ওহাবি মতবাদ- ২৪ তম পর্ব

ওহাবি মতবাদ- ২৪ তম পর্ব

 

ওহাবি মতবাদ- ২৪ তম পর্ব
মুসলমানরা সবসময়ই দ্বীনের মহান মনীষীদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদেঁরকে স্মরণ করে এসেছে। তাঁরা নবী করিম (সা) এবং আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক সৃষ্টিকারীদেরকে নিজেদের শাফি অর্থাৎ শাফায়াতকারী বলে মনে করেন। সেজন্যেই তাদেঁর কবর যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন।

যিয়ারত হলো মূলত সেইসব নেককার মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা আল্লাহর কাছে যাঁরা সম্মানিত এবং মর্যাদাবান। এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের প্রতি সম্মান দেখানো, তাদেঁর মাযারের যারিহ বা লোহার বেষ্টনীতে চুম্বন করা, তাদেঁর হারামে দোয়া করা, নামায পড়া ইত্যাদি সবই আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করা বা তাঁর নৈকট্য অর্জন করার লক্ষ্যেই করা হয়ে থাকে, আল্লাহর সাথে শরিক করার জন্যে নয়। যেহেতু রাসূলে খোদা (সা), তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের অবস্থান আল্লাহর দরবারে খুবই ঘনিষ্ট সেজন্যে মুসলমানরা তাদেঁর কবর যিয়ারত করার জন্যে বেশি আগ্রহী। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা আমিনী তাঁর "সিরাতানা ওয়া সুন্নাতান" নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ "মদিনা মুনাওয়ারা যে আল্লাহর কাছে সম্মানিত হারাম হিসেবে পরিগণিত এবং সুন্নাতে নববীতেও মদিনা শরিফ, সেখানকার মাটি এবং বাসিন্দারা এমনকি সেখানে যাদেঁরকে দাফন করা হয়েছে তাঁদেরকে অনেক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন বলে মূল্যায়ন করা হয়, সেটা নবীজী এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের কারণে। একইভাবে নবীজী, আল্লাহর আউলিয়া এবং অসিদের সাথে কিংবা সিদ্দিকিন, শুহাদাসহ খাটিঁ মুমিনদের সাথে সম্পর্কের কারণেও সম্মান ও মর্যাদা বাড়ে।"

আসলে যিয়ারত মানে কেবল মাযারের ইট পাথর যারিহ গম্বুজ তথা বাহ্যিক দিকটাই নয়-যেমনটি ওহাবিরা মনে করে-বরং যিয়ারতের মধ্যে রয়েছে গোপন শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আধ্যাত্মিকতা তথা আল্লাহর প্রতি ইমানের গভীরতা ইত্যাদি। যে তার প্রিয়জনকে হারায় বিভিন্ন কারণে তাকে ভুলতে পারে না,তাই বিচিত্র অনুষ্ঠানে তাকে স্মরণ করে এবং তার মাযারে হাজির হয়। প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথায় কান্নাকাটি করা মানুষের মধ্যকার সাধারণ একটি রীতি যেই প্রবণতাটি মানুষের প্রকৃতিগত বা স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। সহিহ বোখারি শরিফের সংকলক বোখারি (রহ) লিখেছেনঃ "নবী (সা) এক মহিলাকে একটি কবরের পাশে দেখলেন কান্নাকাটি করছে। তিনি মহিলাকে বললেনঃ "বিরত থাকো এবং প্রিয়জনের দূরত্বে ধৈর্যধারণ করো।" নবীজী বলেন নি তুমি যা করছো তা হারাম, বরং তিনি ঐ মহিলাকে সুস্পষ্টভাবে ধৈর্য ধরার আদেশ দিয়েছেন, যিয়ারত করা থেকে দূরে থাকতে বলেন নি, অথচ সালাফিয়ারা মহিলাদের যিয়ারত করাকে হারাম ঘোষণা করেছে।

 
হযরত আলি (আ) থেকে বর্ণিত আছেঃ নবী করিম (সা) কে যখন দাফন করা হলো, ফাতেমা (সা) তখন তাঁর কবরের পাশে দাঁড়ালেন এবং কবরের সামান্য একটু মাটি নিয়ে চেহারায় মাখলেন আর কান্নাকাটি করতে করতে দুটি পংক্তি আবৃত্তি করলেন। পংক্তি দুটির বঙ্গানুবাদ এরকমঃ

আহমাদের কবরের মাটি শুঁকবে যে একবার
প্রয়োজন নেই জীবনে তার দামি সুগন্ধি নেয়ার
মস্ত বিপদ এসে ভর করেছে আমার পর
উজ্জ্বল দিনও যেন হয়ে যায় রাতের আঁধার॥

আল্লাহ তায়ালা যাকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন তাঁর প্রতি সম্মান দেখানোটা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকেও যুক্তিযুক্ত এবং পূণ্যময়, আর যিয়ারত করা এক ধরনের সম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর মাত্র। আল্লামা মাহদি নারকি তাঁর "জামেউস সাআদাত" নামক গ্রন্থে যিয়ারত সম্পর্কে লিখেছেনঃ"জেনে রাখো,পয়গাম্বরগণ কিংবা ইমামদের রুহ মোবারক মৃত্যুর পরও...পার্থিব জগতের ওপর সক্রিয় থাকে। পার্থিব এই জগতের বিষয় আশয় এই পবিত্র আত্মাগুলোর কাছে সুস্পষ্টভাবেই প্রকাশ্য...তাঁরা আল্লাহর দেওয়া অনুগ্রহে খুশি,যাঁরা তাদেঁর কবর যিয়ারত করতে আসেন বা তাদেঁর কবরে উপস্থিত হন সবার ব্যাপারেই অবহিত। যিয়ারতকারীগণের প্রশ্ন, তাদেঁর তাওয়াসসুল, অনুনয়-বিনয়,তাদের শাফায়াতের আবেদন ইত্যাদি শুনতে পান। পবিত্র এইসব রূহের সহৃদয় দয়ার মৃদুমন্দ যিয়ারতকারীদের ওপর প্রবাহিত হয় এবং তাদেঁর নূর যিয়ারতকারীদের ওপর বিকীর্ণ হয়। পবিত্র এই আত্মাগুলো যিয়ারতকারীদের চাওয়া পাওয়া, তাদের পাপ ক্ষমা করা, বিপদ-মুসিবত দূর করার ব্যাপারে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। নবী আকরাম (সা) কিংবা পবিত্র ইমামগণের মাযার যিয়ারতকে মুস্তাহাব বলে অনুমোদন করার এটাই হলো মূল রহস্য।"

 
কোরআনও কবর যিয়ারতকারীদেরকে তো কাফের বলেই নি বরং পরোক্ষভাবে যিয়ারত করাকে অনুমোদন করেছে। সূরা তাওবার ৮৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজীকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ "কক্ষণো কোনো মুনাফিকের নামাযে জানাযা পড়বেন না কিংবা কক্ষণো তাদের কবরের পাশে দাড়িয়েঁ ক্ষমার আবেদন জানিয়ে দোয়া করবেন না! কেননা তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং ফাসেক অবস্থায় মারা গেছে।" এ আয়াত থেকে বোঝা যায় নবীজী মুমিনদের মাযারের পাশে দাড়িয়েঁ তাদের ক্ষমার জন্যে দোয়া করতেন। অবশ্য মুনাফিকরা এই অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, কেবলমাত্র মুমিনরাই নবীজীর এই দোয়ার বরকত লাভে ধন্য হয়েছে। এইসব বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় কবর যিয়ারত করাটা কেবল বৈধই নয় বরং নবীজীর একটি সুন্নাতও বটে।

সালাফিয়া মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তাইমিয়া বুযুর্গানে দ্বীনের কবর যিয়ারত করাকে "কবর পূজা" বলে অভিহিত করে এটাকে জাহেলিয়াতের যুগের মূর্তি পূজার সাথে তুলনা করেছেন।দ্বাদশ শতাব্দিতে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাব -আলে সৌদের সহযোগিতায় ইবনে তাইমিয়ার আকিদা বিস্তার ঘটিয়েছেন-যিয়ারতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং হারাম শরিফ, কবর ও অন্যান্য পবিত্র স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলেন। তার আকিদার বিরোধীদের তিনি কাফের ঘোষণা করেন এবং তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব বলে রায় দেন। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাবের ভাই সোলাইমান সমকালীন বিখ্যাত একজন আলেম ছিলেন। তিনি তাঁর ভাইয়ের আকিদাকে প্রত্যাখ্যান করে বহু চিঠি এবং বই লেখেন। সাওয়ায়েকুল ইলাহিয়া" নামক বইতে তিনি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাবকে লিখেছেনঃ "প্রত্যেক মাযহাবের আলেমগণই একজন মুসলমানের মুরতাদ হবার কারণগুলো উল্লেখ করেছেন। তাদেঁর কেউই বলেন নি যে-কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্যে মানত করবে কিংবা অন্য কারো কাছে প্রয়োজনীয়তার কথা বলবে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। কারো কবর স্পর্শ করা, কিংবা কবরের মাটি নেওয়া ইত্যাদিদ কাজ করলে মুরতাদ হয়ে যাবে কিংবা তাকে হত্যা করা ওয়াজিব হয়ে যাবে-এরকম কোনো হুকুম কেউই দেন নি। তুমি তোমার নিজস্ব চিন্তাধারা অনুযায়ী কাজ করে মুসলমানদের এজমা থেকে পৃথক হয়ে গেছো বিশেষ করে কবর স্পর্শ করা, কিংবা কবরের মাটি নেওয়ার কাজ করলে তাকে কাফের ফতোয়া দিয়ে এমনকি যে তাকে কাফের বলবে না তাকেও কাফের বলে প্রকারান্তরে সমস্ত উম্মাতে মুহাম্মাদ (সা) কেই কাফের বলে সাব্যস্ত করেছো। অথচ সাত শ' বছরেরও বেশি সময় ধরে সমগ্র মুসলিম ভূখণ্ডেই এইসব আমল হয়ে আসছে, কিন্তু কোনো আলেম কাউকে এজন্যে কাফের বা মুরতাদ বলে ফতোয়া দেয় নি।.." 

যিয়ারতের উদ্দেশ্য বস্তুজাগতিক গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আধ্যাত্মিকতার জগতে প্রবেশ করা এবং এক আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সালাফিরা মরহুম শহিদান, নেককার ও সালেহ বান্দাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারীকে মুশরিক বলে অভিহিত করে তাদের হত্যা করাকে ওয়াজিব বলে ঘোষণা করেছে। যদিও বুযুর্গানে দ্বীনের কবর যিয়ারত করাটা মুসলমানদের জন্যে গর্ব এবং আন্তরিক প্রশান্তির কারণ। আল্লাহর সবাইকে শুভবুদ্ধি দিন।

সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন