আল-কায়েদার সহিংসতার শিকার এক ইরাকি নারীর আত্মকথা

আল-কায়েদার সহিংসতার শিকার এক ইরাকি নারীর আত্মকথা

‘উম্মে সালমা’ বয়স ২৩, বাবা ছিলেন আল-কায়েদা নেতা। তিনি কখনই ভাবেননি যে, তার পিতা তাকে এমন একটি বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য করবেন, যার করুণ পরিণতি তার স্বামী ও শিশু সন্তানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঘটবে।
ইরাকি এ নারী বলেন : এ ঘটনা আমি এ পর্যন্ত কারো নিকট বর্ণনা করিনি। আমি একজন সৌদি নাগরিকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। সে দিয়ালি অঞ্চলের একটি সংঘর্ষে নিহত হয়েছিল। আমি চাই আপনার মাধ্যমে আল-কায়েদার বিভিন্ন গোপন অপরাধকর্মের কথা প্রকাশ করতে, যার শিকার হয়েছে অগণিত নারী। তারা বর্তমানে পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের জননী। আমার মত অনেকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হয়েছে।
ঘটনাটি হচ্ছে ঐ সময়কার যখন ইরাকের দিয়ালা প্রদেশের ওপর আল-কায়দা জঙ্গীদের কর্তৃত্ব ছিল।
২০০৫ সালে আমার বাবা আল-কায়েদার জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করতো। তিনি প্রতিদিন আরবি পোশাক পরা ৩ জন লোকের সাথে বাড়ীতে আসতেন –যাদের কথাবার্তা শুনে বোঝা যেত যে, তারা ইরাকি নয়- এবং আমার মাকে বলতেন তারা মসুলের অধিবাসী।
হঠাত একদিন বাবা বাড়ীতে এসে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নিতে বললেন এবং এও জানালেন যে, কয়েক ঘন্টার বেশী সময় হাতে নেই। আমার মা আমাকে শুধু এতটুকুই বললেন যে, আমি একজন সৌদি নাগরিকের স্ত্রী হতে যাচ্ছি। ঐ রাতের জন্য প্রস্তুতকৃত কামরায় আমাকে রাখা হলো। কিছুক্ষণ পর একজন পুরুষ কামরায় প্রবেশ করে সালাম বিনিময়ের পর হিংস্র পশুর মত আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে একনাগাড়ে চারদিন আমার সাথে যৌন মিলন করে, সে আমার সাথে কোন কথাই বলতো না। শুধুমাত্র সহবাসের ইচ্ছা প্রকাশের জন্য সে আমার সাথে কথা বলতো এছাড়া আর কোন কথা বলতো না।
পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের জন্ম
এ বাধ্য বিয়ের পর আল কায়েদার অনেক গোপন তথ্যের কথা জানতে পারলাম, যেমন ; কিভাবে তাদেরকে আম্বার প্রদেশ হতে দিয়ালা প্রদেশের বিভিন্ন বাগানে স্থানান্তরিত করা হয়। এটাও জানতে পারলাম যে, তারা এ অঞ্চলের মেয়েদেরকে বিয়ে ও শরিয়তের নামে তাদের হিংস্র যৌনতার শিকারে পরিণত করে। আমি এমন ৫০ জন নারীকে চিনি, তাদের অনেকের সন্তানরা জানে না যে, কে তাদের বাবা! তাদের মায়েদের সাথে বহু পুরুষের মিলনের ফলে এমনটি হয়েছে। আল কায়েদা পরবর্তীতে এ সকল নারীদেরকে আত্মঘাতী হামলার কাজেও ব্যবহার করেছে।
(বলা হয় যে, আল কায়েদা ইরাকি নারীদেরকে আনসার ও মুহাজিরের নামে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আসতো। আর এ কারণে এ সকল নারীদের বৃহত সমস্যাবলীর অন্যতম হচ্ছে তাদের সন্তানরা জানে না যে, কে তাদের বাবা। কেননা তাদেরকে অল্প দিনের জন্য কয়েকজন পুরুষের সঙ্গ দিতে বাধ্য করা হত।)
আল কায়েদার হিংস্রতার শিকার ‘উম্মু সালমা’ এ সকল নারী ও তাদের সন্তানদেরকে ইরাকি পরিচয়পত্র দানের জন্য ইরাক সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
যখন ইরাকের এ সকল অসহায় নারী নিজেদের শরীরে অনায়াসে আত্মঘাতী বোমা বাঁধে
তিনি বলেন : আল কায়েদার সাথে জড়িত এ সকল নারীরা, নিরাপত্তা বাহিনী’র উপর হামলার বিষয়ে জঙ্গী এ দলটির বিভিন্ন নীল-নকশা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। আল কায়েদার বার্তাসমূহেকে বিভিন্ন প্রদেশে পৌঁছানো ছিল তাদের অন্যতম কাজ। এছাড়া ইরাকি এবং মার্কিন ঘাঁটির ওপর হামলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্যও তারা সংগ্রহ করতো। ‘রাজা’, ‘রানিয়া ইব্রাহিমে’র –যারা ছিল ছিল আত্মঘাতী- মত অনেক নারী রয়েছে; যাদের কেউ কেউ ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনী’র হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে, আবার কেউ কেউ তাদের স্বামীদের সাথে ইরাক ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছে।
আল কায়েদার বিষয়ে গবেষণাকারী বিশিষ্ট গবেষক ‘আব্দুল্লাহ খলিফা’ এ সম্পর্কে বলেন : এ বিষয়টি বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। আল কায়েদার জঙ্গীরা তাদের যৌন লালসা মেটানোর জন্য অল্পবয়সী মেয়েদেরকে ব্যবহার করে। অতঃপর ধর্মের নামে তাদের কোমরে আত্মঘাতী বোমার বেল্ট বেঁধে দেয়, আর এভাবেই নির্মমভাবে তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
ইরাকের সর্বপ্রথম আত্মঘাতী নারী ছিলেন বেলজিয়ামের অধিবাসী
তিনি বলেন : ২০০৪ সালে যখন আল কায়েদার ইরাক শাখা ‘আবু মুসয়াব যারকাভি’র নেতৃত্বে তত্পর ছিল ঐ সময় সর্বপ্রথম এক নারী আত্মঘাতী হামলা চালায়। আত্মঘাতী ঐ নারী ছিল বেলজিয়ামের নাগরিক এবং তার নাম ছিল ‘মারিল দিগুক’। সে এ পদক্ষেপের মাধ্যমে অন্যান্য নারীদের জন্য আত্মঘাতী হামলা চালানোর পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
২০০৭ সাল হতে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নারীরা ৩৭টি আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে
খলিফা বলেন : ২০০৭ হতে ২০০৯ সাল নাগাদ দিয়ালা ও আল আনবার প্রদেশে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল আল কায়েদা। তারা এ সকল অসহায় নারীদের ব্যবহার করে ৩৭টি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটায়। অবশ্য আল কায়েদার আত্মঘাতী হামলার সাথে জড়িত নারীদের বিশাল একটি নেটওয়ার্ককে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছিল ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী।
‘বেহেশতের কবুতর’ নাম দিয়ে ইরাকি শিশু-কিশোরদেরকে প্রতারিত করেছে আল কায়েদা
যখন আল কায়েদার এ প্রতারণা সকলের সম্মুখে প্রকাশিত হল, তখন তারা ‘বেহেশতের কবুতর’ নামে নতুন একটি সংগঠন চালু করলো। তারা এর মাধ্যমে শিশু-কিশোরদেরকে ব্যবহার করে ২৫টি আত্মঘাতী হামলা চালায়।
স্বামীর মৃত্যুর পর এক নারীকে প্রতারণা করে আত্মঘাতী বানালো আল কায়েদা
২০০৭ সালে ইরাক-যুক্তরাষ্ট্র যৌথবাহিনী’র হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আত্মঘাতী হামলাকারী এক নারীর বোন তার বোনের বিষয়ে এভাবে বলেছেন যে, আল কায়েদা আমাদের সামাজিক স্ট্যাটাসের অপব্যবহার করে। অজ্ঞাত সশস্ত্র ব্যক্তিরা আমার ভাইকে অপহরণ করে তার মুক্তিপণ বাবদ ৭০ হাজার ডলার দাবী করে। ঐ সময় আমরা একটি শিয়া অঞ্চলের জীবন-যাপন করতাম। বাধ্য হয়ে আমরা আমাদের বাড়ী বিক্রয় করে মুক্তিপণের টাকা যোগাড় করি, অতঃপর বাকুবার একটি এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে তাতে উঠি।
আমাদের ভগ্নিপতি ছিলেন দৌলাতে ইসলামিয়ে ইরাকে’র সদস্য –এ বিষয়ে আমরা কেউ কিছুই জানতাম না- তিনি আমার ভাইয়ের অপহরণ ও মুক্তিপণের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখান। মার্কিন বাহিনী’র সাথে এক সংঘর্ষে তার দুই বন্ধুর সাথে তিনি নিহত হন। কয়েকদিন পর ‘আবু হুযাইফা’ নামক এক ব্যক্তি আমার বোনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে তার স্বামীর বিষয়ে কথা বলার জন্য তার সাথে দেখা করার কথা বলে। সে টেলিফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে দু’দিন আমার বোনের সাথে কথা বলার পর অবশেষে তাকে রাজি করায়।
অতঃপর ঐ লোকটি আরেকজন লোকের সাথে একটি অত্যাধুনিক গাড়ীতে করে আমার বোনকে নিতে আসে এবং আত্মঘাতী বোমাধারী বেল্ট তার কোমরে বেঁধে দেয়, যাতে সে এ বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজের স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে। অতঃপর তাকে নিরাপত্তা বাহিনী’র সৈন্যদের নিকট নামিয়ে দেয়। কিন্তু কোন ত্রুটির কারণে উক্ত বেল্টটি বিস্ফোরিত হয়নি এবং আমার বোন গ্রেপ্তার হয়। এর পর আদালত তাকে ৭ বছর কারাদণ্ড দেয়।
আল কায়েদার সন্তানদেরকে পরিচয় পত্র দিতে ইরাক সরকারে অসম্মতি
ইরাকের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক কমিশনের সদস্য ‘হাকেম যামলী’ বলেন : এ শিশুদেরকে পরিচয় পত্র দান করা অগ্রহণযোগ্য একটি বিষয়।
তিনি বলেন : এ বিষয়টি এখনো পর্যন্ত ইরাকের জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয় নি। আর যদি উত্থাপন করা হয় তবে যে দলটি এ বিষয়টি উত্থাপন করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে! জাতির রক্তে রঞ্জিত এ দলটির হাত এবং ইরাকের অভ্যন্তরে তাদেরকে কোন প্রকার বৈধতা প্রদান করা সম্ভব নয়।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন