ওহাবি মতবাদঃ ২২ তম পর্ব

ওহাবি মতবাদঃ ২২ তম পর্ব
পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে এসেছে নবী করিম (সা) নিজেও বান্দাদের প্রতি দয়া ও মহানুভবতা প্রকাশ করেন। সূরা তাওবার ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ"আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তার প্রতি যদি তারা সন্তুষ্ট থাকতো,এবং যদি বলতো আল্লাহ আমাদের জন্যে যথেষ্ট,শীঘ্রই আল্লাহ এবং তার পয়গাম্বর তাদেঁর অনুগ্রহ আমাদের প্রতি আরো দান করবেন এবং আমরা আল্লাহর প্রতি আগ্রহী হয়ে রইলাম, তবে তাদের জন্যে তা অবশ্যই উত্তম হতো।"এখানে স্বয়ং কোরআনই রাসূলে খোদা (সা)কে দয়ালু এবং দাতা হিসেবে পরিচয় করেছেন। তাহলে আমরা কেন তাঁর কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করবো না কিংবা তাঁর মহান অবস্থান ও মর্যাদার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করবো না?
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা নিসা'র ৬৪ নম্বর আয়াতে নবীজীর শাফায়াত লাভ করা এবং তার প্রতি তাওয়াসসুল করার জন্যে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং নবীজীকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ "যদি তারা স্বীয় জীবনের ওপর অত্যাচার করার পর তোমার নিকট আগমন করতো, তারপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতো, আর রাসূলও তাদের জন্যে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতেন, তবে নিশ্চয়ই তারা আল্লাহকে তওবা কবুলকারী এবং করুণাময় হিসেবেই পেতো।"

ওহাবিরা তাওয়াসসুলকে রদ বা প্রত্যাখ্যান করার দলিল হিসেবে কোরআনের বহু আয়াত উদ্ধৃত করেছেন। যেমন সূরা ফাতিরের চৌদ্দ নম্বর আয়াত,যেখানে বলা হয়েছেঃ "তোমরা তাদেরকে আহ্বান করলে তারা তোমাদের আহ্বান শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের আহ্বানে সাড়া দেবে না,তোমরা তাদেরকে যে শরিক করেছো তা তারা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞানী,সর্ববিষয়ে সচেতন আল্লাহ ছাড়া আর কেউই তোমাকে সত্যাসত্যের ব্যাপারে অবহিত করতে পারে না।" এই সূরাতে মূর্তি পূজকদের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি আয়াত এসেছে, এসব আয়াতেও মূর্তি পূজা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা মূর্তিগুলো না তাদের পূজাকারীদের চাহিদা বা প্রার্থনাগুলো শুনতে পায়, কিংবা শুনতে পেলেও না তারা তাদের পূজকদের কোনো সমস্যা নিরসণ করার শক্তি রাখে, না এই সৃষ্টি জগতের ওপর তাদের বিন্দুমাত্র ক্ষমতা আছে। কিন্তু ওহাবিদের একদল নবীজী এবং আল্লাহর আরো অনেক মহান বান্দার সাথে মানুষের তাওয়াসসুল করাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে এই আয়াতসহ এরকম আরো কিছু কিছু আয়াত উদ্ধৃত করে বলেনঃ কোরআন বলছে, আল্লাহ ছাড়া আর যাকেই ডাকো না কেন-এমনকি পয়গাম্বরকেও-তারা তোমাদের কথা শোনে না, কিংবা শুনলেও তা মঞ্জুর করতে পারে না।

ওহাবিরা সূরা আরাফের ১৯৭ নম্বর আয়াতেরও উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে। যেখানে বলা হয়েছেঃ "আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদেরকে ডাকো, তারা তোমাদের সাহায্য করার কোনো ক্ষমতা রাখে না, এমনকি তারা নিজেদেরকেও সাহায্য করতে পারে না।" এ ধরনের আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে সালাফিরা নবীজী কিংবা ইমামদের রুহের ওপর তাওয়াসসুল করাকে তৌহিদের বিরোধিতা বলে মনে করে। অথচ এসব আয়াতের প্রতি একটু মনোযোগ দিলেই দেখা যাবে আয়াতগুলোতে মূর্তির কথা বলা হয়েছে, যেসব মূর্তি কাঠ পাথরের তৈরি এবং সেগুলোকে তাদের পূজকরা আল্লাহর সাথে শরিক করেছিল,যাদের প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বরাবরে বিন্দুমাত্র শক্তিও নেই।

এ কথা কে না জানে যে, নবী-রাসূল, অলি-আওলিয়া, আল্লাহর পথে শহীদগণকে পবিত্র কোরআন সুস্পষ্টভাবে জীবিত বলে উল্লেখ করেছে! তাঁরা বারযাখি জীবনের অধিকারী। আর বারজাখি জীবনে রুহ বা আত্মার তৎপরতা অনেক বেশি বিস্তৃত কেননা পার্থিব জগতের বস্তুতান্ত্রিক সম্পর্ক থেকে আত্মাগুলো পুরোপুরি মুক্তি লাভ করেছে। অপরদিকে নিঃসন্দেহে পবিত্র আত্মার প্রতি তাওয়াসসুল করার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর সামনে তাদের স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে প্রতিস্থাপন করা, বরং আল্লাহর কাছে তাদেঁর যে সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে বা আল্লাহর কাছে তাদের যে ঘনিষ্ট অবস্থান রয়েছে তাকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করা। তবে হ্যাঁ! কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউই শাফায়াতের আবেদন করবেন না। ঠিক সেভাবেই বিশ্ব প্রতিপালকের অনুমতি ছাড়া কারো প্রতি তাওয়াসসুল করার বিষয়টিও সংঘটিত হবে না। এ কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজীর মাধ্যমে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছেনঃ "মনে রেখো! যাদের চাহিদা বা অভাব অভিযোগ আছে, কিংবা কোনোরকম দুরবস্থায় পড়ে এখন তা থেকে মুক্তি আশা করছে, তাদের উচিত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পবিত্র আহলের মাধ্যমে আমাকে ডাকা,যাতে সবোর্ত্তম উপায়ে তাদের চাহিদাগুলো মেটানো যায়।"

এ কারণেই নবীজীর সাহাবায়ে কেরাম এবং অন্যান্য বুযুর্গানে দ্বীনের জীবনীতে লক্ষ্য করা যাবে, যে কোনো সমস্যায় পড়লে তাঁরা রাসূলে খোদার কবরের পাশে গিয়ে তাওয়াসসুল করতেন এবং রাসূলের পবিত্র আত্মার মাধ্যমে পরোয়ারদেগার আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। এ সম্পর্কে শিয়া এবং সুন্নিদের নির্ভরযোগ্য বহু গ্রন্থে অনেক বর্ণনা রয়েছে। রাসূলে খোদা (সা) এর স্ত্রী হযরত আয়েশার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বর্ণনা রয়েছে। দারমি'র লেখা 'সহিহ' গ্রন্থে আবুল জাওযা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, এক বছর মদিনায় প্রচণ্ড খরা দেখা দিয়েছিল। আয়েশা তখন জনগণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা যেন এই খরা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে পয়গাম্বরের প্রতি মুতাওয়াসসিল হয়। জনগণ তা-ই করে এবং সেই বছর ব্যাপক বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল।

সহিহ বোখারিতে এসেছে,দ্বিতীয় খলিফা খরা এবং দুর্ভিক্ষের সময় নবীজীর চাচা আব্বাসের প্রতি তাওয়াসসুল করে বলেছিলেনঃ"হে আল্লাহ! রাসূলে খোদার জীবিতাবস্থায় আমরা খরার কবলে পড়লে তাঁর প্রতি তাওয়াসসুল করতাম আর রহমতের বৃষ্টি নাযিল হতো। এখন তাঁর চাচাকে আমরা বৃষ্টির জন্যে আবেদনের ওসিলা করেছি। হে আল্লাহ আমাদেরকে তুমি পানিতে পরিপূর্ণ করে দাও!" বোখারি লিখেছেন, এই তাওয়াসসুলের পর বৃষ্টি নাযিল হয়েছিল। বিশিষ্ট মুফাসসির আলূসিও তাঁর বইয়ের বহু অংশে তাওয়াসসুল সংক্রান্ত অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর সেইসব বর্ণনার সারসংক্ষেপ হলো রাসূলে খোদার প্রতি তাওয়াসসুল করার মাঝে কোনো বাধা নেই-না তাঁর জীবিতাবস্থায় কিংবা রেহলাতের পর। নবীজী ছাড়া অন্যদের প্রতিও তাওয়াসসুল করার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই, তবে শর্ত হলো আল্লাহর দরবারে সত্যিকার অর্থেই তাঁর মর্যাদা থাকতে হবে।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন