ওহাবি মতবাদঃ ২৫ তম পর্ব

ওহাবি মতবাদঃ ২৫ তম পর্ব

মুসলমানরা সবসময়ই দ্বীনের মহান মনীষীদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাঁদেরকে স্মরণ করে এসেছে। এমনকি তাঁদের সমাধিসৌধ নির্মাণ করে মাযারের পাশে মসজিদ তৈরি করে ইবাদাত বন্দেগির মধ্য দিয়ে মনীষীদের স্মৃতিকে মনের ভেতরে জাগ্রত রেখে এসেছে। কিন্তু ওহাবিরা আল্লাহর অলি, সালেহিন এমনকি নবীদের কবরের ওপরেও মসজিদ কিংবা সমাধিসৌধ নির্মাণ করাকে বেদআত বলে অভিহিত করেছে।

এভাবে বেদআতের প্রসঙ্গটি সর্বপ্রথম উত্থাপন করেছিলেন সালাফিয়া মতবাদের তাত্ত্বিক ইবনে তাইমিয়া এবং তারপরে তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র ইবনে কায়্যেম জোওযি। তারা কবরের ওপর কোনো স্থাপনা নির্মাণ করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন এবং ঐ ধরনের স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার জন্যে ফতোয়া জারি করেছেন। ইবনে কায়্যেম তার বইতে লিখেছেন এ ধরনের স্থাপনা ধ্বংস করার কাজে এমনকি একটি দিনও বিলম্ব করা জায়েয নয়। এইসব নীতিমালার ভিত্তিতে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের মাধ্যমে ওহাবি মতবাদ সংগঠিত হবার পর এবং আলে সৌদের পৃষ্ঠপোষকতার পর পবিত্র স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক সেনা সমাবেশ করা হয় এবং সেগুলোকে ধ্বংস করে, সেখানকার সম্পদ লুট করা হয়। ১৯২৬ সালে মদিনায় বাকি কবরস্থানে নবী করিম (সা) এর সাহাবিবৃন্দ এবং খান্দানের মাযারগুলোকে ধ্বংস করার ঘটনা ওহাবিদের সবচেয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও ধৃষ্টতামূলক আচরণ হিসেবে পরিগণিত। অথচ আজ পর্যন্তও সালাফি বা ওহাবি আলেমরা তাদের এই অমানবিক, নোংরা ও ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজের পক্ষে দ্বীনী প্রমাণ তো দূরের কথা, বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো যুক্তিও দেখাতে পারে নি।

 

ইসলামের দ্বীনী নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান দেখানো বা সেগুলোকে সংরক্ষণ করা মহান আল্লাহরই নির্দেশ বা পরামর্শ। সূরায়ে হাজ্জের বত্রিশ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ "কেউ যদি ঐশী নিদর্শনগুলোকে সম্মান করে তাহলে সে যেন তার আন্তরিক তাকওয়ারই বহিপ্রকাশ ঘটালো।" সাফা, মারওয়া, মাশআর, মিনা এবং হজ্জের সামগ্রিক আনুষ্ঠানিকতা সবই ঐশী নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত। একইভাবে নবী-রাসূলসহ সালেহিনদের কবরের প্রতি সম্মান দেখানোটাও ইসলামের একটি দ্বীনী দায়িত্ব এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়। কেননা ইসলামের মহান নবী এবং আল্লাহর অন্যান্য অলি-আওলিয়ারা হলেন আল্লাহর যমিনে তাঁরি সর্বোত্তম নিদর্শন,তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি উপায় হলো তাঁদের কবর এবং কীর্তিগুলোকে সংরক্ষণ করা। নবী, রাসূল আর সালেহিনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা বা তাঁদের কবরগুলোকে সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে দ্বীনে ইসলামের প্রতি মুসলমানদের ভালোবাসাই প্রকাশ পায়।

 
কোরআনে কারিমও এই কাজকে পছন্দনীয় বলে উল্লেখ করে আদেশ দিয়েছে, কেবল নবীজী (সা) কেই নয় বরং তাঁর আত্মীয় স্বজনদের ব্যাপারেও সবাই যেন সহানুভূতিশীল হয়। সূরা শূরা'র তেইশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "..বলো, আমি এর (অর্থাৎ আমার রেসালাতের) বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে-আমার-আত্মীয়দের (অর্থাৎ আহলে বাইতের) সৌহার্দ ছাড়া আর কোনো প্রতিদান চাই না...।" এই আয়াত অনুযায়ী প্রশ্ন দাঁড়ায়, রেসালাতের খান্দানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করার একটা উপায় কি আল্লাহর অলিদের স্মৃতিগুলো, তাঁদের পবিত্র মাযারগুলো কিংবা তাঁদের বাসস্থানগুলো সংরক্ষণ করা নয়?

 

মজার ব্যাপার হলো কোরআনে কেবল ইসলামী নিদর্শনগুলোকেই সংরক্ষণ করার কথা বলা হয় নি বরং কবরের ওপর সৌধ নির্মাণ করাকেও জায়েয বলে ঘোষণা করেছে। আসহাবে কাহাফের ঘটনায় এই বিষয়টি এসেছে। আসহাবে কাহাফ যখন ঘুম থেকে জেগে উঠলো এবং কিছু সময় বেঁচে থাকার পর মারা গেল, জনগণ তখন বলাবলি করছিলো যে তাঁদের কবরের ওপর সৌধ নির্মাণ করবে কি করবে না! কেউ কেউ বলেছিলেন এই পুণ্যবান লোকদের সম্মানে তাঁদের কবরের ওপর একটি সৌধ নির্মাণ করা উচিত, আবার অনেকেই বলেছেন মসজিদ নির্মাণ করলে তাঁদের স্মৃতিও সংরক্ষণ করা হবে। পবিত্র কোরআনের সূরা কাহাফের একুশ নম্বর আয়াতে এই ঘটনা উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে মৃত সালেহ বান্দাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে তাঁদের কবরের ওপর সৌধ নির্মাণের সাথে বিশ্বস্রষ্টার পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই।

 
যদি কোনোরকম বিরোধিতা থাকতো তাহলে কোরআনের নূরানি আয়াতে তার উল্লেখ করা হতো এবং এ কাজ করতে নিষেধ করা হতো। যেভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইহুদি, খ্রিষ্টানসহ পূর্ববর্তী উম্মাতদের বহু আচরণকে অবৈধ বলে কোরআনে উল্লেখ করেছেন এবং সেসব করতে নিষেধ করেছেন। যেমনটি সূরা হাদিদের ২৭ নম্বর আয়াতে খ্রিষ্টানদের ব্যাপারে বলা হয়েছেঃ " এবং তারা নিজেরাই (খ্রিষ্টানরা) সন্ন্যাসবাদের প্রবর্তন করেছিল, আমরা তাদের ওপর এর বিধান দেই নি, যদিও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ছিল তাদের উদ্দেশ্য,তবু এটা তারা যথাযথভাবে পালন করে নি।"

এখন কথা হলো আল্লাহ যদি তাঁর আওলিয়ায়ে কেরাম বা বুযুর্গানে দ্বীনের কবরের ওপর মসজিদ কিংবা সৌধ নির্মাণ করার বিরোধিতা করতেন তাহলে কোরআনে কারিমে আল্লাহ এ কাজের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেন এবং এই কাজকে তাঁর অপছন্দনীয় বলে উল্লেখ করতেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আল্লাহর মনোনীত বা উপযুক্ত বান্দাদের কবরের ওপরে মাযার স্থাপনা নির্মাণের রেওয়ায বহু প্রাচীনকাল থেকেই মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত ছিল। সমগ্র মুসলিম ভূখণ্ডেই তার নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শিয়া মাযহাবের অনুসারীগণ রাসূলে খোদা (সা) এর সন্তান এবং তাঁর খান্দানের কবরের ওপর স্থাপনা বা সৌধ নির্মাণ করেছেন। সুন্নি মাযহাবের অনুসারীরাও শহিদান এবং বুযুর্গানে দ্বীনের কবরের ওপর গম্বুয ও স্থাপনা নির্মাণ করেছেন এবং তাঁদের কবর যিয়ারত করেন। মুসলমানরা নবী-রাসূলসহ আল্লাহর অলিদের কবর যিয়ারত করাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি উপায় বলে মনে করেন। সে লক্ষ্যে এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করাটাও ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের অংশ বলে মনে করেন। কেবল ওহাবি মতবাদের অনুসারিরাই এর বিরুদ্ধে গিয়ে পবিত্র স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করে ফেলায় বিশ্বাস করে।

 

ওহাবি মতবাদের আবির্ভাবের আগে ইসলামের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নবিয়্যে মুকাররামে ইসলাম (সা) এর জীবনী লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা ছাড়াও তাঁর ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেমন আংটি, জুতা, মেসওয়াক, তলোয়ার, ঢাল এমনকি রাসূলে খোদা (সা) যেসব কূপ থেকে পানি খেয়েছেন সেই কূপগুলো পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ওহাবিদের ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সেগুলোর খুব কমই এখন অবশিষ্ট রয়েছে। পৃথিবীর সকল ধর্ম এবং জাতির লোকই নিজস্ব প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণ করে, এটা পুরাতাত্ত্বিক সংস্কৃতিরই একটা অংশ। কিন্তু ওহাবিরা এসব চিন্তাভাবনা না করেই নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা অনুযায়ী ইসলামের পরিচয়কে প্রামাণ্য করে তোলার মাধ্যম মহামূল্যবান ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। যদিও তা আন্তর্জাতিক রীতিনীতিরও খেলাপ। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বোধ ও উপলব্ধি দান করুন।

সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন