ওহাবি মতবাদঃ ৯ম পর্ব
ওহাবি মতবাদঃ ৯ম পর্ব
গত আসরে আমরা বলেছিলাম ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল আযিযের মৃত্যুর পর তার ওসিয়্যত অনুযায়ী তার সন্তানদের হাতে হুকুমাতের দায়িত্ব অর্পিত হয়। আব্দুল আযিযের রেখে যাওয়া ৩৯ জন পুত্রসন্তান সেই ওসিয়্যত অনুযায়ী বয়সানুক্রমিক ধারায় সৌদি আরবের হুকুমাতের মসনদে আসীন হয়। এর পরবর্তী ইতিহাসের দিকে আজ আমরা নজর দেওয়ার চেষ্টা করবো।
আব্দুল আযিযের সন্তানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল তার নাম ছিল সাউদ। তার পরের বাদশা ছিল ফয়সাল বিন আব্দুল আযিয। কিন্তু ফয়সালের বাদশাহীর সময় সাউদি পরিবারে অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং এক পর্যায়ে ফয়সাল বিন আব্দুল আযিযকে হত্যা করা হয়। ফয়সালের বাদশাহীর সময় অপর যে ঘটনাটি সংঘটিত হয় তা হলো ইবনে আব্দুল ওহাবের সন্তানেরা ইতোপূর্বে যে সৌদি আরবের ওহাবি মাযহাবের নেতৃত্ব দিতো সেই নেতৃত্ব বা ওহাবি মাযহাবের প্রধানের দায়িত্ব থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দেয়। ইবনে আব্দুল ওহাবের সন্তানদেরকে ওহাবি মাযহাবের প্রধানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ফলে আলে-সাউদের কাছে ওহাবি মতবাদ একটি রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে পরিণত হয় এবং আলে সাউদ ও ইবনে আব্দুল ওহাব খান্দানের মধ্যকার প্রায় দুইশ' বছরের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বাদশা ফয়সালের পর খালেদ বিন আব্দুল আযিয ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। বাদশা খালেদের শাসনকালে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি ছিল ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়।মহান এই বিপ্লবের ঘটনা ওহাবিদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। কারণটা হলো ইরানের বিপ্লব ছিল মার্কিন বিরোধী এবং স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী প্রকৃত ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক একটি বিপ্লব। ওহাবি মতবাদসহ গোঁড়া এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন সকল আকিদা-বিশ্বাস ও মতবাদের বিরোধী এই বিপ্লব। বাদশা খালেদের মৃত্যুর পর ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ফাহাদ বিন আব্দুল আযিয বাদশাহী মসনদে আসীন হন এবং তিনি নিজেকে খাদেমুল হারামাইন আশশারিফাইন ঘোষণা করেন। পবিত্র এবং মহান এই ইসলামী দায়িত্ব সম্পন্ন উপাধি ধারণ করে নেপথ্যে তিনি তার অন্যায় কাজকর্মগুলোর ব্যাখ্যা দিতেন। ইহুদিবাদী ইসরাইলের কাছে আরব এবং মুসলিম জনশক্তি ফিলিস্তিনীদেরকে নতজানু করে তাদের সাথে সমঝোতা করার প্ররোচনা দেন। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদেশে চার শ ইরানী হজ্বযাত্রীকে হত্যা করা হয়েছিল এই ফাহাদ বিন আব্দুল আযিযের সময়ে।
২০০৫ সালে ফাহাদের মৃত্যুর পর ফাহাদের সৎ ভাই মালেক আব্দুল.. তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনিও লেবাননের প্রতিরোধ যুদ্ধে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে সহযোগিতা করেন এবং একইভাবে ইয়েমেন ও বাহরাইনের জনগণের ওপর দমন নিপীড়ন চালানোর ক্ষেত্রে সেইসব দেশের শাসকদেরকে সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতা করার কর্মসূচি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সবোর্পরি ওহাবিরা সৌদি হুকুমাতের ছত্রচ্ছায়ায় এবং সৌদি আরবের তেল বিক্রি থেকে অর্জিত অঢেল পয়সায় ভালো একটি সুযোগ লাভ করেছে তাদের ঐ ওহাবি মতবাদ প্রচার করার এবং তার প্রসার ঘটানোর। প্রচুর পয়সার অধিকারী হওয়ায় তারা আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঐ বাতিল আকিদা প্রচার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে তারা গরীব অসহায় মানুষের মাঝে বিপুল অর্থ বিলিয়ে, ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে ইত্যাদি বিচিত্র পদক্ষেপ নিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাসকে সম্ভাব্য সকল পন্থায় মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে।
মানুষ যেহেতু ইন্দ্রিয় দিয়ে সৃষ্টিকূলকে অনুভব করে এবং মানুষের জন্যে যেহেতু স্থান এবং কালের বিষয়টি প্রযোজ্য সেজন্যে মানুষ চায় সবকিছুকেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হিসেবে বিবেচনা করতে। এইরকম বোধ ও বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এমনকি আল্লাহকেও পঞ্চেন্দ্রিয় নির্ভর মানুষের মতো চামড়া, গোশত, রক্ত, হাড্ডিসহ মানবীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পন্ন বলে মনে করে। আল্লাহকে এরকম দৈহিক অবয়ব সম্পন্ন বলে যারা ভাবে তাদেরকে অভিহিত করা হয় 'মুশাব্বাহে' বলে। মুশাব্বাহে ছাড়াও কিন্তু আরেকটি দল আছে যারা আল্লাহর ঠিক মানবীয় অবয়ব কাঠামো থাকার কথা না বললেও তাঁর একটা অবয়ব থাকার কথা অস্বীকার করে না। এর কারণ হলো এরা কেবল কোরআন এবং রাসূলের বর্ণনার বাহ্যিক দিকটাই দেখে কোনোরকম চিন্তা-গবেষণা করাকে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের বিশ্বাস, কোরআন কেবল তেলাওয়াৎ করার জন্যেই নাযিল হয়েছে,গবেষণার জন্যে নয়। এই চিন্তাটা একেবারেই ভ্রান্ত কেননা স্বয়ং কোরআনেরই বহু আয়াতে মানুষকে চিন্তা-গবেষণা করার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
যেমন সূরা মুহাম্মাদের ২৪ নম্বর আয়াতে এসেছেঃ 'তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?'একইভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা সোয়াদের ২৯ নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ 'এটি একটি বরকতময় কিতাব,যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষেরা এর আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে এবং বুদ্ধিমানেরা তা অনুধাবন করেন'। সালাফিয়া ফের্কার প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তাইমিয়া এমন এক ব্যক্তি যে কিনা আল্লাহর দৈহিক অবয়বের কথা বলেছেন কোরআনের আয়াতের বাহ্যিক অর্থের ওপর নির্ভর করে। হাত পায়ের মতো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রয়েছে আল্লাহর-এ ধরনের বিশ্বাস তার বর্ণিত আকিদায় লক্ষ্য করা যায়। যদিও সেইসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিক মানুষের মতো নয়, ভিন্নতর। এইসব কিংকর্তব্যবিমূঢ় কথাবার্তা বলার উদ্দেশ্য আসলে শ্রোতাদের চিন্তাশক্তি নষ্ট করে দেওয়ার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ আল্লাহর হাত আছে কিন্তু হাত বলতে আমরা যেই অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গকে চিনি সেইরকম হাত নয়,বরং আল্লাহর উপযোগী হাত। অতএব বলা উচিত এই অঙ্গের নাম হাত নয় কেননা হাত বলতে আমরা এমন একটি অঙ্গকে বুঝি যাকে সবাই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও বাহ্যিক গঠন সহকারে চেনে। দৈহিক অবয়বের সাথে আল্লাহর তুলনা ইবনে তাইমিয়ার 'আরশুর রাহমান অমা ওরাদা ফিহে.....' বইতেও লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ সূরা যুমারের ৬৭ নম্বর আয়াতে এসেছেঃ 'কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমানসমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে.......'।
এখানে মুঠো শব্দটির অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা; যেমন আমরা কথাপ্রসঙ্গে প্রায়ই বলে থাকিঃ ওটাতো আমার হাতে,অর্থাৎ ঐ ব্যাপারটা পুরোপুরি আমার নিয়ন্ত্রণে। কোরআনের উল্লেখিত আয়াতে বর্ণিত হাতের মুঠোও তেমনি একটি রূপকমাত্র যার অর্থ হচ্ছে মৃত্যুপরবর্তী বিশ্বের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার থাকবে আল্লাহর।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন