ইমাম হোসাইন (আ.)
ইমাম হোসাইন (আ.)
১০ মহররম মুসলিম উম্মাহর জাতীয় শোক দিবস। ৬১ হিজরির এই দিনে সাইয়েদুল মুরছালিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কলিজার টুকরা, শেরে খোদা হজরত আলী (রা.) ও খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমা (রা.)-এর নয়নের মণি ইমাম হোসাইন (সালাম উল্লা আলাইহি) তাঁর পরিবারবর্গ, সঙ্গীসহ মুয়াবিয়ার বেটা ইয়াজিদের লস্করের হাতে কারবালার প্রান্তরে অত্যন্ত নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
প্রিয় নবী (সা.) দীর্ঘ ২৩ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে আরবের মতো একটি অসভ্য বর্বর জাতির মধ্যে আল্লাহর নির্দেশিত হক ও ইনসাফভিত্তিক কোরআনিক একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রিয় নবী (সা.)-এর ওফাতের পর ষড়যন্ত্রকারী ও সুযোগসন্ধানীরা আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে। মুনাফিকের বেশে তারা অত্যন্ত সুকৌশলে প্রিয় নবী (সা.)-এর সর্বজনীন ও সাম্যবাদী আদর্শে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী ও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রী বীজ ঢুকিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে পড়ল এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ল। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি মহানবী (সা.)-এর মহান সাম্যবাদী আদর্শ ও খোলাফায়ে রাশেদার ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থাকে পদদলিত করে একচেটিয়া ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক মুলকিয়াত তথা রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে ইসলামকে সমালোচিত ও কলঙ্কিত করে তুলেছিলেন। মুয়াবিয়া নিজে পবিত্র ইসলামে এ কুব্যবস্থা কায়েম করে ইসলামের মহান সাম্যবাদী আদর্শের কবর রচনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি, তাঁর মৃত্যুর পরও যেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পবিত্র ইসলামের নামেই স্থায়ী রূপ নেয়, সেজন্য তিনি তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর আগে তাঁর লম্পট, শরাবি, অযোগ্য কুলাঙ্গার ছেলে ইয়াজিদের স্থলাভিষিক্তের পক্ষে জোরপূর্বক উম্মাহর আগাম বায়াত গ্রহণ করে। এবং যারা এ বায়াতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করছে, তাদের প্রকাশ্য দিবালোকে জিন্দা মাটিতে পুঁতে হত্যা করেছে। ইতিহাস তার সাক্ষী। ৬০ হিজরি মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তারই পরিকল্পনানুযায়ী ছেলে ইয়াজিদ দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করে। ইয়াজিদ সিংহাসনে আরোহণ করে সর্বপ্রথম নজর দেয় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি। মদিনার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে ওকবাকে ইমামের বায়াত গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়। ইমাম হোসাইন (রা.) এই নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে ৪ শাবান মদিনা ছেড়ে মক্কা অভিমুখে রওনা দেন।
মুয়াবিয়ার আমল থেকেই ইরানের রাজা-বাদশাহদের মতো ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছিল মুসলিম রাজন্যবর্গ। সাম্রাজ্যবাদী নীতির কারণে নতুন নতুন দেশ বিজিত হওয়ার ফলে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ও ইসলামী সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে পড়েছিল। ইসলামের মহান মূল্যবোধ ও আদর্শগুলো বিদূরিত হয়ে গেল। ইসলামের এহেন ক্রান্তিলগ্নে আবার একটি মহান কোরবানি তথা শাহাদাত বা মহান সাক্ষীর একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ল। যিনি তাঁর মহান আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন। কে এই মহান দায়িত্ব পালন করতে পারেন?
আরবি 'শাহাদাত' শব্দের অর্থ হচ্ছে সাক্ষ্য দেওয়া। চেতনাকে জাগ্রত করা। এটি ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি এমন ব্যক্তির জন্য প্রয়োজন, যিনি মৃত্যুকে পছন্দ করেন। চেতনার মধ্যে চরম সত্যের উন্মেষ ঘটিয়ে সব প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়া। এখানে একজন সত্যদ্রষ্টা নিজেকে বিলীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এভাবেই সত্যকে দুনিয়ার বুকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুগে যুগে সত্যদ্রষ্টাদের আত্মোসর্গ বা মহান কোরবানি একান্ত অপরিহার্য।
যুক্তি-প্র
মাণের বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও (অল্প পরিসরে তা সম্ভব নয়) এ কথা গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন বারবার উত্থাপিত হয় এবং তা হলো, মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদ গংদের ইসলাম যদি সঠিক ইসলাম হয়, তাহলে হজরত আলী (রা.) এবং ইমাম হোসাইন (রা.)-এর জিহাদ ছিল কার বিরুদ্ধে? সত্য ও হকের সঙ্গে আলী এমন ওতপ্রোতভাবে মিশেছিলেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'সত্যই আলীকে অনুসরণ করে।'
শহীদ হচ্ছে আত্মোৎসর্গের সর্বোচ্চ এক পর্যায়। এর অর্থ হচ্ছে, উপস্থিত হয়ে সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য বহন করা বা সাক্ষ্য দেওয়া। তাই শাহাদাতের আসল অর্থ হচ্ছে, আপসহীন সর্বোৎকৃষ্ট সংগ্রাম। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দিকে একটু লক্ষ করুন- শাসকগোষ্ঠীর কুৎসিত চেহারা, যা পবিত্র ইসলামের লেবাসে ঢেকে রাখা হয়েছে। তিনি সেটাকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর আসল মোনাফেকি ও কুফুরি চেহারা জনগণের কাছে উন্মোচন করে দিয়েছেন। তিনি জানতেন, এভাবে একা শত্রুকে পরাস্ত করতে পারবেন না। কিন্তু জীবন দিয়ে হলেও তিনি সত্যকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারবেন এবং তিনি সেটিই করেছেন। তিনি যুগে যুগে সত্যানুসন্ধিৎসুদের হক ও ন্যায়ের পথে জিহাদ এবং শাহাদাতে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। ছয় মাসের শিশুপুত্র আজগরের রক্ত তিনি ঊর্ধ্বমুখে নিক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'হে আল্লাহ!, তুমি আমার শাহাদাত বা সাক্ষ্য গ্রহণ করো এবং আমার এই দুগ্ধপোষ্য সন্তানের কোরবানি গ্রহণ করো।'
এটা হচ্ছে, এমনই এক যুগসন্ধিক্ষণ, যখন একজন নেতার জীবন উৎসর্গ একটি জাতির অস্থিত্বকে টিকিয়ে রাখে এবং জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করে। এ শাহাদাত এমনই এক মাধ্যম, যার দ্বারা একটি জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আদর্শ সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়।
অস্ত্রহীন, ক্ষমতাহীন একাকী মানুষ তিনি। এ মুহূর্তে তাঁর ওপর সত্যের পক্ষে জিহাদ ও শাহাদাতের মহান দায়িত্ব আরোপিত। মৃত্যু ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। তবুও তিনি বেছে নিলেন সম্মানজনক মৃত্যুকে, যা আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয়। নির্ভুল পরিকল্পনা, কার্যকরণ বিবেচনা, অত্যুজ্জ্বল সঠিক সুপরিকল্পিত বিদায়। হিজরত ও আন্দোলনের পক্ষে, দ্বীন ও হকের পক্ষে শাহাদাতের ভূমিকাটি কত সুন্দরভাবেই না তিনি আনজাম দিয়ে চলেছেন। ধীরে ধীরে তনি ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছেন। প্রতিটি বিষয়ে তিনি স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন, অদ্ভুত তাঁর সঙ্গী নির্বাচন, ছয় মাসের শিশু আজগরকেও তিনি সহযোদ্ধা নির্বাচন করেছেন। পরিবারের সবাইকে নিয়েই তিনি আল্লাহর রাস্তায় কোরবানির উদ্দেশ্যে রাওনা হলেন। ইব্রাহিম (আ.) ছেলে ইসমাইলকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন আর এখানে মুহাম্মদ (সা.)-এর পুরো পরিবারটি আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি হতে চলেছেন।
ইয়াজিদের প্রেতাত্মারা আজ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিকামী জনতার বিরুদ্ধাচরণ করে নির্বিচারে এ দেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে খেলেছে। আজ আবার তারা ইসলামের লেবাস পরে বোমাবাজি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিরাপরাধ মানবহত্যায় মেতে উঠেছে। তারা এ সোনার বাংলাকে মৌলবাদী আফগানে পরিণত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সত্যিকার ওলামায়ে রাব্বানি ও হাক্কানি, পীর মাশায়েখকে হোসাইনি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মোনাফেক, কাফের ইয়াজিদ গংদের বিরুদ্ধে যথার্থ জিহাদে নেমে পড়া। আজ পবিত্র আশুরায় কারবালার এই মহান চেতনাই যেন আমাদের পাথেয় হয়। আমরা যেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ছদ্মবেশী এই হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত করে একটি সুখী সমৃদ্ধশীল সাম্যবাদী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। সত্যের পক্ষে ও অসত্য, অন্যায় এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রত্যেকেই যেন শাহাদাতের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারি। কারণ শাহাদত হচ্ছে সে কাজ, যা মানুষের মনুষ্যত্বকে, চেতনাকে জাগ্রত করে। শাহাদাত হচ্ছে শয়তানি অপশক্তির ওপর দৃঢ়চেতা ইমানের এক কালজয়ী উত্থান। শাহাদাত হচ্ছে একটি দরজা, একটি উত্থান, একটি উন্নতর অবস্থান, মুক্তির দ্বার, সুউচ্চ মর্যাদা এবং মানবজীবনের পূর্ণতা। শাহাদাত হচ্ছে মুক্তির পথে একটি আহ্বান, সব যুগে, সব মানুষের জন্য
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন