বরকতের উদ্দেশ্যে। এসব কাজ যদি শির্‌ক হতো তাহলে নবিয়্যে মুকাররামে ইসলাম মুসলমানদেরকে সেসব করতে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। কেননা নবীজীর সন্তানের মৃত্যুর জন্যে যখন চন্দ্রগহণকে কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছিলো, নবীজী তখন কঠোরভাবে ঐ ভ্রান্ত আকিদার বিরোধিতা করেছিলেন। নবীজীর কাছ থেকে ফযিলত ও বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে জনগণ যে চেষ্টা চালিয়েছেন সে সম্পর্কে বহু হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, নবীজী এ কাজের বিরোধিতা করেছেন এরকম কোনো বর্ণনা নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না।
আসলে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে যেসব পুণ্যবান সালেহিন বান্দার, তাঁদেরকে পবিত্র জ্ঞান করার অর্থ শেরেকি করা নয়, বরং সবসময় এই বিশ্বাস থেকেই করা হয় যে, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তাঁদের কারো পক্ষেই সম্ভব নয় অপর কারো জন্যে মঙ্গল বয়ে আনা কিংবা কারো বিপদ দূর করা। রাসূলে খোদার মিম্বার, তাঁর কবর, কবর ছোঁয়া এবং তাতে চুমু খাওয়া ইত্যাদি কাজ নবীজীর ওফাতের পর মুসলমানরা করতেন।মদিনার বিখ্যাত ফকিহ সায়িদ বিন মুসাইয়্যেব এবং ইয়াহিয়া বিন সায়িদ এসব কাজ করতেন। ঐশী ব্যক্তিত্ববর্গের রেখে যাওয়া জিনিসপত্র কিংবা তাঁদের কবরকে পবিত্র জ্ঞান করার অর্থ হলো যেহেতু তাঁরা ছিলেন অনেক উন্নত পর্যায়ের এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী মানুষ, সেজন্যে তাঁদের প্রতিটি জিনিসই পবিত্র এবং মর্যাদা ও সম্মানের যোগ্য।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ইউসুফ (আ)র কাহিনীটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইয়াকুব (আ) ছিলেন ইউসুফ (আ) এর পিতা। বার্ধক্যে এসে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ইউসুফ (আ) তাঁর জামাটি পাঠালেন বাবার জন্যে। হযরত ইয়াকুব (আ) পুত্র ইউসুফের দেওয়া জামাটি চোখে লাগালেন আর তাঁর চোখ ভালো হয়ে গেল। এটাই হলো তাবাররোক,এটাই হলো পবিত্রতা জ্ঞান। এই তাবাররোক করাটা বা আল্লাহর অলিদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রকে পবিত্র জ্ঞান করাটা যদি শেরক হতো তাহলে কোরআন কি ইয়াকুব (আ) এর এই কাজকে নেতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করতো না? নবীজীর কবর ছোঁয়া বা কবরে চুমু দেওয়াতেও কোনো সমস্যা নেই বলে আহমাদ ইবনে হাম্বল মনে করতেন। সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূলে খোদার সাথে সবসময়ের জন্যেই থাকতেন,তাঁরাও তাবাররোক অন্বেষণ করেছেন। আমরা এ সময়ের মুসলমানরা যারা নবীজীকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করি নি,তারা নবীজীর মাযার স্পর্শ করে, চুমু দিয়ে তাঁর প্রতি আমাদের অন্তরের ভালোবাসা ও প্রেমের পরিচয় দেব এতে দোষের কী আছে?
কোনো স্থান বা জায়গার প্রকৃতিজাত কোনো মূল্য সাধারণত নেই। কিন্তু পবিত্র স্থানগুলো আল্লাহর পূণ্যবান বান্দাদের নামায রোযার কারণে, ইবাদাতের কারণে বিশেষত্ব লাভ করে। কেননা আল্লাহর পূণ্যবান বান্দারা বহু জায়গায় নেক আমল অর্থাৎ ইবাদাত করার কারণে সেইসব স্থানে আল্লাহর রহমত নাযিল হয়, সেখানে আল্লাহর ফেরেশতাগণ যাওয়া আসা করেন, সেখানে তাই প্রশান্তি নেমে আসে। এটাই হলো সেই বরকত যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সেইসব স্থানে দেওয়া হয়েছে। মুমিন ব্যক্তিগণ এ ধরনের জায়গা বা স্থাপনায় এলে আল্লাহর প্রতি তাঁদের মনোযোগ ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তাঁরা তাই দোয়া-এস্তেগফার করার মধ্য দিয়ে ঐশী নূরে নিজেদের অন্তরের শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা চালায়। মাসজিদুন নাবী, নবীজীর রওজা মোবারক কিংবা আল্লাহর কোনো বুযুর্গানে দ্বিনের কবরের পাশে দাঁড়ালে তাঁদের খালেস বন্দেগি এবং আল্লাহর পথে নিজেদের শ্রম ও কষ্টের কথাগুলো মনে পড়ে। তাই তাঁদের মতো করে নিজেদেরকে গড়ে তোলা অর্থাৎ তাঁদের মতোই খালেস বন্দেগি করার স্পৃহা মনে জাগে।
পয়গাম্বর (সা) এর মিরাজ গমন শুরু হয়েছিল মাসজিদুল আকসা থেকে। তার আগে তিনি মদিনায়, সিনাই পর্বতে এবং বেথেলহামে নেমে নামায পড়েছিলেন। জিব্রাইল (আ) নবীজীকে বলেছিলেনঃ "মদিনা তাইয়্যেবায় নামায পড়েছেন কেননা সেটা ছিল আপনার হিজরতের স্থান, সিনাই পর্বতে নামায পড়েছেন কেননা সেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মূসা (আ) এর সাথে কথা বলেছিলেন আর বেথেলহামে নামায পড়েছেন কেননা তা ছিল মারিয়াম (সা) এর পুত্র ইসা (আ) এর জন্মস্থান।" তবে হ্যাঁ! বুযুর্গানে দ্বীন এমনকি রাসূলে খোদা (সা) এর কবরের ওপর সিজদা করা ঠিক নয়। অর্থাৎ কবরকে কেবলা বানাতে নিষেধ করেছেন রাসূল (সা)। তবে কবরের পাশে নামায পড়ায় সমস্যা নেই। যেমন মাকামে ইব্রাহিম। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার এক শ পঁচিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ..এবং মাকামে ইব্রাহিমকে প্রার্থনাস্থল নির্ধারণ করেছিলাম..।"
এসব বর্ণনা থেকে ওহাবিদের দৃষ্টিভঙ্গি যে অমূলক এবং ভ্রান্ত, তা কি প্রমাণিত হয় না?
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন