ওহাবি মতবাদঃ ১৫তম পর্ব
ওহাবি মতবাদঃ ১৫তম পর্ব
আল্লাহ সম্পর্কে নাহজুল বালাগায় ইমাম আলী (আ) এর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এসেছে এভাবেঃ "..কোরআনে তৌহিদ সম্পর্কে এসেছে: 'কোনো কিছুই তাঁর মতো নয়'। ফলে তাঁর সাথে কোনো কিছুর তুলনা দেওয়াটা ভুল এবং আল্লাহর বাইরে চিন্তার শামিল। যে-ই আল্লাহকে কোনো কিছুর মতো ভাবে সে লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারলো না। যদি একান্ত প্রয়োজনে তুলনা দিতে হয় সেটা তো আল্লাহর বান্দার দেওয়া বর্ণনা হলো,আল্লাহর নিজের নয়। কেননা তিনি কোনো কিছুর সাথেই তুলনীয় নন। তাই যারা আল্লাহকে কোনো কিছুর সাথে তুলনা করলো তারা তো আল্লাহকে চেনার পথে অগ্রসর না হয়ে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে গেল এবং আল্লাহকে উপলব্ধি করতে পারলো না।"
বিশিষ্ট মনীষী ও ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম গাযযালি (রহ) বলেছেনঃ 'কেউ যদি মনে মনে ভাবে আল্লাহর একটি দৈহিক অবয়ব রয়েছে যা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে গঠিত,তাহলে সে মূর্তি পূজক হয়ে যাবে কেননা প্রতিটি দেহই সৃষ্টি করা হয়েছে বা বানানো হয়েছে। আর সর্বকালের সর্বযুগের সকল আলেম ওলামা বা ধর্মীয় মনীষীই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে সৃষ্টির পূজা করা কুফুরি এবং মূর্তি পূজার শামিল।' কুরতাবি আরেকজন বিখ্যাত আলেমে দ্বীন। যারা আল্লাহর দৈহিক সত্ত্বায় বিশ্বাস করে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেনঃ 'প্রকৃত সত্য কথাটি হলো আল্লাহ তায়ালার দৈহিক সত্ত্বার প্রবক্তা বা এই মতে বিশ্বাসীদের সবাই কাফের। কেননা মূর্তি পূজক আর ব্যক্তি পূজারিদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।'
ইসলামের ইতিহাসবিদ এবং বহু আলেম মনে করেন ইবনে তাইমিয়াসহ কোনো কোনো মুসলমানের চিন্তায় আল্লাহর দেহতত্ত্বটা প্রবেশ করেছে ইহুদি ধর্ম থেকে। শাহরেস্তানি তাঁর 'মেলাল ও নাহল' গ্রন্থে লিখেছেনঃ "যেসব ইহুদি দৃশ্যত মুসলমান হয়েছিল তারা আল্লাহ তায়ালার দৈহিক সত্ত্বা সংক্রান্ত অসংখ্য হাদিস তৈরি করেছিল এবং সেগুলোকে ইসলামী শরিয়তে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল। এ সংক্রান্ত সকল হাদিসেরই উৎস হলো তৌরাত।" ইবনে খালদুন আরেকজন বিখ্যাত মুসলমান ইতিহাসবিদ। তিনিও বলেছেনঃ ইসলামের আবির্ভাবস্থল আরব বই-পুস্তক কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিল না। তারা সৃষ্টি রহস্য এবং বিশ্বের সৃষ্টিকূল সংক্রান্ত রহস্য উদঘাটনের জন্যে ইহুদি আলেম ওলামা, আহলে তৌরাত এবং নাসারাদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন।" অনেক নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থেও তৌরাত এবং ইহুদি উৎস থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। যাই হোক, আসরের এ পর্যায়ে আমরা ওহাবিদের আরেকটি বিশ্বাস নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। এই আকিদাটির নাম হচ্ছে 'শাফায়াত'। ইবনে তাইমিয়া এই আকিদার প্রবক্তা, আর তাঁর অনুসারী মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব এ সম্পর্কে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন।
'শাফায়াত' শব্দটির সাথে আমাদের সবারই কমবেশি পরিচয় রয়েছে। যখনই কারো অপরাধ, গুনাহ কিংবা শাস্তির প্রসঙ্গ ওঠে এবং কেউ মাঝখানে এসে তাকে শাস্তি থেকে মুক্তি দেয়,তখনই বলা হয় অমুক তার পক্ষে 'শাফায়াত' করেছে। শাফায়াতের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে মধ্যস্থতাকারী হওয়া কিংবা কোনো মানুষের কল্যাণে কাজ করা। শরিয়তের পরিভাষায় শাফায়াত হচ্ছে আল্লাহর কোনো অলি-আওলিয়া আল্লাহর কাছে অন্য কোনো মানুষের জন্যে মুক্তি বা ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া। তিনি আল্লাহর কাছে ঐ ব্যক্তির গুনাহগুলো ক্ষমা করার জন্যে কিংবা তার শাস্তি হ্রাস করার জন্যে আবেদন জানাবেন। ওহাবিদের সাথে ইসলামের অন্যান্য মাযহাবের মতপার্থক্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো এই 'শাফায়াত'। ওহাবিরা অবশ্য এক ধরনের শাফায়াতকে ইসলামের একটি মূলনীতি হিসেবে মেনে নিয়েছে, তবে তারা বলে ঐ শাফায়াত একান্তই কিয়ামতের দিনের জন্যে নির্দিষ্ট। সেদিন গুনাহগার উম্মাতের জন্যে শাফায়াতকারীগণ আল্লাহর কাছে শাফায়াত করবেন। শাফায়াতের ক্ষেত্রে ইসলামের নবীর অংশ অনেক বেশি থাকবে। কিন্তু তাদের মূল যে বক্তব্য তাহলো মুসলমানদের কোনোরকম অধিকার নেই এই পৃথিবীতে কোনো নবী কিংবা আল্লাহর কোনো অলি-আওলিয়ার কাছে শাফায়াত প্রার্থনা করা। যদিও নবীজীর কাছ থেকে কিংবা আল্লাহর অন্যান্য আওলিয়ার কাছে শাফায়াত চাওয়ার প্রচলন সেই নবীজীর জীবিত থাকাকালেই মুসলমানদের মাঝে চলে আসছে। মুসলিম কোনো জ্ঞানী-গুণী মনীষীই উপযুক্ত বান্দাদের কাছে শাফায়াতের আবেদন করাকে প্রত্যাখ্যান করে নি। তবে হিজরী অষ্টম শতাব্দির শুরু থেকে ইবনে তাইমিয়া এবং পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব নজদি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে শাফায়াত চাওয়াকে নিষেধ এবং হারাম ঘোষণা করেন এবং যথারীতি তাদের ঐ দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতাকারীদেরকে কাফের ও নাস্তিক বলে অভিহিত করেন।
এই দুইজন বিশ্বাস করেনঃ যে শাফায়াত নবীগণ, ফেরেশতাগণ এবং আল্লাহর অলিগণ করবেন তা একান্তই আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত, পৃথিবীর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে কোনো বান্দা যদি নিজের লক্ষ্য অর্জন করা অর্থাৎ নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে আল্লাহ এবং তার মাঝে তৃতীয় কোনো মাধ্যমকে শাফায়াতের জন্যে অবলম্বন করে,তা শির্ক হিসেবে গণ্য হবে এবং তা হবে আল্লাহর বাইরে অন্য কারো বন্দেগি করার শামিল। অথচ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সকল বান্দারই উচিত কেবল সরাসরি আল্লাহর কাছেই তার চাওয়া পাওয়ার কথা এভাবে বলাঃ "হে আল্লাহ! আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করো, যাদেরকে তুমি মুহাম্মাদ (সা) এর শাফায়াত ধন্য করেছো!" এভাবে বলা ঠিক নয়ঃ "হে মুহাম্মাদ! আমার জন্যে তোমার খোদার কাছে শাফায়াত করো!"
সালাফিয়ারা এবং মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের অনুসারীরা শাফায়াত নিয়ে মহা ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। এখনো ওহাবিরা শাফায়াত সম্পর্কে ব্যাপক হৈ চৈ করছে এবং শাফায়াতের প্রবক্তাদের উদ্দেশ্যে বিশ্রী শব্দ এবং ভাষা ব্যবহার করছে। অলি আওলিয়াদের কাছ থেকে শাফায়াত প্রার্থনা করতে নিষেধ করেছে তারা। এর পেছনে কিছু কারণ অবশ্য তারা তুলে ধরেছে।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন