কারালার বিয়োগান্তক ঘটনার পরে হজরত জয়নাব (সা.আ.)
কারালার বিয়োগান্তক ঘটনার পরে হজরত জয়নাব (সা.আ.)
ইতিহাস সাক্ষী যে, কারবালার রক্তাক্ত ও নজিরবিহীন বিয়োগান্তক ঘটনা হযরত জয়নাবকে (সা.) দৃঢ়তর করেছিল। যে জয়নাব মদীনা থেকে বের হয়ে এসেছিলেন আর যে জয়নাব শাম নগরী থেকে মদীনাতে ফিরে আসেন এক রকম ছিলেন না বরং তিনি পরিপক্বতা ও আন্তরিকতায় ভরা ছিলেন।
হযরত আলী (আ.) ও ফাতেমা যাহরার (সা.) বিবাহের ফল হযরত যায়নাব (সা.) ৫' ই জমাদি আল উলা পঞ্চম কিম্বা ষষ্ঠ হিজরি সনে এ পৃথিবীতে আগমন করেন। পাঁচ (বা ছয়) বছরের ছিলেন যখন তাঁর নানা হযরত মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। বারো বছর বয়সে নিজের চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাফারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। চার মতান্তরে পাঁচটি সন্তান এ বিবাহের ফল ছিল যাদের মধ্যে আওন ও মোহাম্মদ নামে দুটি সন্তান কারবালাতে শাহাদাত বরণ করেন।
একটি প্রসিদ্ধ রেওয়ায়েত মতে হযরত যায়নাব (সা.) ১৫' ই রজব ৬২ হিজরি সনে এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন। এ প্রবন্ধে আমরা তাঁর জীবনী থেকে কিছু বিষয় আলোচনা করবো।
হযরত জয়নাব (সা.) এর ইবাদত:
ইসলামের এ মহীয়সী নারীর একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, আত্মিক অবস্থা ও বিশ্ব সৃষ্টিকর্তার সাথে তাঁর দৃঢ় সম্পর্ক। বর্ণিত হয়েছে যে, মহরম মাসের ১১ তারিখের রাতেও যা আশুরার দিনগত রাত বা শামে গারিবাঁর রাতেও তিনি তাহাজ্জুদের নামায বাদ দেননি। অবশ্য দুর্বলতার কারণে সেই রাতে বসে বসে তিনি তাহাজ্জুদের নামায আদায় করেন। (হায়াতুল ইমাম হুসাইন (আ.), বাকের শারিফ আল ক্বারাশি, পৃষ্ঠা: ৩০৯)
ইবাদতের সময় হযরত জয়নাব (সা.) ঠিক হযরত যাহরার (সা.) সদৃশ ছিলেন। সারা রাত ইবাদত, তাহাজ্জুদ ও কোরান তেলাওয়াত করে অতিক্রান্ত করতেন। তাঁর সারা জীবনে তাহাজ্জুদের নামায ও রাত জেগে ইবাদত করা বাদ যায়নি, এমনকি আশুরার দিনগত রাতেও তিনি ইবাদত বন্দেগী করেছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর বোন জয়নাবের সাথে শেষ বিদায়ের সময় তাঁকে বলেছেন:
« يا اختاه لا تنسينى فى نافلة اللّيل »
হে বোন আমার ! তাহাজ্জুদের নামাজে আমাকে ভুলে যেও না। তদ্রূপ ফাতেমা বিনতে হুসাইন (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, আমার ফুফু জয়নাব (সা.) দশ'ই মহরমের রাতে ইবাদতের মেহরাবে দোয়া ও মোনাজাতে মশগুল ছিলেন এবং আমাদের চক্ষুদয় তখনও ঘুমায়নি কিন্তু তিনি খোদার সাথে প্রার্থনা করছিলেন এবং আমাদের বিলাপ ও ক্রন্দন তখনও শেষ হয়নি। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আমাদেরকে যখন কুফা হতে শাম নগরীর দিকে রওয়ানা দেওয়া হল আমার ফুফু জয়নাব (সা.) নিয়মিত নিজের ফরজ ও সুন্নত নামাযগুলো পাঠ করছিলেন। আর কোন কোন স্থানে বসে বসে নিজের নামায আদায় করেছেন। যখন তার কারণ জিজ্ঞেস করলাম তিনি বললেন: ক্ষুধার্ত ও দুর্বলতার কারণে। কেননা তিন দিন দিবা -রাত্রি তিনি কোন খাবার খাননি এবং নিজের ভাগটুকু শিশুদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। (জয়নাবুল কোবরা, জাফার নাক্বদি, পৃষ্ঠা: ৬১; আসিরান ওয়া জান বাযানে কারবালা, মোহাম্মদ মোযাফ্ফারি, পৃষ্ঠা: ৮৯)
হযরত জয়নাব (সা.) এর আধ্যাত্মিকতা
মহীয়সী নারী হজরত জয়নাব (সা.আ.) আল্লাহ ও আধ্যাত্মিকতা জ্ঞান সম্পর্কে এমন উচ্চতর মর্যাদা সম্পন্ন ছিলেন যে, আশুরার বিরাট বিয়োগান্তক ঘটনা ও বন্দী হওয়া সত্ত্বেও যখন ইবনে যিয়াদ জিজ্ঞেস করলো যে, নিজের আহলে বায়তের সাথে খোদার ব্যবহার কেমন দেখলে ? তিনি বললেন:
« ما رَأَيْتُ الَّا جَميلًا »
ভালত্ব ও সৌন্দর্য ছাড়া অন্য কিছু দেখিনি। (বিহারুল আনওয়ার, ৪৫' তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১১৫; আল লোহুফ, পৃষ্ঠা: ১৬০)
তদ্রূপ ইয়াজিদের দরবারে এক খুতবা বলার পর বললেন: সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা সেই খোদার যিনি দু'জাহানের পালন কর্তা, তিনি সেই সত্ত্বা যিনি আমাদের প্রথম ও সূচনার কাজকে সৌভাগ্য ও সুখ শান্তিতে এবং আমাদের সমাপ্তিকে শাহাদাত ও রহমতে শেষ করেছেন। (যায়নাবে কুবরা, ফাইযুল ইসলাম, পৃষ্ঠা: ১৬৮)
এরূপ ব্যাখ্যা -বিশ্লেষণ, আহলে বায়ত (আ.) এর তৌহীদ ও একত্ববাদের মারেফতেরই প্রমাণ করে। আর এরূপ উচ্চতর এরফানি ও আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ ব্যাখ্যা -বিশ্লেষণ, ইসলামের প্রকৃত জ্ঞানী আরিফদের খোদা প্রদত্ত কথা হতে পারে। আর এ এলাহী ব্যক্তিত্বরা নিজের আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ কথাবার্তাকে কোরান ও আহলে বায়ত (আ.) হতে শিক্ষা অর্জন করেছেন।
হযরত জয়নাব (সা.) এর জ্ঞান
হযরত জয়নাব (সা.) আত্মার পরিশুদ্ধির পথে পা রাখার সাথে সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের করুণা প্রাপ্ত হন। তিনি তাঁর নানা, বাবা, মা ও ভাইদের যারা খোদা প্রদত্ত জ্ঞানের ভাণ্ডারের সাথে সম্পৃক্ত তাদের সান্নিধ্যে শিক্ষা লাভ করেছেন এবং জ্ঞানের এমন এক মর্যাদায় পৌঁছেছেন যে, তার পদমর্যাদাকে অন্যান্য ব্যক্তিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। তাছাড়া, ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে:
« انتِ بحمد الله عالمة غير معلمة »
হযরত জয়নাব (সা.) ঐশ্বরিক জ্ঞানের ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ফয়েযের অধিকারী ছিলেন। (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড: ৪৫, পৃষ্ঠা: ১৬৪; যায়নাবে কুবরা, ফায়যুল ইসলাম, পৃষ্ঠা: ১৩৪)
হযরত জয়নাব (সা.) নারীদের জন্য বিভিন্ন সময়ে ফিকাহ বিষয়ে ও কোরানের তফসির বর্ণনা করতেন এবং মদীনা বাসীদের জন্য ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর পক্ষ হতে কিছু সময়ের জন্য আহকাম ও ফতোয়ার বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর থেকে অনেক রেওয়ায়েত বর্ণনা করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ হযরত যাহরার (সা.) খুতবা। (দ্রষ্টব্য: যায়নাব বিনতুল ইমাম আমিরুল মোমেনিন, পৃষ্ঠা: ১১; শরহে নাহজুল বালাগা, ইবনে আবিল হাদিদ, ১৬' তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২১১)
হযরত জয়নাব (সা.) এর সবর ও ধৈর্য
হযরত জয়নাব (সা.) এর ওপর যে বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটেছে, যা লেখা ও বর্ণনা করা সম্ভব নয়; একের পর এক কষ্ট যা একটি পাহাড়কেও টুকরো টুকরো করে ফেলতো, কিন্তু এ মহীয়সী নারী সমস্ত এ ঘটনাগুলোকে সহ্য করেছেন এবং আল্লাহর দরবারে পরীক্ষার মাঠে নিজের ভূমিকা ভালমতো পালন করেন।
তাঁর ধৈর্য সম্পর্কে এতোটুকুই যথেষ্ট যে, কয়েকজন ভাই ও তাদের সন্তান ও নিজের দুটি সন্তানের শাহাদাতে ধৈর্য ধরেছেন এবং আশুরার বিকেলে যখন কতল করার স্থানে ভায়ের মৃতদেহর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আকাশ পানে চেয়ে বললেন: হে খোদা ! আমাদের হতে এই ছোট্ট কোরবানিকে তুমি কবুল কের নিও। (যায়নাবে কুবরা, ফায়যুল ইসলাম, পৃষ্ঠা: ১৮৪)
হযরত জয়নাব (সা.) এর বীরত্ব ও সাহসিকতা
অন্যান্য ফযিলতের মত হযরত জয়নাব (সা.) এর বীরত্ব ও সাহসিকতাও ঔজ্জ্বল্য ও আলোকিত ছিল। যদিও হযরত জয়নাব (সা.) এর নিকটাত্মীয়রা একই দিনে শাহাদাত বরণ করেছেন এবং এক স্থান হতে অন্য স্থানে রেসালতের খান্দানের নারী ও শিশুদের সাথে বন্দী হয়ে চলেছেন, বীরত্ব ও সাহসিকতা ও অটলতার সাথে কারোর প্রতি মনোযোগ না দিয়েই ওবাইদুল্লাহর দরবারে প্রবেশ করেন। আর ইবনে যিয়াদকে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে তার কোন কথার জবাব দেননি এবং তার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন মনে না করে বসে পরলেন। অতঃপর বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে এমন এক খুতবা পাঠ করলেন যে, সেই সময়কার ও সে যুগের কোন বীর পুরুষই তার কিছু অংশও বলার সাহস পেতোনা। শ্যাম নগরীতেও ইয়াজিদের দরবারে প্রবেশ করলেন এবং গরম এক খুতবা পাঠ করলেন এবং ইয়াজিদ মিত্রদের হুকুমতকে নড়বড়ে করে দিলেন।
সেই দরবারে যখন একজন শামবাসী ইয়াজিদের কাছে ইমাম হুসাইন (আ.) এর কন্যাকে কানিয (বাঁদি) স্বরূপ নিতে চাইলো, তখন সেই শামের লোককে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বললেন যে, তোমার এ অযাচিত চাওয়ার মাধ্যমে তুমি হীনমন্যতার কাজ করেছ, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই কন্যাকে না তোমার জন্যে নির্ধারণ করেছেন না তোমার আমিরের জন্য ! ইয়াজিদ এই কথাতে রাগান্বিত হয়ে বলে: "আল্লাহর কসম, এ কন্যাকে বাঁদি করা আমার জন্য সহজ কাজ। আর যদি আমি ইচ্ছা করি এ কাজটি করতে পারি"। হযরত জয়নাব (সা.) বললেন: খোদার কসম, এরূপ কাজের অধিকার তোমার নেই কিন্তু যদি আমাদের ধর্ম (ইসলাম) হতে বেরিয়ে এসো এবং অন্য ধর্ম গ্রহণ করো ! (বুযুর্গ যেনানে সাদরে ইসলাম, আহমাদ হায়দারি, পৃষ্ঠা: ২৩১)
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন