ওহাবি মতবাদঃ ১২তম পর্ব

ওহাবি মতবাদঃ ১২তম পর্ব
আরোহন অবরোহন, আকাশে সঞ্চরণ এবং বিভিন্ন ধরনের কুরসিতে উপবেশন ইত্যাদি কাজ আল্লাহ করেন বলে একক এবং অদ্বিতীয় সত্ত্বা আল্লাহ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার চিন্তা। 'মিনহাজুস সুন্নাহ' নামক গ্রন্থে ইবনে তাইমিয়া লিখেছেনঃ "আল্লাহ পাক প্রতি রাতে পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং আরাফার রাত্রিতে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি আসেন যাতে খুব নিকট থেকে তাঁর বান্দাদের দোয়া কবুল করতে পারেন। পৃথিবীর আকাশে এসে আল্লাহ তায়ালা আহ্বান জানানঃ আমাকে ডাকার মতো স্মরণ করার মতো কেউ কি আছো যার দোয়া আমি কবুল করবো!"
সালাফিয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী আকাশের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর অনেক কুরসি রয়েছে। ইবনে তাইমিয়ার ছাত্র ইবনে কাইয়্যেম জুযি 'মাজমুউল ফাতাভি' নামক বইতে তার শিক্ষকের বরাত দিয়ে লিখেছেনঃ
"আল্লাহর জন্যে প্রত্যেক আকাশে একটি করে কুরসি রয়েছে। যখন পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ হন তখন এই আকাশের জন্যে নির্দিষ্ট কুরসিতে বসেন এবং বলেনঃ 'কোনো তওবাকারী কি আছে যাকে মাফ করে দেবো...' সকাল পর্যন্ত সেই কুরসিতে থাকেন এবং সকাল হয়ে গেলে পৃথিবীর আকাশের কুরসি ত্যাগ করে উর্ধ্বাকাশে চলে যান এবং অন্য কুরসিতে বসেন।'
মরক্কোর বিশিষ্ট ভূপর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে এ সম্পর্কে সালাফিয়াদের নেতার একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেনঃ দামেশকের জামে মসজিদে ইবনে তাইমিয়ার সাথে দেখা। ইবনে তাইমিয়া জনগণকে ওয়াজ নসিহত করে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলছিলেনঃ "আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন যেমনিভাবে আমি এখন অবতরণ করছি"। এই বলে তিনি মিম্বার থেকে একটি সিড়িঁ নিচে নামলেন। ঐ মজলিসে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ফিকাহশাস্ত্রবিদ মালেকির ছেলে ইবনে যাহরা। তিনি ইবনে তাইমিয়ার ঐ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। কিন্তু মিম্বারের পায়া ঘেঁষে যারা বসে ছিল সেইসব সহজ সরল লোকজন ইবনে তাইমিয়ার কথা বিশ্বাস করলো এবং উঠে দাঁড়িয়ে ইবনে যাহরাকে ভর্ৎসনা করলো। ইবনে যাহরা হাম্বলি মাযহাবের অনুসারী কাজির দরবারে গিয়েও নাজেহাল হলো। কিন্তু হাম্বলি কাজির এই ঘটনায় দামেশকের মালেকি এবং শাফেয়ি কাজিদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত শাসককে অবহিত করা হয় এবং তিনি ইবনে তাইমিয়াকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।"
ইবনে তাইমিয়া আসলে আল্লাহকে সঞ্চরণশীল বলে বিশ্বপ্রতিপালককে বস্তজাগতিক সৃষ্টির মতোই নির্ভরশীল করে তুলেছেন। সেজন্যেই বান্দাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্যে আল্লাহর আরোহন অবরোহনের প্রয়োজন পড়ে। এইসব বৈশিষ্ট্য আসলে বস্তুজগতের সাথেই সংশ্লিষ্ট। বান্দাদের আবেদন বা কথাবার্তা শোনার জন্যে কিংবা তাদের দরখাস্ত কবুল করার জন্যে আল্লাহর সঞ্চালন কিংবা কুরসিতে বসবার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সূরায়ে ক্বাফ-এর ১৬ নম্বর আয়াতে এসেছেঃ আল্লাহ মানুষের গলার রগের চেয়ে নিকটে। একইভাবে সূরা বাকারার ১১৫ নম্বর আয়াতের অংশবিশেষে বলা হয়েছে "... এবং যেদিকেই তাকাওনা কেন আল্লাহ সেখানেই রয়েছেন.." আয়াতগুলোর বক্তব্য থেকে অনুমিত হয় যে, আল্লাহ সবখানেই রয়েছেন এবং শোনার জন্যে কিংবা অপরাপর কাজের জন্যে আল্লাহকে এখান থেকে সেখানে চলাফেরা করতে হয় না। মহাজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতাই সর্বময় তাঁর উপস্থিতির উৎস যে ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বহুবার বলা হয়েছে।
সূরা বাকারার ২৮৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "...সকল বস্তুর ওপর আল্লাহ ক্ষমতাবান।" আসলে জ্ঞান ও ক্ষমতা হলো আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম গুণ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর গুণাবলিকে 'কাদের, আলেম, কাদির এবং আলিম' ইত্যাদি শব্দযোগে বর্ণনা করা হয়েছে। এখন তাই ইবনে তাইমিয়াকে প্রশ্ন করা উচিত নীতিগতভাবে বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ কি বস্তুজাগতিক সৃষ্টিকূলের মতো বান্দাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেন নাকি এই যোগাযোগ বা সম্পর্কটা নীরবে মানুষের অন্তরাত্মার মাধ্যমে সংঘটিত হয়? ইবনে তাইমিয়ার চিন্তা অনুযায়ী আল্লাহ চেয়ারে বসেন এবং তাঁর সিংহাসনও রয়েছে। এমনকি আল্লাহর সিংহাসনের পাশে রাসূলে খোদার (সা) জন্যেও একটি আসন রয়েছে। অথচ নবীজী তাঁর উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান সত্ত্বেও নিজেকে আল্লাহর একজন বান্দা হিসেবে গর্ববোধ করেন। পবিত্র কোরআনের সূরা কাহাফের ১১০ নম্বর আয়াতে নবীজীকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছেঃ "বলুন! আমিও তোমাদের মতোই একজন মানুষমাত্র। (আমার বিশেষত্ব হলো) আমার কাছে ওহি নাযিল হয় যে তোমাদের মাবুদই একমাত্র মাবুদ...."।ইবনে তাইমিয়া এবং তার ছাত্র ইবনে কাইয়্যেম জুযি আরেক কদম উর্ধ্বে গিয়ে আল্লাহকে বাদশাদের সাথে তুলনা দিয়ে লিখেছেনঃ
"আল্লাহ তায়ালা পরকালীন জুমার দিনে আরশ থেকে নীচে নেমে আসেন এবং কুরসিতে বসেন। নুরের তৈরি মিম্বারগুলোর মাঝে তাঁর কুরসি স্থাপিত। নবীগণ ঐ মিম্বারগুলোতে বসেন। সোনালী ঐ কুরসিগুলো এইসব মিম্বারকে ঘিরে রয়েছে। সেখানে শহীদগণ, সিদ্দিকগণ বসেন...আল্লাহ তায়ালা জলসায় উপস্থিত সদস্যদের সাথে আলাপ আলোচনা শেষে কুরসি থেকে উঠে গিয়ে বৈঠক ত্যাগ করেন এবং নিজের আরশের দিকে চলে যান।"
মজার ব্যাপার হলো সালাফিয়ারা যে এইসব অলীক কল্পকাহিনী বর্ণনা করছে এগুলোর পেছনে কোরআন বা হাদিসের কোনো প্রামাণ্য সূত্র নেই। কেবলমাত্র কল্পনার ওপর নির্ভর করেই তারা এসব চিত্র এঁকেছে। না কোরআনে এসবের পক্ষে কোনো প্রমাণপঞ্জী আছে, না সুন্নিদের নির্ভরযোগ্য হাদিসগ্রন্থ সিহহা সিত্তায় কিছু আছে। বলা যায় অবাস্তব এইসব কল্পকাহিনী কেবল ইবনে তাইমিয়া এবং তার কিছু অনুসারীর মনগড়া ব্যাপার। তারা আল্লাহকে দৈহিকরূপ দিয়ে এবং আল্লাহর সাদৃশ্য তৈরি করে মূলত তাঁর ঐশী অবস্থান ও মর্যাদারই অবমাননা করেছে। আহলে সুন্নাতের একজন বিশিষ্ট আলেম ইবনে জুহবুল বলেছেনঃ
"ইবনে তাইমিয়া আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ও তাঁর সাহাবাগণ বলেছেন বলে যেসব কথা উদ্ধৃত করেছেন, প্রকৃতপক্ষে সেগুলোর কোনোটাই তাদেঁর কেউ বলেন নি।"
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন