ইমাম হাসান (আ.) এর জন্মবার্ষিকী

ইমাম হাসান (আ.) এর জন্মবার্ষিকী

 

ইসলামের ইতিহাসে পণেরোই রমযান একটি ঐতিহাসিক দিন, আনন্দের দিন । কারণ তৃতীয় হিজরীর এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমাতুয যাহরা ( সা ) এর বড় সন্তান ইমাম হাসান ( আ )।

বিশ্বব্যাপী রমযান আসে রহমত,মাগফেরাত আর নাজাতের শুভবার্তা নিয়ে। আর হযরত আলী ( আ ) গৃহে এই রমযান এসেছে আরো একটি খুশির আমেজ নিয়ে। এই খুশি কোরআনের বসন্তে নবজাতকের সুরেলা কান্নার খুশি। এই খুশি হযরত ফাতেমা ( সা ) এর মাধ্যমে নবীবংশের বিস্তারের খুশি। এই খুশি বিশ্বমানবতার জন্যে সঠিক পথে পরিচালিত হবার দিক-নির্দেশকের শুভজন্মের খুশি। রমযান তাই আমাদের জন্যে এই সুসংবাদটি নিয়ে হাজির হয় প্রতি বছর। পণেরোই রমযানকে তাই আমরা বিশেষভাবে উদযাপন করবো। ইমাম হাসান ( আ ) এর জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে সেগুলোকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবো। রমযানের মহাবরকতময় দিনগুলোর ঠিক মাঝখানে আমরা ইমামের জীবনের একটি বৈশিষ্ট্যকে অনুসরণ করতে পারি। বৈশিষ্ট্যটি হলো তিনি ছিলেন অসম্ভব দানশীল। তাঁর দানশীলতার বৈশিষ্ট্যটি অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে আমরাও ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারি।

ইমাম হাসান ( আ ) অসহায়-বঞ্চিতদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। জনগণের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য এবং পুণ্যের পথে তিনি সকল সুযোগ-সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর দানের বিষয়টি ইতিহাস খ্যাত। ইতিহাসে এসেছে- ইমাম হাসান (আ) তাঁর জীবনে দুইবার নিজের সকল সহায়-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার নিজের অর্থ-সম্পদের অর্ধেকটা গরীব-অসহায়দের দান করেছেন। রমযান মাসে আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ গরীব-অসহায়দের প্রতি যদি সদয় দৃষ্টি দেই তাহলে রমযানের কল্যাণে আমাদের দানের মর্যাদাও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে নিঃসন্দেহে।

ইমাম হাসান ( আ ) এর জীবনের আরেকটি বিশেষ গুণ আমরা চর্চা করতে পারি,তাহলো গর্ব-অহংকারহীনতা। রমযান মাসে এই শিক্ষাটি আমাদের সবার জন্যেই মঙ্গলজনক। একদিন ইমাম হাসান ( আ ) তাঁর চলার পথে কিছু ফকীরকে দেখতে পেলেন দরিদ্রসুলভ দস্তরখান পেতে রুটির টুকরো চিবিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে। তারা ইমামকে দেখে বললোঃ হে রাসূলের সন্তান! আসুন ! আমাদের সাথে আহার করুন! ইমাম দ্বিধাহীন চিত্তে পরিপূর্ণ আগ্রহ ও উৎসাহের সাথে তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং দ্রুত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এসে তাদের সাথে বসে পড়লেন। বসেই তিনি বললেন-আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না-এই বলে তিনি ফকিরদের সাথে আহার করতে শুরু করলেন। না,কেবল খেলেনই না, বরং তাদেরকে নিজের বাসায় দাওয়াতও করলেন। অতিথি ফকিরগণ যখন ইমামের বাসায় এলেন, ইমাম হাসান তাদেরকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করলেন এবং তাদের মেহমানদারি করলেন। সেইসাথে তাদের সবাইকে নতুন জামা-কাপড়ও উপহার দিলেন।

এই যে ছোট্ট ঘটনাটি,এতে আমাদের জন্যে বেশ কয়েকটি শিক্ষা রয়েছে। প্রথম শিক্ষাটি হলো মানুষকে মানুষ হিসেবেই যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। অর্থ-সম্পদের দিক থেকে শ্রেণীবিন্যস্ত করে কাউকে মূল্যায়ন করা ঠিক নয়। আমাদের সমাজের দিকে তাকালে এর দৈন্যতার ভয়াবহ চিত্র লক্ষ্য করা যাবে। এ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি। ফলে আল্লাহর সৃষ্টিকে সমানভাবে ভালোবাসতে হবে। গরীবদেরকে গরীব হবার কারণে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়। কী অদ্ভুত কাণ্ড! আমরা কি কখনো একজন ফকিরকে বাড়িতে দাওয়াত করে খাইয়েছি ! অথচ একজন গরীবকে দাওয়াত করে খাওয়ালে সেই গরীব লোকটি নিজের মর্যাদা উপলব্ধি করে আপনার প্রতি শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো। উপরন্তু তাকে যদি কিছু উপহার দান করেন তাহলে তো কথাই নেই। মনের গভীর থেকে সে আপনার জন্যে দোয়া করবে। রমযান মাসে ইমামের সম্মানে এই অনুশীলনটি করা যেতে পারে।

এখানে আরো যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির শিক্ষা রয়েছে,তাহলো নিরহঙ্কারী হওয়া। গর্ব-অহংকারবিহীন জীবন গড়ে তোলা আমাদের জন্যে খুবই জরুরি। আসলে আমাদের গর্ব করার মতো আছেটাই বা কী! এই পৃথিবীর কোনো কিছুইতো আমার নিজের নয়। যতো ধন-সম্পদ,জ্ঞান-গরিমা সবই তো আল্লাহ দয়া করে আমাদের দান করেছেন। ফলে সবই তো আল্লাহর। এই চিন্তাটি যদি আমাদের মাথায় কাজ করে তাহলে নিজের যতো বিত্ত-বৈভবই থাকুক না কেন,তা যে আমার নয়,সে ব্যাপারে আমাদের বিশ্বাস বেড়ে যাবে অর্থাৎ ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তখন দেখা যাবে আমার সাথে আর ঐ ফকির লোকটির সাথে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাই বড়াই করার মতো কোনো কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না। সেরকমই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন ইমাম হাসান ( আ )।

সর্বোপরি মানুষকে ভালোবাসতে হবে অন্তর থেকে। তথাকথিত রাজনীতিকদের মতো নয়,যারা ভালোবাসার আনুষ্ঠানিকতা দেখায়। গরিবদের প্রতি বাহ্যিকভাবে ব্যাপক আনুকূল্য দেখায় ভোটের জন্যে, আর ভোটে জেতার পর সেই গরীব লোকদের হক বা অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে। তাদের জন্যে বরাদ্ধকৃত বিভিন্ন বস্তুসামগ্রী,অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি খেয়ে দোযখের মতো বিশাল উদর পূর্তি করে। বরং ভালোবাসতে হবে ইমাম হাসান ( আ ) এর মতো। শ্রেণীভেদে সবার সাথে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে যেতে হবে। তাদের ভালোবাসতে হবে নিজের ভাইয়ের মতো করে। তাহলে আল্লাহও আপনাকে ভালোবাসবেন। রমযানের পবিত্রতম দিনগুলোতে আমরা ইমাম হাসান ( আ ) এর প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তাঁরি জীবনের এই অকৃত্রিম আদর্শগুলো চর্চা করার চেষ্টা করবো ইনশা আল্লাহ।

রাসূলে খোদা ( সা ) আল্লাহর ইচ্ছায় নবজাতকের নাম রাখলেন হাসান। হাসান ইবনে আলী ( আ ) নবীজীর স্নেহ-আদরের ছায়ায় সাতটি বছর কাটাবার সুযোগ লাভ করেছেন। শৈশবের সেই সোনালী দিনগুলোতে রাসূলে খোদার দুর্লভ সান্নিধ্য ও সাহচর্য ছিল হাসান (আ) এর জীবনের অমূল্য অর্জন। নানাজির মতো বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অস্তিত্বের নূরে তাঁর হৃদয়মন নুরান্বিত হয়েছিল,সমৃদ্ধ হয়েছিল-যা মানবিক পরিপূর্ণতার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম দুর্লভ সৌভাগ্য নবীজীর সন্তানদের ললাটেই বেশিরভাগ জুটেছে,যা একদিকে যেমন প্রশান্তি ও সমৃদ্ধির অপরদিকে মহা আনন্দের বিষয়।

ইতিহাসে এসেছে ইমাম হাসান মুজতবা ( আ ) দেখতে রাসূলে খোদা ( সা ) এর মতো ছিলেন। চেহারায় রাসূলের সাথে খুব বেশি মিল ছিল তাঁর। নবীজীও ভীষণরকম আদর করতেন তাঁকে। ইমাম হাসান ( আ ) ও নানাকে খুব বেশি পছন্দ করতেন। নবীজী তো নিয়মিত মদিনার মসজিদে যেতেন,বক্তব্য রাখতেন। ইমাম হাসানও প্রতিদিন যেতেন মসজিদে নানার সুমিষ্ট ও মূল্যবান বাণী শোনার জন্যে। ইমাম যখন ছোট্ট,তখনই নানার মুখের ওহীসমৃদ্ধ কথাগুলো বুঝতে পারতেন এবং বাসায় ফিরে নবীজীর মূল্যবান শিক্ষাগুলোকে মায়ের কাছে বর্ণনা করতেন।

ইমাম হাসান ( আ ) কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই সুন্দর করে কথা বলতেন। ইমামের সমকালীন এক ব্যক্তি,তাঁর নাম ছিল উমায়েদ ইবনে ইসহাক,তিনি ইমাম হাসান ( আ ) এর কথা বলার সৌন্দর্য সম্পর্কে বলেছেনঃ হাসান ইবনে আলী ( আ ) যখন কথা বলতেন,তখন অনুরোধ করতাম যেন বক্তব্য অব্যাহত রাখেন। আমি তাঁর কথা শুনে ভীষণ উৎফুল্ল হতাম,তৃপ্ত হতাম। তাঁর পবিত্র মুখে রূঢ় কোনো শব্দ উচ্চারিত হতে কখনোই শুনি নি। সেই ছোট্ট বেলাতেই ইমাম হাসান ধর্মীয় বিষয়-আশয়ে বেশ জ্ঞান রাখতেন। নবীজী এবং হযরত আলী ( আ ) হাসান ( আ ) এর এই জ্ঞান সম্পর্কে জানতেন। সেজন্যে তাঁরা ধর্মীয় নিয়ম-নীতি সম্পর্কে জনগণ প্রশ্ন করলে তার জবাবের জন্যে মাঝেমাঝে হাসান ( আ ) এর কাছে পাঠাতেন। আর ইমাম হাসানও অত্যন্ত দৃঢ়তা এবং যোগ্যতার সাথে জনগণের প্রশ্নের যথার্থ জবাব দিতেন।

হাসান ইবনে আলী ( আ ) এর স্বভাব-প্রকৃতিতেই একটা অভিজাত ও মহানুভব ভাব ছিল সুস্পষ্ট। যে-ই তাঁকে দেখতো মানসিক প্রশান্তি ও তৃপ্তিবোধ করতো,এককথায় তাঁকে ভালো লাগতো সবার। জালালুদ্দিন সুয়ূতি তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন-হাসান ইবনে আলী ( আ ) এর চারিত্রিক মাধুর্য এবং মানবিক গুণাবলী ছিল প্রচুর। তিনি ছিলেন মহৎ, নম্র ও সহিষ্ণু চরিত্রের অধিকারী এবং মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও ঔদার্যের অধিকারী। জনগণের কাছে তিনি ছিলেন ভীষণ প্রশংসনীয়।

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন