লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত কি?

শবে বরাতের শাব্দিক অর্থ: ‘শব’ ফারসি ‘শাব’ (شَبْ)শব্দ থেকে বাংলায় এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী। আর ‘বরাত’ শব্দটির মূলে ফারসি ও আরবি ‘বারা’আত’ (بَرائت) শব্দটি রয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ বা অব্যাহতি।

লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত কি?
শবে বরাতের শাব্দিক অর্থ:
‘শব’ ফারসি ‘শাব’ (شَبْ)শব্দ থেকে বাংলায় এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী। আর ‘বরাত’ শব্দটির মূলে ফারসি ও আরবি ‘বারা’আত’ (بَرائت) শব্দটি রয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ বা অব্যাহতি।
শবে বরাতের আভিধানিক অর্থ:
শবে বরাতের আভিধানিক অর্থ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে ‘শব’ নিয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন রাখে না, কেননা পূর্বেই আমাদের সামনে তার অর্থ পরিস্কার হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে শুধুমাত্র বরাত শব্দটির ব্যাখ্যা দিলেই ওই দু’শব্দের মিলিত বাক্যের অর্থ আমাদের হাতে এসে যাবে ইন্শাআল্লাহ্ তা’য়ালা। এ শব্দটির আরবি ও ফারসির একই রূপ যার অর্থও একই। যা উপবে বর্ণিত হয়েছে। তাই এখানে সম্পর্কচ্ছেদ বা অব্যাহতির ব্যাখ্যা দেয়াটাই শ্রেয় হবে। এ রাতে গোনাহের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা অর্থাৎ গোনাহ্ হতে দুরে থেকে এবং রাতভর ইবাদতে মশুগুল হয়ে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্য দিয়ে, পূর্ব গোনাহ থেকে অব্যাহতি প্রাপ্তির মাধ্যমে আগামী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারীত করা। আর এই ব্যাখ্যার আলোকে পন্ডিত ব্যক্তিগণ এ রাতকে ‘ভাগ্যময় রাত বা রজনী’ বলে আখ্যায়ীত করেছেন। আর যে দু’টি মূল কারণে এ রাত্রটি উক্ত অর্থে গ্রহণীয় তা হচ্ছে:
১. ‘শব’ শব্দটি ফারসি এবং বরাত শব্দটি ফারসি ও আরবি ‘বারা’আত’ শব্দের রূপ থেকে পরিগৃহীত হয়েছে তাই ওই দু’শব্দের মিলনে ভাষাগত কোন সমস্যা নেই।
২. শা’বানের মধ্যরজনীকে অনেকেই লাইলাতুল ক্বাদর বলে আখ্যা দিয়েছেন, আর অন্য দিকে রমযান মাসের লাইলাতুল ক্বাদরকে অনেকেই লাইলাতুল বারা’আত হিসাবে নামকরণ করেছেন, সুতরাং শা‘বানের মধ্য রজনীকে যেহেতু লাইলাতুল ক্বাদর হিসেবে গণ্য করা হয় এবং যেহেতু রমযানের লাইলাতুল ক্বাদর আবার লাইলাতুল বারা’আত হিসেবে গণ্য হয় তাই শা’বানের মধ্য রজনীও যে লাইলাতুল বারা’আত হিসেবে গণ্য হবে তাতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই।
শবে বরাতের ইতিহাস
হযরত মুহাম্মদ (সা.) থেকে এ রাতের ব্যাপারে অনেক হাদীস আমাদের হস্তগত হয়েছে। তবে যেসব হাদীসসমূহ পরিপূর্ণতার আলোকে ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যতা রাখে তা নিম্নে বর্ণিত হল, যথা:
রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন: শা’বান মাসের মধ্য রজনীতে (১৫ ই শা’বানের রাতে) ঘুমিয়ে ছিলাম এমন সময় জিব্রাঈল (আ.) আমার শিয়রে উপস্থিত হয়ে বলল: হে মুহাম্মদ উঠুন! এর পর সে আমাকে শোয়া থেকে উঠালো এবং বাকী কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে বলল: আকাশের দিকে চেয়ে দেখুন! আজ রাতে আসমানের দরজাসমূহ খুলে যাবে। রহমতের দরজাসমূহ খুলে যাবে এবং খুলে যাবে সকল সুখ, সমৃদ্ধি, ক্ষমা, রুযি, পরিত্রাণ পাওয়া ও পূনর্জ্জিবীত হওয়ার দরজাসমূহ ও আরো অন্যান্য ...। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা এ রাতে চারপায়ী জন্তুর গায়ের চুল ও পশমের পরিমাণ নিজ বান্দাগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন। এ রাতে তিনি মৃত্যুর সময় এবং আগামী এক বছরের রিযিক (এখানে সকল নেয়ামতকেই বুঝানো হয়েছে) নির্ধারণ করবেন। হে মুহাম্মদ! যারা এ রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালাকে পবিত্র ও একক সত্তা যেনে তাঁর যিকির করবে, তাকে রাজি-খুশি করার জন্য নামায-দোয়া পড়বে, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করবে ও অধিক পরিমাণে আসতাগফার করে রাতকে প্রভাবে পৌছাবে তাদের স্থান হবে বেহেশ্তে এবং তারা এর পূর্বে যা কিছু (গোনাহ) আঞ্জাম দিয়েছে ও পরবর্তিতে আঞ্জাম দিবে তাও ক্ষমা করে দিবেন...।
দ্বিতীয় হিজরীর ১৫ই শা’বানের মধ্য রাতে উক্ত ঘটনাটি সংঘটিত হয়। আর তখন থেকেই শবে বরাতের এ রসম-রেওয়াজ প্রচলিত হয়।(ইবনে তাউউস, আলী বিন মুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.- ২১২, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল আয়া’লামি লিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী। আল্ মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকির, বিহরুল আনওয়ার, খণ্ড-৯৮, পৃ.-৪১৩, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল ওয়াফা, ১৪০৩ হিজরী।)
ইমাম আলী (আ.)-এর একজন বিশিষ্ট সাহাবা কুমাইল বিন যিয়াদ, ইমামের উদ্ধৃতি দিয়ে এভাবে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেন: একদা বছরার মসজিদে আমার মাওলার নিকট বসে ছিলাম এবং সেখানে তাঁর একদল সাথীও উপস্থিত ছিল। আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন ইমাম (আ.)-কে প্রশ্ন করল: আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার এ          فيها يفرق كل امر حكيم  -ওই রাতে প্রতিটি নির্দেশই হিকমতের সাথে নির্দিষ্ট ও নির্বাচিত হবে- সূরা: দুখান, আয়াত নং-৪) উক্তির অর্থ কি?
ইমাম বললেন: “তাঁর কসম, যার হাতে আলীর জীবন‍! মধ্য শা’বান থেকে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত সকল ভাল-মন্দ দিক যা বান্দার উপর জারি হয় তা এই রাতে নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। এমন কোন বান্দা নেই, যে  এ রাতে জাগ্রত থেকে খাযার নামক দোয়া পাঠ করবে তার দোয়া অবশ্যই কবুল হবে”।
এরপর ইমাম আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি রাতে তাঁর বাড়ীতে গেলাম। ইমাম আমাকে বললেন: কি হয়েছে কুমাইল? বললাম: হে আমিরূল মু’মিনিন দোয়ায়ে খাযার শিক্ষা নেয়ার জন্য এসেছি, যদি আমাকে শিক্ষা দেন। তিনি বললেন: বস হে কুমাইল‍! যখন এ দোয়াটি আমার থেকে শিক্ষা নিবে এবং মুখস্ত করবে, আল্লাহর শপথ প্রতি জুময়া’র রাতে অথবা প্রতি মাসে একবার অথবা বছরে একবার অথবা অন্ততপক্ষে সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় একবার তা পড়বে, যাতে করে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার সাহায্য তোমার উপর বর্তায় এবং তোমাকে রুযি ও ক্ষমা দান করুন। হে কুমাইল‍! যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে তুমি আমাদের সাথে রয়েছো তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তোমার বৈধ চাওয়া পূরণ করা। তখন তিনি আমাকে উক্ত দোয়াটি শিক্ষা দেন ...।
উল্লিখিত দোয়াটি হচ্ছে সেই দোয়া যা বর্তমানে দোয়ায়ে কুমাইল নামে আমাদের মাঝে পরিচিত। (ইবনে তাউউস, আলী বিন মুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.- ২২০, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল আয়া’লামি লিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী)

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন