ইসলামি মাযহাবসমূহের দৃষ্টিতে ইমাম মাহদী (আ.)
(.ইসলামি মাযহাবসমূহের দৃষ্টিতে ইমাম মাহদী (আ
সুন্নি মাযহাবের হাদীস থেকে:
১। রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত মাহ্দী (আ.)এর অবশ্য আবির্ভাবের ব্যাপারে বলেছেন: “যদি দুনিয়ার বয়স শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকী থাকে, আল্লাহ্ আমাদের বংশের থেকে একজনকে পাঠাবেন
এই দুনিয়াতে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, যতই অন্যায় ও অত্যাচার দুনিয়াকে গ্রাস করে ফেলুক”।
দেখুন: মুসনাদে আহ্মাদ বিন হাম্বাল, খণ্ড -১, পৃ. -৯৯, বৈরুত পুরাতন প্রিন্ট।
২। নবী (সা.) বলেছেন: “ততদিন পর্যন্ত ক্বিয়ামত আসবে না যতদিন পর্যন্ত না আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে একজন এই দুনিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করবে, যার নাম আমার নামের অনুরূপ”।
মুসনাদে আহ্মাদ বিন হাম্বাল, খণ্ড -১, পৃ. -৩৭৬ ও ৪৩০, বৈরুত পুরাতন প্রিন্ট।
৩। নবী (সা.) বলেছেন: “যেমন আলী আমার পরে উম্মাতের ইমাম তদ্রূপ ক্বায়েম মুন্তাযার (তাঁর সন্তানদের মধ্যে থেকে) যখন আবির্ভাব করবে যমিনকে ন্যায়পরায়ণতায় ও আদর্শে ভরে দেবে, এই দুনিয়া যতই জুলুম ও অত্যাচারে ভরে থাকুক না কেন। তাঁর কসম যিনি আমাকে সত্য পৌঁছে দেয়া ও ভয় প্রদর্শনের জন্য পাঠিয়েছেন। সন্দেহাত্বীতভাবে তারাই চিরস্থায়ী বা অমর যারা কিনা তাঁর অদৃশ্য থাকা সত্বেও তাঁর উপর ঈমান রাখে”।
যাবির উঠে দাড়িয়ে বলল: ইয়া রাসূল আল্লাহ্, আপনার সন্তানদের মধ্যে ক্বায়েম অদৃশ্যে থাকবে?
তিনি বললেন: “হ্যাঁ আমার আল্লাহ্র কসম। মু’মিনরা পরীক্ষিত আর কাফেররা ধ্বংস হয়ে যাবে। ওহে যাবির এই নির্দেশ আল্লাহ্রই একটি নির্দেশ। এই রহস্যপূর্ণ বিষয়টি তার গুপ্ত বিষয়াবলীর মধ্যে একটি। যা তার বান্দাদের কাছে গোপন রেখেছেন, এটার ব্যাপারে সন্দেহ করা থেকে দুরে থাক কেননা আল্লাহ্র নির্দেশের ব্যাপারে সন্দেহ করা কাফেরী কাজ”।
মুসনাদে আহ্মাদ বিন হাম্বাল, খণ্ড -১, পৃ. -৩৭৬ ও ৪৩০, বৈরুত পুরাতন প্রিন্ট।
৪। সালমানে ফার্সী (রহ.) বলেন: একদিন নবীজির কাছে পৌঁছে দেখলাম,হুসাইন বিন আলীকে নিজের উরুর উপর বসিয়ে তার চোখ ও ঠোটে চুমা দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন: “তুমি সাইয়্যেদ, সাইয়্যেদের সন্তান ও সাইয়্যেদের ভাই, তুমি ইমাম, ইমামের সন্তান ও ইমামের ভাই, তুমি আল্লাহ্র হুজ্জাত,হুজ্জাতে খোদার সন্তান ও হুজ্জাতে খোদার ভাই, তুমি নয়জন হুজ্জাতে খোদার পিতা তাদের মধ্যে নবম জন হচ্ছে ক্বায়েমে মুনতাযার”।
ইউনাবিউল মাওয়াদ্দাহ্, পৃ. -৪৯২।
৫। ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন: “হাসান বিন আলী আসকারীর স্থলাভিষিক্ত উপযুক্ত সন্তানই সাহেবুযযামান (যমানার মালিক) আর সেই হচ্ছে মাহ্দী মওউদ”।
ইউনাবিউল মাওয়াদ্দাহ্, পৃ. -৪৯১।
৬। হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) বলেছেন: “তোমাদেরকে মাহ্দীর সুসংবাদ দিচ্ছি, সে আমার উম্মতের মধ্যেই অভিষিক্ত হবে। যখন আমার উম্মত মতপার্থক্য ও পদস্থখলনের মধ্যে থাকবে। সুতরাং যমিনকে পরিপূর্ণভাবে ন্যায়পরায়ণতায় ও আদর্শে ভরে দেবে। তা যতই জুলুম ও অত্যাচারে ভরে থাকুক না কেন। আসমান ও জমিনের সকলেই তাঁর উপর সন্তুষ্ট হবে... ”।
মুসনাদে আহ্মাদ বিন হাম্বাল, খণ্ড -২, পৃ. -৩৭, বৈরুত পুরাতন প্রিন্ট।
৭। ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন: “যে লোকের সাধুতা থাকে না তাঁর কোন দ্বীন নেই। তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহ্র কাছে অধিক প্রিয় যার পরহেজগারীতা সকলের ঊর্ধ্বে। পরে আরও বলেন: আমার বংশের চতুর্থ সন্তান যে এক সম্ভ্রান্ত কানিযের সন্তান আল্লাহ্ তাঁর মাধ্যমে যমিনকে যে কোন ধরনের জুলুম ও অন্যায় থেকে মুক্তি দিবেন এবং সে ওই ব্যক্তি যার ভূমিষ্ঠের ব্যাপারে মানুষের সন্দেহ থাকবে। সে অদৃশ্যে থাকবে। যখন আবির্ভূত হবেন তখন যমিন আল্লাহ্র নূরে নূরানীত হবে। আর মানুষের মাঝে ন্যায়ের মাপকাঠি স্থির করবে। যার কারণে কেউ অন্যের বিরুদ্ধে অত্যাচার করতে পারবে না… "।
ইউনাবিউল মাওয়াদ্দাহ্, পৃ. -৪৪৮।
৮। আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) বলেছেন: “আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন একটি দলকে আনবেন যারা তাকে ভালবাসে এবং তিনিও তাদেরকে ভালবাসেন। তাদের মধ্যে সেই তাঁর প্রতিনিধিত্বের পর্যায়ে পৌঁছাবে যে বর্তমানে পর্দার আড়ালে গোপন। সে হচ্ছে মাহ্দী মওউদ (ইমাম মাহ্দী) ... যমিনকে পরিপূর্ণভাবে আদর্শ ও ন্যায়পরায়ণতায় ভরে দিবে এবং এ কাজে করতে তাঁর কোন প্রকার সমস্যা বা অসুবিধা হবে না। শিশু বয়সেই সে তাঁর বাবা -মার কাছ থেকে দুরে থাকবে ... মুসলমানদের অঞ্চলগুলোকে নিরাপত্তার সাথে জয় করবে। সময় তাঁর জন্যে প্রস্তুত ও পরিচ্ছন্ন হবে। তাঁর কথায় যুক্তি থাকবে এবং নবীন -প্রবীণ সকলেই তাকে অনুসরণ করে চলবে। ঠিক যে সময় তাঁর ইমামত পরিপূর্ণতায় পৌঁছাবে ও তাঁর খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে সে সময় যারা কবরে শুয়ে আছে তাদেরকে আল্লাহ্ তা’য়ালা পুনরায় জীবিত করবেন। তাদের সকাল হবে যখন তারা তাদের কবরের মধ্যে থাকবে না। এই পৃথিবী ইমাম মাহ্দী(আ.তা. ফা. শা.) এর পরশ পেয়ে তার হারিয়ে যাওয়া রূপ বা সৌন্দর্যকে পুনরায় ফিরে পাবে। চারিদিক ফুলে -ফলে, শস্য -শ্যামলে ভরে উঠবে, নদ -নদী নির্মল পানির কলতানে বয়ে যাবে, পাখিরা কিচির -মিচির শব্দে নেচে গেয়ে ঘরে ফিরবে। মানুষের অন্তরগুলি অন্যায়, পাপাচার, শত্রুতা, ফিতনা থেকে দুরে সরে গিয়ে একে অপরের প্রতি ভালবাসায়, ভালকাজে লিপ্ত হবে। আর তাদের সবকিছুই তখন বরকতময় হয়ে উঠবে। এর বেশী কিছু বলার প্রয়োজন দেখছি না শুধুমাত্র ঐ দিনের প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইলো”।
ইউনাবিউল মাওয়াদ্দাহ্, পৃ. -৪৬৭।
শিয়া মাযহাবের হাদীস থেকে:
১। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন: “মানুষ তাদের ইমামকে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে হজ্ব মৌসুমে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে দেখে। কিন্তু মানুষ তাকে দেখতে পায় না”।
উছূলে কাফি, খণ্ড -১, পৃ. -৩৩৭।
২। আসবাগ বিন নাবাতাহ্ বলেন: আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) এর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাকে চিন্তায় মগ্ন থাকতে দেখলাম, তিনি আঙ্গুল মোবারক দিয়ে মাটিতে টোকা দিচ্ছিলেন। বললাম: আপনাকে কেন চিন্তিত লাগছে,আপনি কি দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা রাখেন?
বললেন: “না, আল্লাহ সাক্ষী কখনও এই দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা আমার ছিল না বা এখনও নেই। এক জাতকের বিষয়ে চিন্তা করছি যে আমার বংশ থেকে আসবে এবং আমার সন্তানদের মধ্যে একাদ্বশতম ব্যক্তি সে। তার নাম“মাহ্দী”। সে দুনিয়াকে ন্যায়পরায়ণতায় ও আদর্শে ভরে দেবে। তা যতই জুলুম ও অত্যাচারে ডুবে থাকুক না কেন। সে অদৃশ্য অবস্থায় থাকবে যার কারণে একদল ধ্বংস প্রাপ্ত হবে এবং অন্য একদল হবে হেদায়ত প্রাপ্ত ...”।
উছূলে কাফি, খণ্ড -১, পৃ. -৩৩৮।
৩। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন: “যদি তোমাদের কাছে খবর পৌছায় যে,যমানার ইমাম অদৃশ্যে আছেন তবে তাঁর এই অদৃশ্য হওয়ার খবরটিকে অস্বীকার করবে না”।
উছূলে কাফি, খণ্ড -১, পৃ. -৩৩৮।
৪। তিনি আরও বলেছেন: “ক্বায়েম (ইমাম মাহ্দী) দুইটি অদৃশ্যতে থাকবে যার একটি স্বল্প মেয়াদী এবং অন্যটি দীর্ঘ মেয়াদী। স্বল্প মেয়াদী অদৃশ্যতে তাঁর প্রকৃত অনুসারী ছাড়া তাকে কেউ দেখতে পাবে না এবং দীর্ঘ মেয়াদী অদৃশ্যতে তাঁর অতি নিকটের লোকেরা ছাড়া অন্য কেউ তাঁর ব্যাপারে জানতে পারবে না”।
উছূলে কাফি, খণ্ড -১, পৃ. -৩৪০।
৫। তিনি আরও বলেছেন: “ক্বায়েম (ইমাম মাহ্দী) এমন সময় কিয়াম করবে যখন তার প্রতি কেউ চুক্তিতে আবদ্ধ নয় বা কেউ তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে নি”।
উছূলে কাফি, খণ্ড -১, পৃ. -৩৪২।
৬। নবী করিম (সা.) বলেছেন: “কায়েম (ইমাম মাহ্দী) আমার সন্তান, তার নাম ও ডাক নাম আমার নাম ও ডাক নামের অনুরূপ। দেখতেও অবিকল আমার মত। শরীরের গড়ন ও গঠন আমার মতই। তার সুন্নতই হচ্ছে আমার সুন্নত। মানুষকে আমার দ্বীন ও শরিয়তের এবং আল্লাহ্র কিতাবের প্রতি দাওয়াত দেবে। যারা তাকে অনুসরণ করবে তারা আমাকে অনুসরণ করলো এবং যারা তাঁর সাথে বিরোধিতা করবে তারা আমার সাথে বিরোধীতা করলো। আর যারা তাঁর অদৃশ্য থাকাকে অস্বীকার করবে তারা আমাকে অস্বীকার করলো”।
আ’য়ালামুল ওয়ারা, পৃ. -৪২৫।
৭। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেছেন: “আমাদের ক্বায়েমের (ইমাম মাহ্দী) সাথে বিভিন্ন নবীদের মিল রয়েছে। যেমন মিল রয়েছে নূহ, ইব্রাহীম, মুসা,ঈসা, আইয়ুব ও হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) এর সাথে। নূহ নবীর সাথে বয়সের দিক দিয়ে। ইব্রাহীম নবীর সাথে গোপনে ভূমিষ্ঠ হওয়া ও মানুষের থেকে দুরে থাকা। মুসা নবীর সাথে জীবন নাশের আশঙ্কা ও অদৃশ্য থাকা। ঈসা নবীর সাথে মানুষ যেভাবে তার ব্যাপারে মতবিরোধ করেছিল সে দিক দিয়ে। আইয়ুব নবীর সাথে যেমন তার দুঃখ -বেদনা উদ্বেগ লাঘব হয়ে কার্যোদ্ধারের পথ সুগম হয়েছিল। নবী করিম (সা.) এর সাথে তার মত তলোয়ার হাতে ক্বিয়াম করা”।
কামালুদ্দিন, পৃ. -৩২২, ৩১ তম অধ্যায়, হা. -৩।
৮। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন: “এরূপ যে শেষ যমানার ইমাম অদৃশ্যে থাকবে। ঐ সময় আল্লাহ্র বান্দারা অবশ্যই যেন তাকওয়ার (পরহিযগারীতার) উপর দৃঢ় ও আল্লাহর দ্বীনকে আকড়ে থাকে”।
কামালুদ্দিন, পৃ. -৩২২, ৩৩ তম অধ্যায়, হা. -৫।
৯। তিনি আরও বলেছেন: “মানুষের সামনে এমন এক সময় আসবে যখন তাদের ইমাম তাদের চোখের অন্তরালে (অদৃশ্যে) থাকবে”।
যুরারে বলেন: ইমামকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ঐ সময় মানুষের দায়িত্ব বা করণীয় কি?
বললেন: “যা কিছু তাদেরকে আগেই বলা হয়েছে বা তাদের কাছে আগেই পৌছেছে (অর্থাৎ দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস ও তার দেয়া আদেশ -নির্দেশ) তা যমানার ইমাম আবির্ভাব করা পর্যন্ত মেনে চলা”।
কামালুদ্দিন, পৃ. -৩৫০, ৩৩ তম অধ্যায়, হা. -৪৪।
১০। তিনি আরও বলেছেন: “এই ঘটনাটি (ইমামের আবির্ভাব ও তার ক্বিয়াম করা) ওই সময় সংঘটিত হবে। যখন সব ধরনের মানুষ বা গোষ্ঠি মানুষের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করার কাজ শেষ করবে। যাতে করে কেউ বলতে না পারে যে আমাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে আমরাও ন্যায়পরায়ণতা ও আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতাম বা তার ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করতাম। অবশেষে ক্বায়েম (ইমাম মাহ্দী) ন্যায়পরায়ণতা ও আদর্শের পক্ষে কিয়াম করবেন”।
ইসবাতুল হুদাত, খণ্ড -৭, পৃ. -৪২৭ থেকে ৪২৮ পর্যন্ত।
ইসলামি মাযহাবসমূহের হাদীসসমূহ আলোচিত হয়েছে। উল্লেখিত দু’পক্ষের হাদীসসমূহকে বিচার বিশ্লেষণ করলে যে ফলাফল পাওয়া যায় তা হচ্ছে:
১। দু’পক্ষের হাদীস বেত্তাগণ এ বিষয়ে একমত যে, শেষ যমানায় ইমাম মাহদী (আ. তা. ফা. শা.) আবির্ভূত হবেন এবং দুনিয়ার সকল অন্যায় -অত্যাচার -যুলুম, ফিতনা -ফ্যাসাদকে ধ্বংস করে ন্যায়পরায়ণতা যা আল্লাহর আইন তা প্রতিষ্ঠা করবেন। আর রাসূলে খোদা (সা.) এর বর্ণনা অনুযায়ী তিনি হচ্ছেন ইমাম হুসাইন (আ.) এর বংশের নবম সন্তান, ইমাম রেযা (আ.) এর বংশের চতুর্থ সন্তান এবং ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর ঔরসজাত সন্তান।
২। দু’পক্ষের হাদীস থেকে তিনি যে জন্মগ্রহণ করেছেন তা স্পষ্ট প্রমাণিত।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন