ইরানিরা কি শিয়া মাযহাবের প্রবত্তক
ইরানিরা কি শিয়া মাযহাবের প্রবত্তক?!
এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে প্রথমে যে প্রশ্নটি সমাধান করতে হবে তা হল ইরানিরা কিভাবে শিয়া মাযহাবের অনুসারী হয়েছে?
সর্বপ্রথম মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর যুগে ইরানে পত্র প্রেরণ মারফত ইরানের বাদশাহকে ইসলামের প্রতি আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং ১৬ হিজরীতে দ্বিতীয় খলিফা উমার ইবনে খাত্তাবের যুগে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ভূখণ্ডে ইসলাম ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটে।
কিন্তু বর্তমানে এ দেশের অধিকাংশ জনগণই শিয়া মাযহাবের অনুসারী, কেন? এ প্রশ্ন অনেকের মনে বহুদিন ধরে জন্ম নিয়েছে। কেউ কেউ এর জন্য মনগড়া কিছু উত্তরও বানিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু মূলতঃ এ প্রশ্নের দুই ভাবে উত্তর প্রদান করা যেতে পারে।
(১) ভুল ও বানোয়াট উত্তর।
(২) সঠিক ও বুদ্ধিবৃত্তি (আকল) ভিত্তিক উত্তর।
প্রথমে আমরা এ বিষয়ে জালকৃত বিভিন্ন বিভ্রান্তকর ঘটনার –যা বর্তমানে আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে একশ্রেনীর লোক প্রবেশ করিয়েছে- প্রতি ইশারা করব অতঃপর সঠিক উত্তর প্রদান করব।
(১) ভুল ও বানোয়াট উত্তর:
কেউ কেউ ইরানিদের শিয়া হওয়ার কথা বলতে গিয়ে বলে যে, যেহেতু ইরানি সাসানী বংশোদ্ভূত বাদশাহ ইয়াদ গেরদে’র কন্যার সাথে ইমাম হুসাইন (আ.) বিবাহ করেছিলেন, সেহেতু সেই সূত্র ধরে ইরানিরা আহলে বাইত (আলাইহিমুস সালামের) প্রতি আসক্ত। আর এ কারণে ইরানিরা শিয়া মাযহাবের অনুসারী হয়েছে গেছে!!
১-১ উত্তর: প্রথমতঃ এ তথ্য সঠিক নয়।
দ্বিতীয়তঃ যদি ধরেও নিই যে, ইরানিরা সাসানী বাদশাহ ইয়াযদ গেরদের কন্যার অনুসরণে শিয়া মাযহাবের অনুসারী হয়েছে, তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল যে, ইরানিদের মনে অবশ্যই সাসানী বাদশাহদের উপর ভালবাসা থাকতে হবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, সাসানী বাদশাহদের পতনের সময় ইরানের জনগণ দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল এবং কোন প্রতিবাদই তারা করেনি। এমনকি ইয়াযদ গেরদে পালিয়ে ইরানের বিভিন্ন শহরে উদ্বাস্তুদের মত ঘুরে বেড়াতে থাকে। পরিশেষ মারভে’ জনৈক ব্যক্তি তাকে হত্যা করে।
তৃতীয়তঃ শহীদ মুতাহারী একটি উত্তর এ সম্পর্কে প্রদান করেছেন, তা হল: উমাইয়া বংশের বেশ কয়েকজন ব্যক্তিত্ব সাসানীদের সাথে সম্পর্ক করেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরানিরা কেন উমাইয়াদেরকে পছন্দ করে না?
১-২ প্রকৃত অর্থে ইরানিরা –ইরানের ইসলাম আগমণের পূর্বে- ছিল আরব, ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোর বিরোধী। মুসলমানদের কর্তৃক বৃহৎ ইরান বিজয়ের পর ইরানিরা বাধ্য হয়ে প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা দেয়। এমনটি না করলে তাদেরকে হত্যা করা হত বা কর দিতে হত। সুতরাং তারা বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু তারা আসলে ইসলাম আগমণের পূর্বে তাদের অগ্নিপূজার সেই বিশ্বাসকে শিয়া মাযহাবের রূপে ধরে রেখে ছিল।
সুতরাং শিয়া মাযহাবটি হচ্ছে এমন একটি মাযহাব যা ইরানিদের দ্বারা তৈরী হয়েছে এবং ইসলামের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই, বরং শিয়া মাযহাব হচ্ছে একটি ইরানি মাযহাব।
এ উত্তরের সমালোচনা:
প্রথমতঃ এ উত্তর ঐ অবস্থায় সঠিক হবে যদি শিয়া মাযহাবের নেতাগণ ইরানি হয়ে থাকে। কিন্তু শিয়াদের প্রকৃত নেতারা অর্থাৎ ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম) সকলেই আরব।
দ্বিতীয়তঃ শিয়া মাযহাবের প্রথম অনুসারীদের সকলকে ইরানি হতে হবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সালমান ফারসী (রা.) এর ন্যায় কয়েকজন ছাড়া আর সকল শিয়াই হচ্ছে আরব।
তৃতীয়তঃ উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি ঐ অবস্থায় সঠিক হত যদি শিয়াদের মূল গ্রন্থ অন্যান্য মুসলমানদের গ্রন্থ হতে আলদা হত। কিন্তু এটা স্পষ্ট বিষয় যে শিয়াসহ সকল ইসলামি মাযহাবের মূল গ্রন্থ হচ্ছে কোরআন শরিফ এবং শিয়া ও অশিয়া সকলেই এর প্রতি বিশ্বাসী। দ্বিতীয় সূত্রটি হচ্ছে সুন্নত। তৃতীয়টি হচ্ছে ইজমা যা কিতাব ও সুন্নতের দিকে ফিরে যায় এবং বুদ্ধিবৃত্তি যা সকলের নিকটই বিদ্যমান। আর এটা শুধুমাত্র ইরানিদের জন্য নয় বরং সকলেই বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী এবং সকলেই এর হতে উপকৃত হয়।
চতুর্থতঃ উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক হওয়ার পূর্ব শর্ত হল, প্রথম শতাব্দিতে সকল ইরানিদেরকে শিয়া মাযহাবের অনুসারী হতে হবে। কিন্তু পাঠক মহোদয় অবগত আছেন যে, হিজরী প্রথম শতাব্দিতে অধিকাংশ ইরানিরা ছিল সুন্নি মাযহাবের অনুসারী এবং সুন্নি মাযহাবের অধিকাংশ নেতাও ছিলেন ইরানি। একইভাবে সুন্নি মাযহাবের ধর্মীয় মূল (সহীহ) গ্রন্থসমূহের প্রণেতাগণের অধিকাংশও ছিলেন ইরানি। এ বিষয়টি শহীদ আয়াতুল্লাহ মূর্তাজা মুতাহারী নিজের ‘ইসলাম ও ইরানের পারস্পারিক অবদান’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
পঞ্চমঃ হিজরী বর্ষের দশম শতাব্দি অব্দি শিয়াদের অধিকাংশ নেতা, মনীষী ও চিন্তাবিদগণ ইরানি ছিলেন না। তারা সকলেই ইরানের বাইরে জীবন যাপন করতেন। শেইখ মুফিদ, সাইয়্যেদ মূর্ত্তাজা, মুহাক্কেক হিল্লী, শহীদে আওয়াল ও সানী, জাবাল আমেলের আলেমগণ –যারা পরবর্তীতে সাফাভীদের আমন্ত্রণে ইরানে আসেন- এবং মুহাক্কেকে কারাকী –যিনি ইরান ও ইরাকসহ অন্যান্য অঞ্চলে শিয়া হাওযা ইলমিয়াহ’র (উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) প্রসার ঘটিয়েছেন –এঁরা সকলেই ছিলেন অইরানি।
এটা সত্য যে, সংস্কৃতি, ভাষা, স্থান, কাল এবং রীতি-প্রথা মাযহাবগত শিক্ষার উপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু এর কারণে ইরানিদের জন্য শিয়া মাযহাব নামক একটি নতুন মাযহাবের প্রতিষ্ঠা লাভ করবে এটা সঠিক নয়। ঘটনাক্রমে শিয়া মাযহাবের ফেকাহ শাস্ত্র স্থান, কাল, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। সুতরাং প্রভাব ফেলা এবং প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টি অনস্বীকার্য একটি বিষয়। কিন্তু এ বিষয়গুলো নতুন একটি মাযহাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়।
ইসলাম ধর্ম আগমনের পূর্বের কিছু কিছু দর্শন বিষয়ক শিক্ষা ইসলাম আগমনের পর ইসলামে সেগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিছু কিছু জাতির রীতি-প্রথাও ইসলাম স্বীকৃতি দিয়েছে বা সেগুলোর বিরুদ্ধে কোন কিছু বলেনি। প্রকৃত অর্থে ইরানিরাও নিজেদের কিছু কিছু প্রাচীন রীতি-প্রথা যেগুলো ইসলামের সাথে সংঘর্ষী নয়, সেগুলোকে ধরে রেখেছে কিন্তু সেগুলোকে কখনই শিয়া মাযহাবের অংশ হিসেবে বিবেচিত করে না, বরং সেগুলোকে শুধুমাত্র একটি জাতীয় রসম হিসেবে গন্য করে এবং ধর্মের সাথে সেগুলোকে সম্পৃক্ত করে না। ঈদে নওরোজ (বা সৌরবর্ষের নববর্ষের দিন) তারা আনন্দ উত্সব পালন করে থাকে। যা ইসলামের পূর্ব যুগ হতেও ইরানিদের জাতীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবে গন্য হত। একই ভাবে ফারসী ভাষা। ইরানি কখনই ফারসী ভাষাকে ভুলে যায় নি। কেননা ইসলাম ও ইরানের মাঝে সাংঘর্ষিক কোন কিছু ছিল না। বরং যে সকল বিষয়ে এরা পরস্পর সংঘর্ষী ছিল সেগুলোকে ইসলামি স্বার্থ রক্ষায় ইরানিরা পরিত্যাগ করে ইসলামকে প্রাধান্য দিয়েছে।
১-৩ সবচেয়ে মজার বিষয় হল যে, ১০ম খ্রিষ্টাব্দ অব্দি ইরানিরা ছিল সুন্নি মাযহাবের অনুসারী। কিন্তু এর পর হতে সাফাভী শাসনামলের পর তারা আস্তে আস্তে শিয়া মাযহাবকে নিজেদের অনুসরণীয় মাযহাব হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে। কেননা শাহ ইসমাঈল সাফাভী ইরানের তাবরীজ শহরের রাজ মুকুট পরিধান করার পর সুন্নি মাযহাবের অনুসারীদের বৃহৎ একটি অংশকে গণহত্যা করেন।
এ উত্তরের সমালোচনা:
প্রথমতঃ শাহ ইসমাইল যখন সিংহাসনে বসেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর এবং এ ক্ষেত্রে এটা গ্রহণযোগ্য নয় যে, তিনি শিয়াদের সহযোগিতা ছাড়া ক্ষমতায় পৌঁছুতে পারেন। কেননা এটা যুক্তি সম্মত নয় যে, তার সমর্থকরা সবাই হবেন সুন্নি মাযহাবের এবং তারা নিজেদের মাযহাবের বিরুদ্ধে শাহ ইসমাঈলকে শিয়া মাযহাবের স্বার্থে সহযোগিতা করবে। সুতরাং তত্কালীন যুগে ইরানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়ার উপস্থিতি ছিল, যাদের উপর আস্থাশীল হয়ে সাফাভীরা সরকার গঠন করে এবং শক্তিশালী উসমানী –যারা ছিল সুন্নি মাযহাবের সমর্থক- শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়।
দ্বিতীয়তঃ ইতিহাসে এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি যে, সাফাভীরা তলোয়ারের জোরে ইরানে শিয়া মাযহাবের জন্ম দিয়েছে। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুন্নি মাযহাবের অনুসারীরা সাফাভী শাসকদের কর্তৃক কষ্ট ও দূর্ভোগের শিকার হয়েছে। কেননা উসমানী সরকারের আওতাভূক্ত অন্যান্য স্থানে শিয়াদেরকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয়া হত। আর এটা স্পষ্ট যে, উভয় সরকারের এ ধরণের পদক্ষেপ অন্যায্য ও অনিসলামি।
২- সঠিক ও যুক্তিসম্মত উত্তর
প্রথমে এ বিষয়টি মেনে নিতে হবে যে, কোন সমাজে একটি মাযহাবের দৃঢ়তা একদিনে বা স্বল্প সময়ে অর্জিত হয় না, বরং পর্যায়ক্রমে ও ধীরে ধীরে এ বিষয়টি অর্জিত হয়। ইরানি জাতির মধ্য হতে প্রথম ব্যক্তির শিয়া মাযহাব গ্রহণের সময় হতে ইরানের অধিকাংশ জনগণের শিয়া মাযহাবের অনুসারী হওয়ার মাঝে প্রায় ১০ শতাব্দি দূরত্ব রয়েছে।
এ ১০ শতাব্দীতে যে সকল ঘটনা ইরানে ঘটেছে সেগুলোর কারণেই ইরানে শিয়া মাযহাব ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। সংক্ষেপে এভাবে বলা যেতে পারে যে,
২-১ মহানবী (স.) এর প্রাণপ্রিয় সাহাবী ও তাঁর আহলে বাইত (আ.) এর ভক্ত হযরত সালমান ফারসী ছিলেন একজন শিয়া। ইয়েমেনে বসবাসরত ইরানিরাও আহলে বাইত (আ.) এর ভক্ত ছিল। ইয়েমেন বাসী আল্লাহর রাসূল (স.) এর জীবদ্দশায় হযরত আলী (আ.) এর হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আর ইয়েমেনবাসী সেদিন হতেই হযরত আলী (আ.) এর সাথে পরিচিতি লাভ করে। এমতাবস্থায় এ ঘটনা ঘটে যে, ইয়েমেন পর্যন্ত পারস্য উপসাগরের সৈকত ইরানের তত্ত্বাবধানাধীন ছিল।
২-২ দ্বিতীয় খলিফার যুগে, তিনি আরব ও আজমের (অনারবের) মাঝে পার্থক্যের সৃষ্টি করেন যা ইরানিদের অসন্তুষ্টির কারণ হয়। একজন ইরানির হাতে দ্বিতীয় খলিফার নিহত হওয়ার পর তার (খলিফা ওমর বিন খাত্তাবের) সন্তান মদিনায় বসবাসরত কয়েকজন ইরানিকে হত্যা করে। কিন্তু যখন হযরত আলী (আ.) খেলাফতে পৌঁছান তখন তিনি এ ঘোষণা দেন যে, আরব এবং অনারবের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আর অনারবদের উপর আরবদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আর এ ঘোষণার ফলশ্রুতিতে ইরানিরা হযরত আলী (আ.) এর প্রতি অধিক অসক্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া ইমাম যয়নুল আবেদিন (আ.) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনারব দাসকে মুক্ত করেন, যাদের মধ্যে মাওয়ালীরাও –ইরানি- ছিল, যারা ছিল আহলে বাইত (আ.) এর ভক্ত।
২-৩ ইমাম হুসাইন বিন আলী (আ.) এর শাহাদতের পর ইরানিরা এ বিষয়টি বুঝতে পারলো যে, বর্তমানে ইসলাম দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়েছে; হুসাইনী ইসলাম এবং ইয়াযিদী ইসলাম। বনি উমাইয়া তাদের শাসকদের কর্তৃক চালানো অত্যাচারের কারণে ইরানিদের অন্তরে স্থান করে নিতে পারেনি। আর তাই স্বাভাবিকভাবে ইরানিরা ইমাম হুসাইন (আ.) ও আহলে বাইত (আ.) এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে বনি উমাইয়া রাজতন্ত্রের পতনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা প্রথম অবস্থায় বনি আব্বাস মহানবী (স.) এর বংশধরদের সহযোগিতার শ্লোগান নিয়ে মাঠে নেমেছিল। যদিও পরবর্তীতে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বনি আব্বাসের চিন্তাধারা ছিল আহলে বাইত (আ.) এর চিন্তাধারা পরিপন্থী।
২-৪ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ইমাম সাদিক (আ.) ও অন্যান্য ইমামদের অনেক শিষ্যই ইরান সফর করে, ব্যাপকভাবে আহলে বাইত (আ.) এর মাযহাবের প্রচার করে ইরানিদেরকে তাঁদের মাযহাবে প্রতি আহ্বান জানান।
২-৫ খোরাসান রাজ্যে ইমাম রেজা (আ.) এর উপস্থিতি ইরানিদের শিয়া হওয়ার নেপথ্যে অন্যতম দলিল। মা’মুন ইমাম রেজা (আ.) কে তার স্থলাভিষিক্ত করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঐ সকল আরবের মোকাবেলা করা যারা তার ভাই আমিনকে সমর্থন করত। তার বিশ্লেষণ ছিল এরূপ যে, ইমাম রেজা (আ.) কে তার স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করার মাধ্যমে তিনি ইরানিদের শিয়াদেরকে এবং আরব শিয়াদেরকেও নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারবেন। আর এর মাধ্যমে তিনি শক্তিশালী ও আমিন দূর্বল হয়ে পড়ে।
২-৬ ইমামগণ (আ.) এর অনেক সন্তানই ‘মানসুর দাওয়ানেকী’র ন্যায় অন্যান্য স্বৈরাচারী খলিফার অত্যাচার হতে পরিত্রাণ পেতে ইরানে আসেন। তাদের ইরানের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণই হচ্ছে ইরানে শিয়া মাযহাবের বিস্তার লাভের অন্যতম কারণ। হযরত মা’সুমা (সা. আ.) পবিত্র কোম নগরীতে, শিরাজে হযরত শাহ চেরাগ (আ.), রেই শহরে হযরত শাহ আব্দুল আযিম হাসানী (আ.) এর উপস্থিতি ইরানের জনগণের শিয়া মাযহাবের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ।
২-৭ শিয়া সরকার আলে বুয়ে’র শাসনামলে আহলে বাইত (আ.) এর মাযহাবের প্রচারের ব্যাপক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। এ সময় আত তাহজীব, আল এস্তেবসার, কাফী ও মান লা ইয়াহযারহুল ফাকীহ’র ন্যায় শিয়াদের বড় বড় গ্রন্থ রচিত হয়। শেইখ সুদুক, শেইখ মুফিদ, শেইখ তুসী, সাইয়্যেদ মূর্ত্তাজা, সাইয়্যেদ রাজী’র মত শিয়া মাযহাবের প্রথম সারির আলেমগণ এ সময় শিয়া মাযহাবকে জনগণের মাঝে প্রচারের ব্যাপক সুযোগ লাভ করেন।
২-৮ ইলখানদের শাসনামলে আল্লামা হিল্লী দীর্ঘ ১০ বছর যাবত ইরানে শরয়ী মাসআল মাসায়েল বর্ণনার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান, ফেকাহ ও কালাম শাস্ত্রের উপর তার বিশেষ দক্ষতা এবং খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী’র আপ্রান চেষ্টা ইরানের শিয়া মাযহাবের প্রসার লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
২-৯ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল যে, সর্বশেষ সাফাভী শাসনামল ও শিয়া মাযহাবকে রাষ্ট্রীয় মাযহাব হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে শিয়া আলেমদের আমন্ত্রণ জানানোর ফলে দীর্ঘ ১০ শতাব্দি পর অবশেষে ইরানের প্রকৃত ইসলামের অনুসারী শিয়া মাযহাবের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং এদেশের রাষ্ট্রীয় মাযহাব হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
নিঃসন্দেহে এ কথা বলার অবকাশ থাকে না যে, ইরানে যদি পূর্ব হতে শিয়াদের উপস্থিতি না থাকত তবে সাফাভি শাসকরা কখনই একটি শিয়া হুকুমতের নাম নিয়ে ক্ষমতায় পৌঁছুতে সক্ষম হত না এবং জনগণও শিয়া মাযহাবকে রাষ্ট্রীয় মাযহাব হিসেবে ঘোষণা দেয়ার বিষয়টি মেনে নিত না।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন