ওহাবি মতবাদঃ ১৩তম পর্ব
ওহাবি মতবাদঃ ১৩তম পর্ব
সালাফিয়া আকিদায় বিশ্বাসীদের আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি হলো তারা মনে করে কেবলা হচ্ছে আল্লাহর সশরীরী উপস্থিতির স্থান। নামায পড়ার সময় এভাবেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল মুসল্লির সামনে উপস্থিত থাকেন বলে তাদের বিশ্বাস। তাদের বক্তব্য হলো, কোনো নামাযির উচিত নয় কেবলার দিকে থুথু নিক্ষেপ করা কেননা আল্লাহ তায়ালা তার সামনে উপস্থিত রয়েছেন এবং এই কাজ করার ফলে আল্লাহ বিরক্ত এবং মনোক্ষুন্ন হতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে কেবলার দিকে মুখ করে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য হলো নামাযের সময় সকল নামাযি ও মুমিনের মনোযোগ এক ও অভিন্নমুখী করা, কেবলামুখি হয়ে দাঁড়ানোর মানে এই নয় যে আল্লাহ ঐদিকে রয়েছেন। বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ সবখানেই রয়েছেন এবং সকল বিষয়ে তিনি সচেতন। যেমনটি কোরআনে বলা হয়েছেঃ অহুয়া লিকুল্লি শায়্যিন আলিম।
আল্লাহ এমন এক সত্ত্বা যিনি অসীম এবং অপার, সবকিছুর ওপরই তিনি প্রাজ্ঞ এবং সচেতন। আল্লাহর জন্যে যদি নির্দিষ্ট স্থান কিংবা কালের বৃত্ত তৈরি করা হয় তাহলে একদিকে যেমন তাঁকে নির্ভরশীল করে ফেলা হয় তেমনি তাঁকে বৃত্তাবদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। অপরদিকে ওহাবিদের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট স্থান এবং কালের মাঝে আল্লাহকে আবদ্ধ করে ফেলার মানে দাঁড়ায়, নির্দিষ্ট স্থান এবং কালের বাইরে অনির্দিষ্ট অসীম স্থান ও কালের মাঝে আল্লাহর উপস্থিতি নেই, আর এ বিষয়টি প্রকারান্তরে আল্লাহর দুর্বলতা বা অসম্পূর্ণতারই পরিচায়ক। অথচ প্রকৃত সত্য হলো বিশ্ব প্রতিপালক অনন্ত, অসীম এক সত্ত্বা। তাঁর মাঝে কোনো অপূর্ণতা কিংবা অক্ষমতা বলে কিছু নেই।
ইবনে তাইমিয়া বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ সম্পর্কে আরো বিভিন্ন রকম বর্ণনা দিয়েছেন। এসব বর্ণনায় অনেক ক্ষেত্রেই আল্লাহর মহান মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কোরআনই সুস্পষ্ট প্রমাণ যে কিনা প্রকৃত সত্যকে চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমানদের সামনে তুলে ধরে। সূরা শুরার ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "কোনো কিছুই তাঁর মতো নয়....।" কোরআনে কারিমের মুফাসসির এবং বিশিষ্ট শিয়া আলেম আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাযি এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন- "মূলতঃ এ আয়াতটি আল্লাহর সকল গুণাবলির সাথে পরিচিত হবার মৌলিক ভিত্তি। এই আয়াতের দিকে না তাকিয়ে বা এর মর্মার্থ উপলব্ধি না করে আল্লাহর গুণাবলির কোনোটাই বোঝা যাবে না। কেননা আল্লাহকে চেনার দুর্গম পথের যাত্রীদের জন্যে আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা দেওয়াটাই হচ্ছে সবচেয়ে নাজুক রসাতল-যেখান থেকে যে-কোনো মুহূর্তে তার পতন ঘটতে পারে সোজা শের্কের জাহান্নামে।
অন্যভাবে বলা যায়, আল্লাহর অস্তিত্ব এমন বা তিনি এমন এক সত্ত্বা, যে-কোনো দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁর ক্ষেত্রে অপূর্ণ। তাঁর অসীম সত্ত্বাকে কোনো সীমিত দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধিই করা যাবে না। যেমন কোনো কোনো কাজ আছে আমাদের জন্যে সহজ, আবার কোনো কোনোটা কঠিন। কোনো কোনো বস্তু আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে আবার কোনো কোনো বস্তু আমাদের কাছে...কেননা আমাদের অস্তিত্বই সীমিত...কিন্তু যেই সত্ত্বার অস্তিত্ব যে-কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অসীম এবং চিরন্তন, তা অনুভবযোগ্য নয়। ইমাম আলী (আ) নিজেও নাহজুল বালাগায় আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে বহুবার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিতে আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতাটা এমন যে,ছোটো-বড়ো, ভারি-হালকা, শক্তিশালী-দুর্বল ইত্যাদি সকল সৃষ্টিই আল্লাহর শক্তিমত্তার কাছে সমান। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ইবনে হাজার মাক্কি তাঁর 'আলফাতাভি-আল-হাদিসা' নামক গ্রন্থে ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে লিখেছেনঃ 'খোদা তাকে অন্ধ, বধির, গোমরাহ, হীন এবং অপদস্থ করে দিয়েছেন। তার সমকালীন আহলে সুন্নাতের ফকিহ ইমামগণ যেমন ইমাম শাফেয়ী (রহ), ইমাম মালেক (রহ), ইমাম আবু হানিফা (রহ) এর অনুসারী ফকিহগণ তার চিন্তা-চেতনা এবং কথাবার্তা বলেছেন...ইবনে তাইমিয়ার কথাবার্তা মূল্যহীন এবং সে বেদায়াত সৃষ্টিকারী, গোমরাহ ও ভারসাম্যহীন। আল্লাহ তায়ালা তার সাথে যথার্থ আচরণ করুন এবং আমাদেরকে তার আকিদা-বিশ্বাসের পাপ আর তার পথ ও পদ্ধতি থেকে রক্ষা করুন।"
ইবনে তাইমিয়া তার 'মিনহাজুস সুন্নাহ' এবং 'আলআকিদাতুল হামাভিয়া' নামক গ্রন্থে তৌহিদ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। তিনি আল্লাহর গুণাবলির মধ্যে 'দৌড়ানো'কেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন,আল্লাহ তায়ালা মুমিন বান্দাদের নিকটবর্তী হবার জন্যে তাদেঁর দিকে দৌড়ে যান। তাঁর এ বিশ্বাসের পক্ষে তিনি একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। হাদিসটি হলো, নবী করিম (সা) বলেছেনঃ 'আল্লাহ পাক বলেন যদি কোনো বান্দা আমার দিকে এক বিঘৎ পরিমাণ অগ্রসর হয়,আমি তার দিকে আধা মিটার এগিয়ে যাবো। আর সে যদি আধা মিটার অগ্রসর হয় আমি এক মিটারেরও বেশি কাছে এগিয়ে যাবো। আর যদি বান্দা হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসে আমি দৌড়ে দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে যাবো।"
ইবনে তাইমিয়া বান্দার দিকে আল্লাহর এই দৌড়ানোকে দৈহিক দৌড় বলেই মনে করেন। এতে করে হাদিসে মূল বক্তব্যই আড়ালে থেকে যায়। এই হাদিসে আসলে বান্দাদের কাছে আল্লাহর আধ্যাত্মিক, আত্মিক এবং মানসিক নৈকট্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে মূল যে বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তাহলো যারা আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে চায় আল্লাহ তাদেরকে অগ্রসর হতে সাহায্য করেন। আল্লাহর প্রতি ভক্তি বা তাঁর ইবাদাতের ব্যাপারে যে যতো বেশি আগ্রহী হবে তার প্রতি আল্লাহর মনোযোগও দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। মূল্যবান এই হাদিসটি থেকে ইবনে তাইমিয়ার উপলব্ধি পুনরায় প্রমাণ করে তিনি এবং সালাফিয়াগণ আল্লাহকে মানুষের মতোই মনে করেন,কেননা দৌড়ানোর বিষয়টি দৈহিক গুণাবলির সাথেই সংশ্লিষ্ট।সৌদি আরবের ফতোয়া বিষয়ক উচ্চ পরিষদও আল্লাহর দৌড়ানোকে বিবেচনাযোগ্য বলে মনে করে। সৌদি আরবের বিখ্যাত মুফতি আব্দুল আযিয বিন আযও ফতোয়া বিষয়ক এক বক্তব্যে বলেছেনঃ 'আল-কোরআন এবং সুন্নাহ'তে স্পষ্টভাবেই আল্লাহর চেহারা, হাত, চোখ, আঙ্গুল এবং পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশের বর্ণনা এসেছে। আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিভঙ্গি এই বিশ্বাসের ওপরই প্রতিষ্ঠিত...নবী করিম (সা) আল্লাহর এই গুণাবলিকে যথার্থ মর্যাদার সাথে প্রমাণ করেছেন।'
অবশ্য সালাফিয়ারা সবসময়ই তাদের ভ্রান্ত কথাবার্তাগুলোকে নবীজীর হাদিস এমনকি কোরআনের আয়াত বলে উদ্ধৃত করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। অথচ কোরআনের কোত্থাও কিংবা রাসূলে আকরাম (সা) এর নির্ভরযোগ্য বক্তব্যের কোনো জায়গায় আল্লাহর দৌড়ানোর ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত নেই। এমনকি রাসূলে খোদার বক্তব্য আল্লাহর মানবীয় এইসব গুনাবলি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন