পবিত্র কোরআনে নবিগণের দোয়া

পবিত্র কোরআনে নবিগণের দোয়া

পবিত্র কোরআনে নবিগণের দোয়া

       নবিগণের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো যে, তাঁরা এবাদত, ইসতেগফার, তসবিহ ও দোয়ায় মশগুল থাকতেন। দোয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নিকট নিজদের আরজি পেশ করতেন এবং আল্লাহর সহিত আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন। পবিত্র কোরআন শরিফে প্রথম নবি হজরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত, অনেক নবির দোয়া এসেছে। নবিগণ শুধু সমস্যা সমাধানের জন্যেই আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন না। বরং শুকরিয়া ও প্রশংসার জন্যেও হাত তুলে, দোয়ার মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করতেন।
 হজরত আদম ও হাওয়া (আঃ) -এর দোয়া
আল্লাহ তাআলা হজরত আদম ও হাওয়াকে (আঃ) সৃষ্টি করে বেহেস্তে জীবনজাপনের ব্যবস্থা করেন। তিনি তাঁদেরকে বেহেস্তের শুধুমাত্র নির্ধারিত একটি গাছের ফল ব্যতীত সবকিছু ভক্ষণের অনুমতি দেন। শয়তান তাঁদেরকে সেই গাছের ফল খাবার জন্যে প্রলোভন দিতে থাকে। শেষপর্যন্ত তাঁরা সেই গাছের ফল ভক্ষণ করেন। ফলে আল্লাহ তাআলা আদম ও হাওয়াকে (আঃ) বেহেস্ত থেকে বের করে দেন। এরপর তাঁরা নিজদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে ইস্তেগফার ও তওবা করেন এবং দু'হাত তুলে নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:
رَبَّنا ظَلَمْنا أَنْفُسَنا وَ إِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنا وَ تَرْحَمْنا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخاسِرين ‏
তাঁরা উভয়ে বল্লেন: হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজদের প্রতি জুলুম করেছি, আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন তবে আমরা অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব। (সুরা: আল্‌ আ'রাফ, ২৩।)
       তাফসিরে মাজমাউল বয়ানে মরহুম তাবারসি বর্ণনা করেন: আদম (আঃ) দোয়া করার সময় কিছু মর্যাদাসম্পন্ন পবিত্র নাম দেখতে পান যা আল্লাহর আরশের উপর লিখা ছিল। তিনি সেই পবিত্র নামগুলোর ব্যাপারে জানতে চাইলে বলা হয়, উনারা হচ্ছেন আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি অর্থাৎ মুহাম্মদ, আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (আলাইহিমু স্‌সালাম)। একথা শুনে হজরত আদম (আঃ) উক্ত পবিত্র পাঁচ ব্যক্তিকে অসিলা করে আল্লাহর নিকট তওবা করেন এবং এই পবিত্র নামসমূহের অসিলায় তাঁদের তওবা কবুল হয়। (মাজমাউল বায়ান ফি তাফসিরিল কোরআন, খঃ ১, পৃঃ ২১০।)

শিক্ষণীয় বিষয়
১) তওবা ও ইসতেগফার কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচেছ নিজের গুনাহ্‌ ও ভুলকে স্বীকার করা, যেভাবে হজরত আদম ও হাওয়া (আঃ) নিজদের ভুল স্বীকার করেন, ফলে আল্লাহ তাআলাও তাঁদের তওবা কবুল করেন।
২) দোয়া করার পদ্ধতি আল্লাহর নিকট হতে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। বিশেষকরে যেভাবে আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবিগণকে শিক্ষা দিয়েছেন সেভাবে দোয়া করতে হবে।

হজরত নুহ (আঃ) - এর দোয়া
হজরত নুহ (আঃ) এমন একজন নবি ছিলেন যিনি দীর্ঘহায়াত পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহর এবাদতের জন্যে দাওয়াত করেন এবং মূর্তিপূজায় বাধা দেন, কিন্তু তারা হজরত নুহ (আঃ) - এর দাওয়াতে সাড়া দেয়নি। প্রায় নয়শত পঞ্চাশ বছর যাবত আল্লাহর পথে আহ্বান করার পর শুধুমাত্র হাতে গণা কিছুসংখ্যক লোক ব্যতীত আর কেউই ইমান আনেনি। কেননা তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভুল আকিদায় অন্ধভাবে বিশ্বাস করত।

সাফল্য কামনাকরে হজরত নুহ্‌ (আঃ) - এর দোয়া
হজরত নুহ (আঃ) স্বীয় কওমকে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি দাওয়াত দেন। কিন্তু তারা দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেই শুধু ক্ষান্ত থাকেনি বরং হজরত নুহকে (আঃ) পাথর দ্বারা আঘাতের হুমকি দেখিয়ে বলে: "হে নুহ! তুমি যদি দাওয়াতি কাজ থেকে বিরত না হও, তাহলে তোমাকে পাথর দ্বারা আঘাত করে হত্যা করব!" এমতাবস্থায় হজরত নুহ (আঃ) আল্লাহর নিকট হাত তুলে দোয়া করেন:
رَبِّ إِنَّ قَوْمي‏ كَذَّبُونِ * فَافْتَحْ بَيْني‏ وَ بَيْنَهُمْ فَتْحاً وَ نَجِّني‏ وَ مَنْ مَعِيَ مِنَ الْمُؤْمِنينَ
হে আমার পালনকর্তা! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে মিথ্যাবাদী বলছে। অতএব, আমার ও তাদের মধ্যে কোনো স্পষ্ট ফয়সালা করে দাও! আর আমাকে ও আমার সঙ্গী মোমিনগণকে রক্ষা কর! (সুরা: আশ্‌ শুআরা, ১১৭-১১৮।)
কাফেরদের ধ্বংস এবং মোমিনগণের নিরাপত্তা কামনাকরে হজরত নুহ (আঃ) - এর দোয়া
হজরত নুহ (আঃ) দীর্ঘদিন যাবত স্বীয় কওমকে আল্লাহর এবাদতের জন্যে দলিল-প্রমাণ সহকারে দাওয়াত করেন। কিন্তু তাঁর কওম তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়নি। তারা পরস্পরকে মূর্তিপূজা করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। হজরত নুহ (আঃ) যখন দেখেন যে, তারা আর হেদায়াত হবে না তখন তিনি আল্লাহর নিকট হাত তুলে নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:
رَبِّ لا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكافِرينَ دَيَّارا * إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا عِبادَكَ وَ لا يَلِدُوا إِلاَّ فاجِراً كَفَّاراً * رَبِّ اغْفِرْ لي‏ وَ لِوالِدَيَّ وَ لِمَنْ دَخَلَ بَيْتِيَ مُؤْمِناً وَ لِلْمُؤْمِنينَ وَ الْمُؤْمِناتِ وَ لا تَزِدِ الظَّالِمينَ إِلاَّ تَبارا
হে আমার পালনকর্তা! পৃথিবীতে কোনো কাফের গৃহবাসীকে রেহাই দিও না। যদি তুমি তাদেরকে রেহাই দাও তাহলে তারা তোমার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং শুধুমাত্র কাফের ও পাপাচারী সন্তানই জন্ম দিতে থাকবে। হে আমার পালনকর্তা! তুমি ক্ষমা কর আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং যারা মুমিন হয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করে তাদেরকে এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে; আর জালেমদের কেবল ধ্বংসই বৃদ্ধি কর! (সুরা: নুহ, ২৬-২৮।)

হজরত নুহ (আঃ) - এর সাহায্য প্রার্থনা
হজরত নুহ (আঃ) - এর কওমের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ ইমান তো আনেইনি বরং তাঁকেই মিথ্যাবাদী হিসাবে আখ্যা দিতে থাকে! এমতাবস্থায় তিনি আল্লাহর নিকট বিভিন্ন পর্যায়ে নিম্নোক্তভাবে সাহায্য প্রার্থনা করেন:
رَبِّ انْصُرْني‏ بِما كَذَّبُون
‏হে আমার পালনকর্তা! আমাকে সাহায্য কর, কেননা তারা আমাকে মিথ্যবাদী বলছে। (সুরা: আল্‌ মুমিনুন, ২৬।)
فَدَعا رَبَّهُ أَنِّي مَغْلُوبٌ فَانْتَصِرْ
হজরত নুহ (আঃ) স্বীয় রব্বের নিকট দোয়া করেন, 'আমি পরাভূত, সুতরাং তুমি সাহায্য কর।' (সুরা: আল্‌ ক্বামার, ১০।)
হজরত নুহ (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে নৌকা তৈরী করেন, অতঃপর নিজ পরিবার, অনুসারীগণ এবং প্রত্যেকপ্রকার প্রাণী হতে একজোড়া করে নৌকাতে আরোহণ করান। অতঃপর নিম্নের দোয়াটি পাঠ করেন:
رَبِّ أَنْزِلْني‏ مُنْزَلاً مُبارَكاً وَ أَنْتَ خَيْرُ الْمُنْزِلينَ
হে আমার পালনকর্তা! আমাকে এমনভাবে অবতরণ করাও যা হবে কল্যাণকর; আর তুমিই শ্রেষ্ঠ অবতারণকারী। (সুরা: আল্‌ মুমিনুন, ২৯।)
মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) হজরত আলীকে (আঃ) বলেন: হে আলী! যখন কোথাও অবতরণ করবে তখন পড়বে:
رَبِّ أَنْزِلْني‏ مُنْزَلاً مُبارَكاً وَ أَنْتَ خَيْرُ الْمُنْزِلينَ
তাহলে সেই স্থানের কল্যাণ তোমার জন্যে নির্ধারিত হবে এবং অকল্যাণ দূর হয়ে যাবে। (তাফসিরে সাফি, খঃ ৩, পৃঃ ৩৯৯।)

সন্তানের জন্যে হজরত নুহ (আঃ) - এর দোয়া
পৃথিবীর সর্বত্রই যখন পানিতে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল এবং বিপথগামীরা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিল ও মৃত্যুর সহিত পাঞ্জা লড়ছিল তখন হজরত নুহ (আঃ) তাঁর পথভ্রষ্ট সন্তানকেউ ওদের মাঝে দেখতে পান। পিতৃত্বের সহানুভূতি নিয়ে তিনি নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:
رَبِّ إِنَّ ابْني‏ مِنْ أَهْلي‏ وَ إِنَّ وَعْدَكَ الْحَقُّ وَ أَنْتَ أَحْكَمُ الْحاكِمين
হে আমার প্রতিপালক! আমার পুত্র তো আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আর তোমার প্রতিশ্রুতি নিশ্চয় সত্য এবং তুমিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফয়সালাকারী। (সুরা: হুদ, ৪৫।)
আল্লাহ তাআলা হজরত নুহ (আঃ) - এর দোয়া প্রত্যাখ্যান করেন। কেননা তাঁর এ দোয়া ছিল কাফের ও অবাধ্য সন্তানের উদ্দেশ্যে। আর এ কারণেই হজরত নুহকে (আঃ) সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলা হচ্ছে:
يا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صالِحٍ فَلا تَسْئَلْنِ ما لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنِّي أَعِظُكَ أَنْ تَكُونَ مِنَ الْجاهِلينَ
হে নুহ! সে আদৌ তোমার পরিবারভুক্ত নয়। সে অসৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং আমার কাছে এমন দরখাস্ত করবে না যে বিষয়ে তুমি জান না। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, যেন তুমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হও। (সুরা: হুদ, ৪৬।)
অতঃপর হজরত নুহ (আঃ) বুঝতে পারেন যে, এমন অবাধ্য পথভ্রষ্ট সন্তানের জন্যে আল্লাহর নিকট মুক্তি কামনা করা ঠিক হয়নি। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি এ ধরনের দুরাচারদের জন্যে প্রযোজ্য হবে না। ফলে তিনি স্বীয় ভুল স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন:
رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْئَلَكَ ما لَيْسَ لي‏ بِهِ عِلْمٌ وَ إِلاَّ تَغْفِرْ لي‏ وَ تَرْحَمْني‏ أَكُنْ مِنَ الْخاسِرينَ
হে আমার পালনকর্তা! যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই সে বিষয়ে যেন তোমাকে অনুরোধ না করি, এই জন্যে আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না কর এবং আমাকে দয়া না কর, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। (সুরা: হুদ, ৪৭।)

হজরত নুহ (আঃ) - এর দোয়ায় শিক্ষণীয় দিকসমূহ
১) দীনের দাওয়াতি কাজ করার জন্যে অসীম ধৈর্যের প্রয়োজন আছে; যেমন হজরত নুহ (আঃ) দীর্ঘদিন যাবত ধৈর্যধারণ করেছেন।
২) শেষমুহূর্ত পর্যন্ত হেদায়েতের আশাকরণ। কখনই নিরাশ হওয়া যাবেনা। যেমনটি হজরত নুহ (আঃ) শেষমুহূর্ত পর্যন্ত হেদায়েতের জন্যে নসিহত করেছেন।

৩) আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়া ও তাঁর নৈকট্য অর্জনের মানদণ্ড হচ্ছে ইমান ও সৎকর্ম। এক্ষেত্রে পারিবারিক সম্পর্ক আদৌ ফলপ্রসূ নয়। যেমন- 'কেনান' হজরত নুহের (আঃ) পুত্র হওয়া সত্ত্বেও, ইমান না থাকায় খোদার শাস্তি থেকে মুক্তি পায়নি।
৪) দীনি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্যে শুধুমাত্র পারিবারিক সম্পর্কই যথেষ্ট নয়। বরং ইমানের সম্পর্ক তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমনভাবে 'কেনান' হজরত নুহ (আঃ) - এর পুত্র হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহপাক বলেন: "সে তোমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়"।
৫) ভুল বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মসমর্পণ করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। যেমন - হজরত নুহ (আঃ) যখনই বুঝতে পেরেছেন যে, পথভ্রষ্ট সন্তানের জন্যে মুক্তি কামনা করা উচিত হয়নি, তখনই তিনি স্বীয় ভুল স্বীকার করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
৬) কাফেরদের কল্যাণের জন্যে দোয়া করা অনুচিত। যেমন - হজরত নুহ (আঃ) স্বীয় কাফের সন্তানের জন্যে দোয়া করলে আল্লাহ তাআলা শুধু তাঁর দোয়া প্রত্যাখ্যানই করেননি বরং তাঁকে দোয়া করতেও নিষেধ করেন!
৭) শত্রুর হুমকির মুখে পড়লে আল্লাহর নিকট আশ্রয়গ্রহণ করা উচিত। যেমন - হজরত নুহকে (আঃ) তাঁর কওম পাথরবর্ষণ করে হত্যার হুমকি দিলে, তিনি আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন।
৮) নিজ প্রাণের চেয়ে মতাদর্শের গুরুত্ব বেশি। ফলে হজরত নুহ (আঃ) নিজ প্রাণের নিরাপত্তার জন্যে দোয়া করেননি। বরং মতাদর্শের নিরাপত্তার জন্যে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন।

হজরত ইব্রাহিম (আঃ) - এর দোয়া
হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এমন সময় পৃথিবীতে আসেন যখন মানুষ মূর্তিপূজা ও অজ্ঞতার মধ্যে ডুবে ছিল। তিনি মানুষকে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দিতে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর নিকট হাত তুলে দোয়া করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর সব দোয়াই কবুল করেন। তিনি আল্লাহর এতটা নৈকট্য অর্জন করেন যে, খলিলুল্লাহ (আল্লাহর বন্ধু) উপাধি লাভ করেন।
মৃতদের জীবিত করার জন্যে দোয়া
হজরত ইব্রাহিম (আঃ) বিশ্বাস রাখতেন ও জানতেন যে, আল্লাহ তাআলা মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন। তারপরও তিনি, শুধুমাত্র এ মুজিজা স্বচক্ষে দেখার জন্যে মৃতকে জীবিত করার আবেদন করেন। (তাহলিলি বার দোয়াহায়ে আম্বিয়া দার কোরআন, পৃঃ ৭৮।)
মহানবির (সাঃ) সাহাবা এবং বিশিষ্ট মুফাস্‌সিরে কোরআন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত: ফেরেস্তা (জিব্রাইল) একদা হজরত ইব্রাহিমকে (আঃ) সুসংবাদ দেন যে, আল্লাহ তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁর দোয়া ও আবেদন কবুল করবেন। তাঁর দোয়াতে মৃতকেও হায়াতদান করবেন। তখন হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এ সুসংবাদ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে এবং আল্লাহর শক্তি স্বচক্ষে দেখার জন্যে মৃতকে জীবিত করার আবেদন করেন।
رَبِّ أَرِني‏ كَيْفَ تُحْيِ الْمَوْتى‏ قالَ أَ وَ لَمْ تُؤْمِنْ قالَ بَلى‏ وَ لكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبي‏ قالَ فَخُذْ أَرْبَعَةً مِنَ الطَّيْرِ فَصُرْهُنَّ إِلَيْكَ ثُمَّ اجْعَلْ عَلى‏ كُلِّ جَبَلٍ مِنْهُنَّ جُزْءاً ثُمَّ ادْعُهُنَّ يَأْتينَكَ سَعْياً وَ اعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَزيزٌ حَكيمٌ
হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে আপনি মৃতকে জীবিত করেন তা আমাকে দেখান। আল্লাহ বল্লেন: 'তাহলে কি তুমি বিশ্বাস করনি?' তিনি (ইব্রাহিম) বল্লেন: 'অবশ্যই বিশ্বাস করি। তবে এটা কেবলমাত্র আমার অন্তরের প্রশান্তির জন্যে।' আল্লাহ বল্লেন: 'তাহলে চারটি পাখী নাও এবং সেগুলোকে তোমার বশীভূত করে নাও। অতঃপর তাদের এক একটি অংশ এক একটি পাহাড়ের উপর রাখ। তারপর সেগুলোকে ডাক দাও; তারা দ্রুতগতিতে তোমার নিকট আসবে। জেনে রেখ যে, আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, অতি জ্ঞানসম্পন্ন।' (সুরা: আল্‌ বাকারা, ২৬০।)

নিরাপত্তা লাভের দোয়া
رَبِّ اجْعَلْ هذا بَلَداً آمِناً وَ ارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَراتِ مَنْ آمَنَ مِنْهُمْ بِاللَّهِ وَ الْيَوْمِ الْآخِر
হে আমার প্রভু! 'একে একটি নিরাপদ শহরে পরিণত করুন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও কিয়ামতে বিশ্বাসী তাদেরকে ফলমূল দ্বারা রিজিক দান করুন।' (সুরা: আল্‌ বাকারা, ১২৬।)
رَبِّ اجْعَلْ هَذَا الْبَلَدَ آمِناً وَ اجْنُبْني‏ وَ بَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنام
হে আমার পালনকর্তা! এ নগরীকে নিরাপদ করুন এবং আমাকে ও আমার পুত্রদেরকে মূর্তিপূজা হতে দূরে রাখুন। (সুরা: ইব্রাহিম, ৩৫।)
উল্লেখ্য যে, হজরত ইব্রাহিম (আঃ) প্রথমে নিরাপত্তা চেয়েছেন। তারপর রুজির জন্যে দোয়া করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো দেশ বা শহরের উন্নতির পূর্বশর্ত হচ্ছে নিরাপত্তা। নিরাপত্তা ছাড়া কখনই অর্থনৈতিক উন্নতি করা সম্ভব নয়।

কাবাঘর নির্মাণের সময় হজরত ইব্রাহিম (আঃ) - এর দোয়া
হজরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর পথে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। অর্থ-সম্পদ, পরিবার-পরিজন এবং কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর আদেশ পালনে তৎপর হওয়ার যেসব অক্ষয়কীর্তি তিনি স্থাপন করেন, তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন। কাবাঘর নির্মাণের সময় হজরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আঃ) নিম্নোক্তরূপে দোয়া করেন:

رَبَّنا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّميعُ الْعَليمُ * رَبَّنا وَ اجْعَلْنا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَ مِنْ ذُرِّيَّتِنا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ وَ أَرِنا مَناسِكَنا وَ تُبْ عَلَيْنا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحيمُ * رَبَّنا وَ ابْعَثْ فيهِمْ رَسُولاً مِنْهُمْ يَتْلُوا عَلَيْهِمْ آياتِكَ وَ يُعَلِّمُهُمُ الْكِتابَ وَ الْحِكْمَةَ وَ يُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزيزُالْحَكيم
তাঁরা দোয়া করেন: হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের পক্ষ থেকে একাজ কবুল কর। নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা।' হে আমাদের প্রতিপালক! 'আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ কর এবং আমাদের বংশধর থেকে তোমার এক অনুগত উম্মত করো। আর আমাদেরকে এবাদতের রীতিনীতি দেখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।' হে আমাদের প্রতিপালক! 'তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট একজন রসুল প্রেরণ করো, যে তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবে। তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সুরা: আল্‌ বাকারা, ১২৭-১২৯।)
কাবাঘর নির্মাণ শেষে হজরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আঃ) সর্বপ্রথম তাঁদের এ আমল গ্রহণের জন্যে দোয়া করেন। অতঃপর তাকে ঘিরে তওয়াফ করেন। ৮ই জিলহজ্জ তারিখে হজরত জিব্রাইল (আঃ), হজরত ইব্রাহিমের (আঃ) নিকট আসেন এবং তাঁকে হজ্জের মানাসেক শিক্ষা দেন। (তাফসিরে রাওয়ানে জাভিদ, খঃ ১, পৃঃ ১৭১।)
সর্বশেষে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) রসুল প্রেরণের জন্যে দোয়া করেন এবং রসুল প্রেরণের তিনটি লক্ষ-উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। যথা:
১) আল্লাহর বাণীসমূহকে মানুষের নিকট তিনি বর্ণনা করবেন, যাতে তাদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে এবং বিবেক জাগ্রত হয়।
২) রসুল মানুষকে আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবেন। কেননা শিক্ষা মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়।
৩) রসুল মানুষকে পবিত্র করবেন, আত্মশুদ্ধির পথ দেখাবেন। শিক্ষা এবং আমলের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।

আকর্ষণ বৃদ্ধি, নামাজ প্রতিষ্ঠা এবং রুজির জন্যে দোয়া
হজরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ পান যে, দুগ্ধপোষ্য শিশু ও তার জননীকে মরুপ্রান্তরে রেখে আসতে হবে, তখন তিনি আল্লাহর নিকট নিম্নোক্তরূপে দোয়া করেন:
رَبَّنا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتي‏ بِوادٍ غَيْرِ ذي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنا لِيُقيمُوا الصَّلاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِنَ النَّاسِ تَهْوي إِلَيْهِمْ وَ ارْزُقْهُمْ مِنَ الثَّمَراتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُون ‏
হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কতককে আপনার পবিত্র গৃহের নিকট, এক অনুর্বর উপত্যকায় বসবাস করালাম। হে আমাদের পালনকর্তা! এজন্যে যে, তারা যেন নামাজ কায়েম করে। অতএব আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিন এবং তাদেরকে ফলাদি দ্বারা রুজি দান করুন, যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। (সুরা: ইব্রাহিম, ৩৭।)

শিক্ষা
হজরত ইব্রাহিম (আঃ) - এর প্রতি যখন আল্লাহর নির্দেশ আসে যে, দুগ্ধপোষ্য শিশু ও তার মাতাকে মক্কার মরুপ্রান্তরে রেখে আসতে হবে, তখন তিনি প্রথমে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেন। যদিও বাহ্যিকভাবে তা অত্যন্ত কঠিন ছিল। অতঃপর তিনি দোয়া করেন এবং তাঁর দোয়া কবুলও হয়। আমাদেরও উচিত, আগে আল্লাহর হুকুম পালন করা, তারপর দোয়া করা। যদিও তা কঠিন হয়।

পিতা-মাতার জন্যে হযযরত ইব্রাহিম (আঃ) - এর দোয়া
رَبَّنَا اغْفِرْ لي‏ وَ لِوالِدَيَّ وَ لِلْمُؤْمِنينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِساب
হে আমাদের পালনকর্তা! যেদিন হিসাব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং মুমিনদেরকে ক্ষমা করবেন। (সুরা: ইব্রাহিম, ৪১।)
উল্লেখ্য যে, আরবি ভাষায় "ওয়ালেদ" বলতে শুধুমাত্র প্রকৃত পিতাকে বোঝায়। কিন্তু "আব" শব্দ দ্বারা পিতাসহ চাচা এবং শ্বশুরকেও বোঝায়। সুতারাং উক্ত আয়াতে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর প্রকৃত পিতা-মাতার জন্যে দোয়া করেছেন। কেননা তাঁরা মোমিন ছিলেন। অন্য আয়াতে 'আব' ব্যবহৃত হয়েছে, যা দ্বারা চাচাকে বুঝানো হয়েছে। তাঁর চাচা মুশরেক ছিল ফলে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) তার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। (তাফসিরে নুর, খঃ ৬, পৃঃ ২৯৯।)

সন্তান লাভের জন্যে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) -এর দোয়া
বিবাহের পর দীর্ঘদিন কেটে যায়। বার্র্র্ধক্যে উপনীত হন। কিন্তু হজরত ইব্রাহিম (আঃ) - এর কোনো সন্তান হয় না! এমতাবস্থায় তিনি আল্লাহর নিকট দু'হাত তুলে দোয়া করেন:
رَبِّ هَبْ لي‏ مِنَ الصَّالِحين ‏
হে আমার পালনকর্তা! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন। (সুরা: সাফ্‌ফাত, ১০০।)
উল্লেখ্য যে, হজরত ইব্রাহিম (আঃ) - এর এ দোয়া কবুল হয় এবং ৯৯ বছর বয়সে আল্লাহ তাআলা তাঁকে 'ইসমাইল' নামক এক পুত্রসন্তান দান করেন।
উপরোক্ত দোয়া থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, নেককার সন্তান চেয়ে দোয়া করতে হবে। বাহ্যিক সৌন্দর্য যথেষ্ট নয়। সৎ সন্তান পরিবারের জন্যে সাহায্যকারী হয় এবং ইহকালিন ও পরকালিন মুক্তির কারণ হয়।

হেকমত এবং জান্নাতের জন্যে আবেদন
رَبِّ هَبْ لي‏ حُكْماً وَ أَلْحِقْني‏ بِالصَّالِحينَ * وَ اجْعَلْ لي‏ لِسانَ صِدْقٍ فِي الْآخِرينَ * وَ اجْعَلْني‏ مِنْ وَرَثَةِ جَنَّةِ النَّعيمِ
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞানদান করুন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আর আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে যশস্বী করুন। আমাকে সুখময় জান্নাতের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। (সুরা: আশ্‌ শুআরা, ৮৩-৮৫।)
কাফেরদের সহিত সম্পর্কোচ্ছেদ এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা
رَبَّنا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنا وَ إِلَيْكَ أَنَبْنا وَ إِلَيْكَ الْمَصيرُ * رَبَّنا لا تَجْعَلْنا فِتْنَةً لِلَّذينَ كَفَرُوا وَ اغْفِرْ لَنا رَبَّنا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزيزُ الْحَكيمُ
হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা তোমারই উপর ভরসা করেছি, তোমারই অভিমুখী হয়েছি এবং প্রত্যাবর্তন তো তোমারই নিকট। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে কাফেরদের পীড়নের পাত্র করিও না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর; নিঃসন্দেহে তুমিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সুরা: আল্‌ মুমতাহিনা, ৪-৫।)
ইমাম সাদিক (আঃ) বলেন: অতীতে সমস্ত ইমানদার মানুষই দরিদ্র ছিলেন। (কাফেররা তাদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাত)। পক্ষান্তরে সমস্ত কাফেরই সম্পদশালী ছিল। এমত অবস্থায় হজরত ইব্রাহিম (আঃ) নিম্নোক্ত দোয়া করেন:
رَبَّنا لا تَجْعَلْنا فِتْنَةً لِلَّذينَ كَفَرُوا
হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদেরকে কাফেরদের পীড়নের পাত্র করো না।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা ইমানদারদের মধ্যে যেমন ঐশ্বর্য ও অভাব দেন তেমনিভাবে কাফেরদের মধ্যেও ঐশ্বর্য ও অভাব দেন। (তাফসিরে সাফি, খঃ ৫, পৃঃ ১৬৩।)

হজরত আইয়ুব (আঃ) - এর দোয়া
হজরত আইয়ুব (আঃ) আল্লাহর প্রেরিত এমন একজন নবি ছিলেন যিনি সবার নিকট ধৈর্যের প্রতিক হিসেবে সুপরিচিত। আল্লাহ তাআলা হজরত আইয়ুবকে (আঃ) প্রচুর নিয়ামতদান করেছিলেন। তিনিও অক্লান্তভাবে আল্লাহর এবাদতে মশগুল থাকতেন এবং সর্বদা তার শুকরিয়া আদায় করতেন।
একদা শয়তান হজরত আইয়ুবের এবাদত দেখে হিংসায় জ্বলে উঠে এবং আল্লাহকে বলে: "আইয়ুবকে এত নিয়ামত দিয়েছ বলেই তোমার এত এবাদত করে, তাছাড়া এরূপ করত না।" আল্লাহ তাআলা হজরত আইয়ুবকে (আঃ) পরীক্ষার সম্মুখিন করেন। তিনি একের পর এক বিপদে পতিত হন। অর্থ-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি সবকিছুই হারান। অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। সমস্ত শরীর পচানো ঘায়ে ভর্তি হয়ে যায়। জনগণ এলাকা হতে তাঁকে বের করে দেয়। তাঁর সহধর্মিণী 'রহিমা' ব্যতীত তাঁর পাশে আর কেউ ছিল না। কিন্তু আইয়ুব (আঃ) সবকিছুতেই ধৈর্যধারণ করেন। আল্লাহর নিকট কোনো কিছুর জন্যেই অভিযোগ করেননি। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং দু'হাত তুলে দোয়া করেন:
أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَ أَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمينَ * فَاسْتَجَبْنا لَهُ فَكَشَفْنا ما بِهِ مِنْ ضُرٍّ وَ آتَيْناهُ أَهْلَهُ وَ مِثْلَهُمْ مَعَهُمْ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنا وَ ذِكْرى‏ لِلْعابِدينَ
আমাকে দুঃখো-কষ্ট ঘিরে ফেলেছে, আর তুমি তো দয়াবানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়াবান। তখন আমি তাঁর দোয়া কবুল করলাম এবং তাঁর দুঃখো-কষ্ট দূরীভূত করলাম। তাঁকে তাঁর পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সঙ্গে তাদের মত আরও দিলাম আমার বিশেষ কৃপাস্বরূপ এবং এবাদতকারীদের জন্যে উপদেশস্বরূপ। (সুরা: আল্‌ আম্বিয়া, ৮৩-৮৪।)
হজরত আইয়ুব (আঃ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি এতটা বিপদের সম্মুখিন হওয়ার পরও কখনই কোনো অভিযোগ করেননি। দোয়ার মধ্যেও আল্লাহ তাআলার নিকট শুধুমাত্র বলেছেন, 'হে আল্লাহ! আমাকে দুঃখো-কষ্ট ঘিরে ধরেছে। আপনি অত্যন্ত দয়াবান।' এমনকি একথাও বলছেন না যে, 'হে আল্লাহ! আমাকে সুস্থতাদান করুন বা আমার সমস্যা দূর করুন।' কেননা তিনি জানেন যে, আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত মহান।

শিক্ষা
হজরত আইয়ুব (আঃ) - এর ঘটনাটি আমাদেরকে শিক্ষা দেই যে,
১) যতবড় বিপদই আসুক না কেন, আমরা যেন কখনই ধৈর্যহারা না হই এবং আল্লাহর নিকট অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করি। বরং অত্যন্ত নম্র ও বিনয়ের সহিত আল্লাহর নিকট দোয়া করি এবং বিপদ হতে রক্ষার জন্যে চেষ্টা করি।
২) আমাদের মনে রাখা উচিত যে, বিপদ যত শক্তই হোক না কেন, সমস্যা যত বেশিই হোক না কেন, শত্রু যত শত্রুতাই করুক না কেন; আল্লাহর একটু দয়া, সবকিছুরই সমাধান করে দিতে পারে। বিপদে ধৈর্যধারণ করে আল্লাহর আশ্রয়গ্রহণ করলে, যা হাত থেকে চলে গেছে তার থেকে বেশিও তিনি দান করতে পারেন।
৩) কেউ কোনো মসিবত বা বিপর্যয়ে পতিত হলে তাকে তিরস্কার করা উচিত নয়। অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতার অহংকার দেখানো ঠিক নয়। মনে রাখা উচিত যে, মান-অপমান, ঐশ্বর্যতা-দরিদ্রতা এবং কেড়েনেয়া-দানকরা সবকিছুই আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা, করেন না। তবে এ সবকিছুই বান্দার কল্যাণের জন্যে। তিনি কখনই কারও উপর জুলুম করেন না। বরং তাঁর অনুগ্রহের ছায়া সবার উপরই বিস্তৃত। যেরূপভাবে হজরত আইয়ুব (আঃ) সুখে-দুঃখে সবসময়ই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন এবং ধৈর্যের প্রমাণ দিয়েছেন। মহান আল্লাহও তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিয়েছেন। সেরূপভাবে আমাদেরকেও সর্বাবস্থাতেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে।

হজরত দাউদ (আঃ) - এর দোয়া
হজরত দাউদ (আঃ) অত্যন্ত জ্ঞানী, ক্ষমতাশালী ও এবাদতকারী ছিলেন এবং সর্বদা আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন।
وَ ظَنَّ داوُدُ أَنَّما فَتَنَّاهُ فَاسْتَغْفَرَ رَبَّهُ وَ خَرَّ راكِعاً وَ أَناب
আর দাউদ বদ্ধধারণা করল যে, আমরা তাকে পরীক্ষা করেছি, তখন সে তাঁর পালনকর্তার সমীপে ক্ষমাপ্রার্থনা করল, মাথা অবনমন করল এবং (আল্লাহর) দিকে প্রত্যাবর্তন করল।
সাধারণত আমরা মনে করি যে, প্রচুর ধন-সম্পদ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু এটা সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়। ধন-সম্পদ আল্লাহর নিয়ামত, কিন্তু শর্ত হচ্ছে সৎপথে ব্যয় করতে হবে এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে। যেমন আল্লাহর নবি হজরত দাউদ (আঃ) যিনি সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করতেন এবং ইসতেগফার করতেন।

হজরত জাকারিয়া
হজরত জাকারিয়া (আঃ) জীবনব্যাপী স্বীয় জাতিকে তাওহিদ ও আল্লাহর আনুগত্যের দাওয়াত দেন। তিনি একদা আল্লাহ তাআলার সহিত নিম্নোক্তভাবে মতবিনিময় করেন:
كهيعص * ذِكْرُ رَحْمَتِ رَبِّكَ عَبْدَهُ زَكَرِيَّا * إِذْ نادى‏ رَبَّهُ نِداءً خَفِيًّا * قالَ رَبِّ إِنِّي وَهَنَ الْعَظْمُ مِنِّي وَ اشْتَعَلَ الرَّأْسُ شَيْباً وَ لَمْ أَكُنْ بِدُعائِكَ رَبِّ شَقِيًّا * وَ إِنِّي خِفْتُ الْمَوالِيَ مِنْ وَرائي‏ وَ كانَتِ امْرَأَتي‏ عاقِراً فَهَبْ لي‏ مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا
(ক্বাফ হা ইয়া আইন সাদ।) এটি আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর বান্দা জাকারিয়ার প্রতি। যখন তিনি তাঁর প্রতিপালককে গোপনে আহবান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: 'হে আমার প্রতিপালক! আমার অস্থি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং বার্ধক্যের কারণে আমার মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে। হে আমার প্রতিপালক! আপনাকে আহ্বান করে আমি কখনও বিফল হইনি। আমি আমার (মৃত্যুর) পর আমার স্বজনবর্গ সম্পর্কে আশংকা করছি; আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। অতএব আপনি আপনার পক্ষ হতে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী (সন্তান) দান করুন।' (সুরা: মারইয়াম, ১-৫।)
হজরত জাকারিয়ার (আঃ) দোয়া 'হুরুফে মোকাত্তায়াহ্‌'
کهیعص)) দ্বারা শুরু হয়েছে। হুরুফে মোকাত্তায়াহ্‌'র নির্ধারিত অর্থ কেউ জানেনা। তবে মোফাস্‌সেরগণের প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, 'ইহা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সাঃ) মাঝে গোপন রহস্য। এর অর্থ আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই ভাল জানেন।' এ আয়াতের একটি মিসদাক বা দৃষ্টান্ত হচ্ছে: এ আয়াতে পাঁচটি বিচ্ছিন্ন অক্ষর রয়েছে। এ পাঁচটি বিচ্ছিন্ন অক্ষর দ্বারা পাঁচজন পবিত্র ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে। এই পবিত্র পাঁচজন হচ্ছেন: হজরত মুহাম্মদ (সাঃ), হজরত আলী (আঃ), হজরত ফাতেমা (আঃ), হজরত হাসান (আঃ) এবং হজরত হোসাইন (আঃ)।
হাদিসে এসেছে, হজরত জাকারিয়া (আঃ) এ পবিত্র পাঁচব্যক্তি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্যে আল্লাহর নিকট দরখাস্ত করেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে এই পবিত্র পাঁচব্যক্তি সম্পর্কে জ্ঞানদান করেন। হজরত জাকারিয়া (আঃ) যখনই এই পবিত্র ব্যক্তিগণের নাম স্বরণ করতেন তখনই তাঁর সমস্ত দুঃখো-কষ্ট দূর হয়ে যেত। তবে তাঁদের মধ্য হতে যখনই হজরত হোসাইনের (আঃ) নাম উচ্চারণ করতেন তখন চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়ে যেত এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন।
একদিন হজরত জাকারিয়া (আঃ) আল্লাহর নিকট আবেদন করেন, 'হে আমার রব! এই নামে কেন এ ধরণের প্রভাব রয়েছে?' আল্লাহ তাআলা হজরত জাকারিয়াকে (আঃ) বলেন:
'ক্বাফ' অর্থ: কারবালা যা একটি স্থানের নাম।
'হা' অর্থ: আহ্‌লুল বাইত যাদের এক অংশকে নির্মমভাবে কারবালায় হত্যা করা হবে।
'ইয়া' অর্থ: ইয়াজিদ যে ইমাম হোসাইন এবং তাঁর সাথিদের হত্যাকারী।
'আইন' অর্থ: আত্বাশ বা পিপাসা।
'সাদ' অর্থ: সবর বা ধৈর্য।
হজরত জাকারিয়া (আঃ) এখবর শুনার পর তিনদিন যাবৎ মসজিদ হতে বের হননি এবং লোকজনকে মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। এ তিনটি দিন তিনি কান্না করেন। অতঃপর আল্লাহর নিকট পুত্রসন্তানের জন্যে দোয়া করেন। যে সন্তান হবে তাঁর বৃদ্ধবয়সে চোখের আলো, উত্তরাধিকারী। আর তার জন্ম-মৃত্যু যেন ইমাম হোসাইনের (আঃ) মত হয়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা হজরত ইয়াহ্‌ইয়াকে দান করেন। (তাফসিরে নুরুস্‌ সাকালাইন, খঃ ৩, পৃঃ ৩১৯-৩২০।)

সন্তান লাভের জন্যে দোয়া
দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও হজরত জাকারিয়ার (আঃ) কোনো সন্তান হয়নি। তিনি বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রীও বন্ধ্যা। অন্যদিকে হজরত জাকারিয়ার (আঃ) পরে এমন কেউ নেই, যিনি তাঁর ওয়াসি বা স্থলাভিসিক্ত হিসেবে দীনি দায়িত্ব পালন করবেন। এমতাবস্থায় তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সহিত আল্লাহর নিকট আবেদন করেন:
رَبِّ لا تَذَرْني‏ فَرْداً وَ أَنْتَ خَيْرُ الْوارِثينَ
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একা রাখিও না (আমাকে সন্তান দান করুন) আর তুমি তো সর্বোত্তম ওয়ারিস। (সুরা: আল্‌ আম্বিয়া, ৮৯।)
رَبِّ هَبْ لي‏ مِنْ لَدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً إِنَّكَ سَميعُ الدُّعاءِ
হে আমার প্রতিপালক! আপনার পক্ষ হতে আমাকে এক পূত-পবিত্র সন্তানদান করুন। নিশ্চয়ই আপনি দোয়া শ্রবণকারী।
ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, হজরত জাকারিয়ার (আঃ) স্ত্রী বন্ধ্যা ছিলেন। ফলে তিনি সন্তানলাভের ব্যাপারে অত্যন্ত হাতাশাগ্রস্থ ছিলেন। কিন্তু একদিন তিনি হজরত মারইয়াম (আঃ) - এর গৃহে প্রবেশ করে দেখলেন যে, হজরত মারইয়াম (আঃ) এবাদতে মশগুল রয়েছেন এবং তাঁর পাশে অনেকগুলো টাটকা ফল সাজানো রয়েছে, অথচ তখন সেসব ফলের মৌসুম ছিল না। হজরত জাকারিয়া (আঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, 'হে মারইয়াম! এসব ফল কোথা হতে পেলে?' উত্তরে হজরত মারইয়াম (আঃ) বল্লেন, 'আল্লাহর পক্ষ হতে।'
হজরত জাকারিয়া (আঃ) আল্লাহ তাআলার এ নিয়ামত ও মহত্ত্ব দেখে আশান্বিত হন, 'আমার স্ত্রী বন্ধ্যা এবং আমি বার্ধক্যে উপনীত হলেও আল্লাহ তায়ালা করুণা করলে আমাদেরকে নেক সন্তান দান করতে পারেন।' বিধায় এবাদতের সময় মহান আল্লাহর নিকট দু'হাত তুলে সন্তানের জন্যে দোয়া করেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করেন। ফেরেস্তাগণ সুসংবাদ নিয়ে আসেন যে, আল্লাহ তাআলা আপনাকে ইয়াহ্‌ইয়া নামক এক সুসন্তান দান করেছেন।

শিক্ষা
হজরত জাকারিয়ার (আঃ) দোয়া হতে আমরা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি। যথা:
১) হজরত জাকারিয়া (আঃ) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যগণকে - হজরত মুহাম্মদ (সাঃ), হজরত আলী (আঃ), হজরত ফাতেমা (আঃ), হজরত হাসান (আঃ) ও হজরত হোসাইন (আঃ) - অসিলা করে দোয়া করার মাধ্যমে শান্তিলাভ করেন। অনুরূপভাবে আমরাও আহলে বাইতের (আঃ) মাধ্যম ধরে (তাওয়াস্‌সুল করার মাধ্যমে) বিভিন্ন সমস্যার সমাধান পেতে পারি এবং আত্মিক শান্তি লাভ করতে পারি।

২) মোমিন ব্যক্তির সব কাজই আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। হজরত জাকারিয়া (আঃ) আল্লাহর নিকট এ কারণেই সন্তানকামনা করেন, যেন তাঁর ইন্তিকালের পর, তাঁর সন্তান দীনি দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
৩) যেসব ব্যক্তির সন্তান নেই, তাদের কখনই নিরাশ হওয়া উচিত নয়। বরং আল্লাহর নিকট এখলাসের সহিত দোয়া করা উচিত।
৪) সর্বাবস্থাতেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে। নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে বরকত নাজিল হয়। আর অকৃতজ্ঞতার মাধ্যমে বরকত উঠে যায় এবং আজাব নেমে আসে।

হজরত সুলাইমান (আঃ) - এর দোয়া
হজরত সুলাইমান (আঃ) ও হজরত দাউদ (আঃ) দু'জনই মহান নবি ছিলেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে তাঁদের প্রশংসা করেছেন। হজরত সুলাইমানকে (আঃ) আল্লাহ তাআলা বিশেষ জ্ঞানদান করেছিলেন যার মাধ্যমে তিনি পশু-পাখির ভাষাও বুঝতে পারতেন।
বিশেষ হুকুমত চেয়ে হজরত সুলাইমান (আঃ) - এর দোয়া
رَبِّ اغْفِرْ لي‏ وَ هَبْ لي‏ مُلْكاً لا يَنْبَغي‏ لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدي إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّاب ‏
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে দান করুন এমন এক রাজ্য (হুকুমত) যার অধিকারী আমি ছাড়া কেউ না হয়। নিশ্চয়ই আপনি পরম দাতা। (সুরা: সাদ, ৩৫।)
হজরত সুলাইমানের (আঃ) উপরোক্ত দোয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন হতে পারে যে, তিনি কেন এই ধরনের দোয়া করেছেন, "হে আল্লাহ! আমাকে এমন এক হুকুমত দান করুন যার অধিকারী আমি ছাড়া কেউ না হয়।" হজরত সুলাইমান (আঃ) কি অন্যদের ব্যাপারে কার্পণ্য করেছেন?
হজরত সুলাইমান (আঃ) আল্লাহর নবি ছিলেন। তিনি কখনই কৃপণ হতে পারেন না। তিনি আল্লাহর নিকট হতে মুজিজা বা অলৌকিক ক্ষমতাসম্বলিত বিশেষ হুকুমত কামনা করেছিলেন। কেননা প্রত্যেক নবিকে আল্লাহ তাআলা মুজিজাদান করেছিলেন। যেমন- হজরত মুসার (আঃ) মুজিজা ছিল লাঠি, হজরত ইব্রাহিমের (আঃ) মুজিজা ছিল আগুন শীতল হওয়া, হজরত সালেহ (আঃ) - এর মুজিজা ছিল বিশেষ উটনি, মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) - এর মুজিজা পবিত্র কোরআন। অনুরূপভাবে হজরত সুলাইমান (আঃ) - এর মুজিজা ছিল, বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন হুকুমত।
তিনি বাতাসের উপর ক্ষমতা রাখতেন। তাঁর হুকুমে তক্তা বাতাসের সাহায্যে পরিচালিত হত। জিনদেরকে কাজে লাগাতেন। পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন - ইত্যাদি।
হজরত সুলাইমান (আঃ) - এর পর হয়তোবা অন্য কেউ আরও বৃহৎ সাম্রাজ্যের মালিক হতে পারে, কিন্তু তাঁর মত অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন হুকুমত আর কেউ পাবে না। কেননা তাঁর এ হুকুমত ছিল এক প্রকার মুজিজা। (তাফসিরে নমুনা, খঃ ১৯, পৃঃ ২৮৫।)
হজরত সুলাইমান (আঃ) - এর উপরোক্ত দোয়ায় একটি বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে: অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতা, সৎব্যক্তির জন্যে আধ্যাত্মিকতা অর্জনের পথে বাধার কারণ তো হবেই না বরং সৎপথে ব্যয়করে, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার একটি মাধ্যমও বটে।

শুকরিয়া আদায়ের তৌফিক অর্জনের জন্যে দোয়া
একদিন হজরত সুলাইমান (আঃ) তাঁর সেনাবাহিনীসহ পথে যাচ্ছিলেন। হঠাৎকরে অবগত হলেন যে, একটি পিঁপড়া অন্যদেরকে বলছে, 'তোমরা তাড়াতাড়ি গর্তে ফিরে যাও, তাছাড়া হজরত সুলাইমান ও তাঁর সেনাবাহিনীর পদতলে পিষে যেতে পার।' হজরত সুলাইমান (আঃ) পিঁপড়ার একথা শুনার পর আল্লাহর নিকট তাঁর নিয়ামতসমূহের যথাযথ শুকরিয়া আদায় করার তৌফিক চেয়ে নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:
رَبِّ أَوْزِعْني‏ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتي‏ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَ عَلى‏ والِدَيَّ وَ أَنْ أَعْمَلَ صالِحاً تَرْضاهُ وَ أَدْخِلْني‏ بِرَحْمَتِكَ في‏ عِبادِكَ الصَّالِحينَ
হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে যে নিয়ামতদান করেছ তার জন্যে আমাকে তোমার শুকরিয়া আদায় করার সামর্থ্যদান কর। আর যাতে আমি নেককাজ করতে পারি যা তুমি পছন্দ কর এবং তোমার অনুগ্রহে আমাকে তোমার নেকবান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত কর। (সুরা: আন্‌ নামল, ১৯।)

শিক্ষা
১) আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা আমাদের সকলের কর্তব্য। নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ তাআলা তাতে আরও বৃদ্ধি করেন। আর অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আজাবের সম্মুখিন হতে হয়। অবশ্য, আমাদেরকে নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার সামর্থ্য আল্লাহর নিকট কামনা করতে হবে। হজরত সুলাইমান (আঃ) আল্লাহর নবি হওয়া সত্ত্বেও নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের সামর্থ্যের জন্যে আল্লাহর নিকট দরখাস্ত করেছেন। অনুরূপভাবে দেখতে হবে যে, আল্লাহর ওলিগণ কিভাবে প্রভুর শুকরিয়া আদায় করতেন। তাঁদের নিকট হতে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
২) আল্লাহর নেকবান্দাগণের নিকট অর্থ-সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং প্রভুর সন্তুষ্টিই গুরুত্বপূর্ণ। হজরত সুলাইমান (আঃ) এমন নেককাজ করার তৌফিক চেয়ে দোয়া করেছেন যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। এ দোয়ার মাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, তাঁর নিকট বিশাল হুকুমত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর চেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই আসল লক্ষ।

হজরত শুয়ায়েব (আঃ) - এর দোয়া
হজরত শুয়ায়েব (আঃ) তাঁর জাতিকে হেদায়াত করতে গিয়ে অনেক নির্যাতন সহ্য করেন। তাঁর জাতি শুধুমাত্র আকিদাগতভাবেই বিভ্রান্ত ছিলনা বরং সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যেও ডুবে ছিল। ওজনে কম দেওয়া ও খিয়ানত করা তাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। হজরত শুয়ায়েব (আঃ) তাদেরকে তাওহিদের দাওয়াত দেন এবং ফেতনা-ফাসাদ হতে বেরিয়ে আসতে বলেন। কিন্তু তারা র্শি‌ক ও ফাসাদে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, সত্য ও কল্যাণের বাণী তাদের অন্তরে কোনো প্রভাবই ফেলেনি। তারা বিভিন্নভাবে হজরত শুয়ায়েবকে (আঃ) কষ্ট দিতে থাকে। পরিশেষে তিনি নিম্নোক্তরূপে দোয়া করেন:
رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنا وَ بَيْنَ قَوْمِنا بِالْحَقِّ وَ أَنْتَ خَيْرُ الْفاتِحينَ
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দাও এবং তুমিই মীমাংসাকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। (সুরা: আল্‌ আ'রাফ, ৮৯।)
হজরত শুয়ায়েব (আঃ) তাঁর গোমরাহ জাতির মাধ্যমে নির্যাতিত হওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে ধ্বংস কামনা করেননি। বরং আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন। দোয়ার একটি আদব হচ্ছে অন্যের জন্যে কল্যাণ কামনাকরা অথবা আল্লাহর উপর অর্পণকরা।

হজরত সালেহ (আঃ) - এর দোয়া
হজরত সালেহ (আঃ) মদিনা ও শামের মাঝামাঝি 'আল কুরা' নামক উপত্যকায় বসবাস করতেন। মহান আল্লাহ তাআলা এই এলাকায় প্রচুর নিয়ামতদান করেছিলেন, কিন্তু তারা আল্লাহকে ভুলে মূর্তিপূজা ও ফাসাদে লিপ্ত হয়েছিল। মহান আল্লাহ হজরত সালেহকে (আঃ) তাদের নিজদের মধ্য হতেই হেদায়াতকারী হিসেবে মনোনীত করেন। হজরত সালেহ (আঃ) তাঁর জাতিকে আল্লাহর এবাদত এবং দোয়া করার জন্যে আহ্বান জানান।
يا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ ما لَكُمْ مِنْ إِلهٍ غَيْرُهُ هُوَ أَنْشَأَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَ اسْتَعْمَرَكُمْ فيها فَاسْتَغْفِرُوهُ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ إِنَّ رَبِّي قَريبٌ مُجيبٌ
হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর এবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো উপাস্য নেই। তিনি তোমাদেরকে জমিন হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে তাতে বসতিদান করেছেন। অতএব, তাঁর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা কর এবং তাঁরই দিকেই ফিরে এসো। আমার রব্‌ নিকটেই এবং তিনি আহ্বানে সাড়া দেন। (সুরা: হুদ, ৬১।)

ইসতেগফার এবং তওবার মধ্যে পার্থক্য
উপরোক্ত আয়াতে 'তওবা এবং ইসতেগফার' উভয়েরই নির্দেশ এসেছে। এ দুয়ের মাঝে অত্যন্ত সূক্ষ্ণপার্থক্য রয়েছে যা নিম্নোরূপ:
১) ইসতেগফার নিজের জন্যে এবং অন্যের জন্যেও প্রযোজ্য। কিন্তু তওবা শুধুমাত্র নিজের জন্যে প্রযোজ্য।
২) ইসতেগফার সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। কিন্তু তওবা হচ্ছে গোনাহ্‌ হতে ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে।
৩) ইসতেগফার জীবিত ও মৃত উভয়ের জন্যেই পাঠকরা যায়, কিন্তু তওবা শুধুমাত্র জীবিত ব্যক্তি নিজের জন্যে পাঠ করবে।
৪) ইসতেগফার পাঠ করলে বালা-মুসিবত দূর হয় এবং নিয়ামত নাজিল হয়।

হজরত লুত (আঃ) - এর দোয়া
হজরত লুত (আঃ) - এর জাতি চারিত্রিক নিপর্যয়সহ বিভিন্ন গুনাহ্‌র মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছিল। হজরত লুত (আঃ) তাদেরকে এ বিপর্যয় হতে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্যে তাওহিদ ও পবিত্রতার দিকে আহ্বান করেন, কিন্তু নিকৃষ্টকাজ ও পাপের মধ্যে ডুবে থাকার কারণে তাদের অন্তর এতই কলুষিত হয়ে যায় যে, এ মুক্তিরবাণী তাদের নিকট বেদনা দায়ক মনে হয়। বিধায় তারা এ সত্যবাণী গ্রহণকরা তো দূরের কথা বরং হজরত লুতকে (আঃ) বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে সুরু করে। পরিশেষে তিনি আল্লাহর নিকট দু'হাত তুলে সাহায্য প্রার্থনা করেন:
رَبِّ انْصُرْني‏ عَلَى الْقَوْمِ الْمُفْسِدين ‏
হে আমার পালনকর্তা! বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমকে সাহায্য কর। (সুরা: আল্‌ আনকাবুত, ৩০।)
হজরত লুত (আঃ) প্রকৃত পক্ষে তাঁর ব্যক্তিগত বিজয় কামনা করেননি। বরং বাতিলের উপর হকের বিজয়, মন্দের উপর ভালর বিজয়, অকল্যাণের উপর কল্যাণের বিজয় এবং অধমের উপর উত্তমের বিজয় কামনা করেন। কিন্তু জুলুম, কুকর্ম ও পাপাচারিতা হয়ে পড়ে তাদের দৈনন্দিন কাজের অন্তর্ভুক্ত। দিন দিন ফাসাদ বাড়তে থাকে। অবশেষে আল্লাহর পক্ষ হতে আজাব নেমে আসে। এমতাবস্থায় হজরত লুত (আঃ) নিজের এবং পরিবারের জন্যে নিরাপত্তা চেয়ে মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
رَبِّ نَجِّني‏ وَ أَهْلي‏ مِمَّا يَعْمَلُون ‏
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এবং আমার পরিবারকে, তাদের কৃতকর্ম হতে নাজাত দেন।
উপরোক্ত আয়াতে হজরত লুত (আঃ) শুধুমাত্র তাঁর নিজের পরিবারের জন্যে দোয়া করেন। কেননা তাঁর পরিবার-পরিজন ব্যতীত, সে এলাকার আর কেউ তাঁর প্রতি ইমান আনেনি। (তাফসিরে আল্‌ মিজান, খঃ ১৫, পৃঃ ৩১০।)

হজরত হুদ (আঃ) - এর দোয়া
হজরত হুদ (আঃ) তাঁর গোমরাহ্‌ জাতিকে আল্লাহর এবাদতের জন্যে দাওয়াত দিলেন। তারা আল্লাহর নবির ডাকে সাড়া না দিয়ে, তাঁকে অসম্মান করল এবং এমনভাবে প্রহার করল যারফলে হজরত হুদ (আঃ) বেহুঁশ হয়ে জমিনের উপর লুটিয়ে পড়লেন। তাদের এ জঘন্য অপরাধের কারণে আল্লাহ তাআলা আজাবস্বরূপ বৃষ্টি বন্ধ করে দিলেন। অনাবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ নেমে আসল। হজরত হুদ (আঃ) তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন এবং নিম্নোক্তভাবে তওবা ও এসতেফারের মাধ্যমে দোয়া করতে বল্লেন:
وَ يا قَوْمِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّماءَ عَلَيْكُمْ مِدْرارا
হে আমার জাতি! তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁরই দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি তোমাদের উপর প্রচুর বৃষ্টিবর্ষণ করবেন। (সুরা: হুদ, ৫২।)
ইমাম হাসান (আঃ) হতে বর্ণিত আছে: জনৈক ব্যক্তি তাঁর নিকট এসে বলল: 'আমি অনেক ধন-সম্পত্তির মালিক কিন্তু আমার কোনো সন্তান নেই। আমাকে একটি দোয়া শিখিয়ে দিন যা আমলের মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে সন্তানদান করবেন।' ইমাম হাসান (আঃ) বল্লেন: 'ইসতেগফার পাঠ করতে থাক।' ইমামের নির্দেশ মত সেই ব্যক্তি প্রচুর ইসতেগফার পাঠ করতে লাগল। এমনকি কোনো কোনো দিন সাতশ বার পর্যন্ত ইসতেগফার পাঠ করত। আর এর ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে দশটি পুত্রসন্তান দান করলেন। (তাফসিরে জাওয়ামেউল জামে, খঃ ২, পৃঃ ১৫২।)

হজরত ইয়াকুব (আঃ) - এর দোয়া
হজরত ইয়াকুব (আঃ) একজন মহান নবি ছিলেন। পবিত্র কোরআনে তাঁর উপাধি 'ইসরাইল বা আল্লাহর বান্দা' বলে উল্লেখ হয়েছে। হজরত ইয়াকুবের (আঃ) সন্তানরা, পিতার নিকট এসে ভুলস্বীকার করে আবেদন করল, 'হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্যে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করুন।'
يا أَبانَا اسْتَغْفِرْ لَنا ذُنُوبَنا إِنَّا كُنَّا خاطِئين ‏
হে আমাদের পিতা! আমাদের গোনহ্‌গুলির জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন, নিশ্চয় আমরা আপরাধী। (সুরা: ইউসুফ, ৯৭।)
হজরত ইয়াকুব (আঃ) তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে বল্লেন:
سَوْفَ أَسْتَغْفِرُ لَكُمْ رَبِّي إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحيم
অতিশীঘ্রই আমি তোমাদের জন্যে আমার প্রভুর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করব। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সুরা: ইউসুফ, ৯৮।)
হজরত ইয়াকুব (আঃ) সন্তানদের আবেদনের পরই দোয়া না করে বল্লেন, 'আমি অতিশীঘ্রই তোমাদের জন্যে দোয়া করব।' হাদিসে এসেছে, তিনি শক্রবার ভোররাতের সময় তাদের ক্ষমার জন্যে দোয়া করেন। কেননা এ সময়টা দোয়া কবুলের জন্যে উত্তম সময়।

হজরত ইউসুফ (আঃ) - এর দোয়া
হজরত ইয়াকুবের (আঃ) বারজন সন্তান ছিল। হজরত ইউসুফ (আঃ) ছিলেন তাদের মধ্য সবচেয়ে ছোট এবং সে যুগের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। বাল্যকালেই হজরত ইউসুফ (আঃ) - এর মাতা ইন্তিকাল করেন।
হজরত ইয়াকুব (আঃ) বিভিন্ন কারণে ইউসুফকে (আঃ) অন্যান্য সন্তানের চেয়ে বেশী ভালবাসতেন। এই ভালবাসাই অন্যান্য ভায়ের নিকট হিংসার কারণ হয়। তারা হজরত ইউসুফকে (আঃ) হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। পিতার নিকট খেলার অজুহাত দেখিয়ে ইউসুফকে (আঃ) মাঠে নিয়ে যায় এবং কূপের মধ্যে ফেলে দেয়। সন্ধ্যার সময় বাড়ী ফিরে পিতাকে বলে, 'ইউসুফকে বাঘে খেয়ে নিয়েছে!' ইয়াকুব (আঃ) সন্তান হারানোর ব্যথায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন।
কূপের মধ্যে আল্লাহ তাআলা হজরত ইউসুফকে (আঃ) হেফাজত করেন। কয়েকদিন পর একটি কাফেলা সেখান দিয়ে অতিক্রমের সময় পানিসংগ্রহ করার জন্যে কূপের মধ্যে বালতি নামায়। হজরত ইউসুফ (আঃ) সে বালতি ধরে কূপ থেকে উপরে উঠে আসেন। কাফেলার পরিচালক তাঁকে মিসরে নিয়ে গিয়ে বিক্রয় করে।
মিসরের প্রধানমন্ত্রী 'আজিজের' কোনো সন্তান ছিল না। বিধায় তিনি হজরত ইউসুফকে (আঃ) ক্রয় করে স্বীয় স্ত্রীকে উপহার দেন। ইউসুফ (আঃ) সেখানে রাজকীয় মর্যাদায় বড় হয়ে উঠেন।
মিসরের আজিজের স্ত্রী 'জুলাইখা' ইউসুফের (আঃ) প্রতি আসক্তা হয়ে উঠে। মনের কুবাসনা পূরণের দাবি জানায়। তিনি জুলাইখার এই অবৈধ দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু জুলাইখা স্বীয় দাবি পূরণের জন্যে চাপপ্রয়োগ করে। হজরত ইউসুফ (আঃ) এই ষড়যন্ত্র হতে বাঁচার জন্যে আল্লাহর নিকট দু'হাত তুলে নিম্নোরূপে দোয়া করেন:
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَني‏ إِلَيْهِ
হে আমার রব্‌! তারা আমাকে যেকাজের দিকে আহবান করছে তার চেয়ে কারাগারই আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়। (সুরা: ইউসুফ, 33।)

শিক্ষা
হজরত ইউসুফ (আঃ) - এর দোয়া হতে শিক্ষণীয় বিষয়গুলি হচ্ছে:
১) আল্লাহর প্রতি ইমান ও ভালবাসা থাকলে কখনই কলুষতা ও বিচ্যুতি স্পর্শ করতে পারে না। এই ধরনের বিপদজনক সময়ে ইমান ছাড়া আর কোনো কিছুই বিচ্যুতি হতে নিরাপত্তা দিতে পারে না।
২) অত্যাচার ও ফাসাদযুক্ত সমাজের চেয়ে কারাগারের কষ্টদায়ক জীবনই উত্তম। হজরত ইউসুফ (আঃ) - এর জন্যে, অসৎকাজে লিপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, বরং এই ধরনের প্রস্তাব শ্রবণকরাও কষ্টদায়ক ছিল। বিধায় কারাগারে থাকার জন্যে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন যাতে কলুষিত না হন।
৩) যারা গোনাহ্‌ হতে বেচে থাকতে চায়, তাদের জন্যে হজরত ইউসফ (আঃ) - এর এই দোয়া হচ্ছে একটি উত্তম শিক্ষা। যেকোনোপ্রকার গোনাহ্‌ হতে ঁেবচে থাকার জন্যে বিশেষকরে স্পর্শকাতর মুহূর্তে আল্লাহর মদদ কামনা করতে হবে এবং ইমানি শক্তির আশ্রয় নিতে হবে।
৪) পবিত্র কোরআন আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে যে, আমরা যেন কখনই নিজকে পরহেজগার ও মোত্তাকি ভেবে, নিজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে না করি বরং সর্বাবস্থাই আল্লাহর সাহায্য কামনা করি।
পরবর্তীতে হজরত ইউসুফ (আঃ) কারাগার হতে মুক্ত হন এবং মিসরের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন। ফলে তিনি আল্লাহর নিকট নিম্নোক্তভাবে শুকরিয়া আদায় করেন ও আবেদন জানান:
رَبِّ قَدْ آتَيْتَني‏ مِنَ الْمُلْكِ وَ عَلَّمْتَني‏ مِنْ تَأْويلِ الْأَحاديثِ فاطِرَ السَّماواتِ وَ الْأَرْضِ أَنْتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيا وَ الْآخِرَةِ تَوَفَّني‏ مُسْلِماً وَ أَلْحِقْني‏ بِالصَّالِحين ‏
হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছ এবং আমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ। হে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের স্রষ্টা! তুমিই দুনিয়া ও আখেরাতে আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করাও এবং আমাকে নেক বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত কর। (সুরা: ইউসুফ, ১০১।)

শিক্ষা
১) দোয়া করার পদ্ধতি, আল্লাহর নবিগণের নিকট হতে শিক্ষা নেওয়াই উত্তম। আল্লাহর নবিগণ তাঁদের দোয়াতে পার্থিব জগতের সম্পদ না চেয়ে পরকালীন মুক্তির জন্যে দোয়া করতেন।
২) নেকবান্দাগণ পদমর্যাদা ও সম্পদের দিকে লক্ষ করার পাশাপাশি আল্লাহকেও স্মরণ করেন। কেননা এইসব নিয়ামত তাঁরই তরফ হতে।
হজরত ইউনুস (আঃ) - এর দোয়া
হজরত ইউনুস (আঃ) আল্লাহর একজন প্রিয় নবি ছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর নামে পবিত্র কোরআনের একটি সূরা নাজিল করেছেন।
হজরত ইউনুস (আঃ) দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁর কওমকে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারা তাওহিদের দাওয়াত কবুল না করে, মুশরিক হিসেবেই জীবনযাপন করতে থাকে। হজরত ইউনুস (আঃ) তাঁর জাতির অজ্ঞতা ও কুফরির কারণে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। আর এ কারণেই আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই শহর হতে বেরিয়ে যান। সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে পৌঁছেন এবং নৌকাতে অরোহণ করেন।
নৌকা চলার পথে সমুদ্রে তুফান উঠে। নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয় হয়। অন্যদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে লটারির মাধ্যমে হজরত ইউনুসকে (আঃ) অশান্ত সমুদ্রের মাঝে নিক্ষেপ করে। আল্লাহর হুকুমে একটি বড় মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। কিন্তু ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে হজম হন নি। তিনি বুঝতে পারেন যে, এটা আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই দায়িত্বত্যাগ করে আসার শাস্তি। এমতাবস্থায় সমুদ্রের অন্ধকার তলদেশে, মাছের পেটে ভগ্নহৃদয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
لا إِلهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمين ‏
(হে আমার রব্‌!) আপনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, আপনি পবিত্র, নিঃসন্দেহে আমি অত্যাচারী। (সুরা: আল্‌ আম্বিয়া, ৮৭।)
ইবনে জারির, সা'দ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, 'রাসুল (সাঃ) হতে শুনেছি, তিনি বলেন: আল্লাহর পবিত্র নামসমূহের মধ্যে এমন একটি নাম রয়েছে যা ধরে ডাকলে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন। বান্দা যা চায় তাই দেন। আর সে পবিত্র নাম হচ্ছে সেই নাম, যেনাম ধরে হজরত ইউনুস (আঃ) আল্লাহকে ডাকেন।' সাহাবি বলেন, 'আমি রাসুলকে (সাঃ) প্রশ্ন করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সে পবিত্র নাম কি শুধুমাত্র হজরত ইউনুস (আঃ) - এর জন্যেই প্রযোজ্য ছিল; না সমস্ত মুসলমানই সে পবিত্র নামধরে আল্লাহকে ডাকতে পারবে?' উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বল্লেন: 'হজরত ইউনুসসহ (আঃ) সমস্ত মুমিনই সে পবিত্র নামধরে আল্লাহকে ডাকতে পারবে। কেননা পরবর্তী আয়াতে এসেছে:
فَاسْتَجَبْنا لَهُ وَ نَجَّيْناهُ مِنَ الْغَمِّ وَ كَذلِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنين‏
অতঃপর আমি তাঁর দোয়া কবুল করলাম এবং তাঁকে চিন্তা হতে মুক্তি দিলাম। আর আমি এভাবে ইমানদারগণকে মুক্তি দিয়ে থাকি। (সুরা: আল্‌ আম্বিয়া, ৮৮।)

হজরত মুসা (আঃ) - এর দোয়া
পবিত্র কোরআনে যেসব নবির জীবনী বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে হজরত মুসার (আঃ) জীবনী উল্লেখযোগ্য। জ্যোতিষীরা ফেরাউনকে বলে, 'খুব অচিরেই এমন এক সন্তান জন্মগ্রহণ করতে যাচ্ছে, যে তোমার সিংহাসনকে ধ্বংস করবে।' এ খবর শোনার পর ফেরাউন চেষ্টা চালায় যাতে হজরত মুসা (আঃ) পৃথিবীতে আসতে না পারেন। কিন্তু ফেরাউনের সমস্ত বাধা- বিপত্তিকে উপেক্ষা করে আল্লাহর ইচ্ছায় হজরত মুসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ফেরাউনের বাড়িতেই লালিত-পালিত হন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে রাসুল হিসেবে মনোনীত করেন এবং তাঁর
উপর কিতাব অবতীর্ণ করেন। অতঃপর হজরত মুসা (আঃ) মানুষকে তাওহিদের দাওয়াত দিতে থাকেন। পবিত্র কোরআনে হজরত মুসার (আঃ) যেসব দোয়া উল্লেখ হয়েছে তা নিম্নে বর্ণিত হল:

হজরত মুসা (আঃ) - এর এস্তেগফার ও দোয়া
হজরত মুসা (আঃ) নবুওতপ্রাপ্তির পর একদা রাত্রে মিসরে প্রবেশ করেন। সে রাত ছিল ইদের রাত। লোকজন আনন্দ- খুশিতে মেতে ছিল। হজরত মুসা (আঃ) দেখেন, তাঁর একজন অনুসারী ও ফেরাউনের একজন অনুসারী মারামারি করছে। হজরত মুসা (আঃ) - এর অনুসারীটি তাঁর নিকট সাহায্যপ্রার্থনা করে। হজরত মুসা (আঃ) ফেরাউনের অনুসারীকে মারামারি করতে নিষেধ করেন। কিন্তু সে তাঁর কথা শোনে নি। মুসা (আঃ) তাঁর অনুসারীর পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে সেই কিবতিকে একটি ঘুষি মারেন এবং তাতে কিবতিব্যক্তি মারা যায়। এতে তিনি অনুতপ্ত হন। কেননা তাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা তাঁর ছিলনা। এমতাবস্থায় হজরত মুসা (আঃ) আল্লাহর নিকট দু'হাত তুলে দোয়া ও এসতেগফার করেন:
رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسي‏ فَاغْفِرْ لي‏ فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحيمُ
হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা কর। তখন আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সুরা: আল্‌ ক্বাসাস, ১৬।)
প্রশ্ন: 'আমি নিজের উপর জুলুম করেছি' একজন নবির এ বাক্যটি বলার অর্থ কি? এটা কি 'ইসমত বা পাপশূন্য' থাকার বিপরীত নয়?
উত্তর: অবশ্যই হজরত মুসা (আঃ) গুনাহে লিপ্ত হননি। কোনো নবিই গোনাহ্‌ করতে পারেন না। এখানে 'নিজের উপর জুলুম' অর্থাৎ সামাজিক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া (তাফসিরে নুর, খঃ ৯, পৃঃ ৩০।তাফসিরে নুর, খঃ ৯, পৃঃ ৩০।)। কেননা মুসা (আঃ) মজলুম ব্যক্তিকে সাহায্য করতে যান। মজলুমের পক্ষথেকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে, অনিচ্ছাকৃতভাবে জালেম ব্যক্তিকে হত্যা করেন। একারণে একদিকে যেমন নিজে অনুতপ্ত হন অপরদিকে তৎকালীন অত্যাচারী সমাজের আক্রমণেরও আশঙ্কা করেন। ফলে তিনি উক্তভাবে দোয়া করেন।
তাফসিরে নমুনায় উল্লেখ হয়েছে যে, হজরত মুসা (আঃ) 'র্তা‌কে আওলা' করেছেন (যা পরিহার করা শ্রেয়তর ছিল তাতে তিনি জড়িত হয়েছেন) যা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত নয়। (তাফসিরে নমুনা খঃ ১৬, পৃঃ ৪৩।)
মরহুম আল্লামা তাবাতাবায়ি লিখেন: যেহেতু হজরত মুসা (আঃ) নিজেই নিজেকে বিপদে ফেলেন সেহেতু এ ধরনের দোয়া করেন, প্রকৃত গোনাহের কারণে নয় (তাফসিরে আল্‌ মিজান, খঃ ১৬, পৃঃ ২১।)। সুতরাং এটা ইসমতের বিপরীত নয়।

শিক্ষা:
১) নিজের অপরাধ সম্পর্কে অবগত হওয়ার সাথে সাথে ইসতেগফার করতে হবে।
২) আল্লাহ ক্ষমাশীল। তাঁর রহমত হতে নিরাশ না হয়ে তওবাকরা ও ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত।
৩) নেককার ব্যক্তিরা অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্যেও ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।

জালেমদের হাত থেকে মুক্তির জন্যে দোয়া
একজন মোমেনব্যক্তি এসে হজরত মুসাকে (আঃ) খবর দিলেন, 'লোকেরা আপনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি এঅত্যন্ অন্য কোথাও চলে যান।' হজরত মুসা (আঃ) সতর্কতার সহিত শহর হতে বের হয়ে নিম্নোক্তভাবে দোয়া করেন:
رَبِّ نَجِّني‏ مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِم
হে আমার পালনকর্তা! আমাকে জালেম সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করুন। (সুরা: আল্‌ ক্বাসাস, ২১।)
হজরত মুসা (আঃ) মাদায়েন নামক শহরের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। মাদায়েন ছিল তৎকালীন শামদেশের একটি শহর। এ অঞ্চলটি ফেরাউনি রাষ্ট্রের বাইরে ছিল। মাদায়েনকে সফরের লক্ষবস্তু করার কারণ হল, সেখানে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) - এর বংশধরের বসতি ছিল। আর হজরত মুসা (আঃ) এ বংশেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
হজরত মুসা (আঃ) সম্পূর্ণ নিঃসম্বল অবস্থায় মিসর থেকে বের হন। তাঁর সঙ্গে পাথেয় বলতে কিছুই ছিলনা। শুধুমাত্র ছিল আল্লাহর প্রতি ইমান ও ভরসা।

আল্লাহকে দর্শনের জন্যে দরখাস্ত
বনিইসরাইলের একটি দল হজরত মুসার (আঃ) নিকট এসে বলে, 'আমরা আল্লাহকে দেখতে চায়। আল্লাহকে দর্শন না করে আমরা কখনই ইমান আনব না।' হজরত মুসা (আঃ) তাদের মধ্য থেকে সত্তরজন লোককে বাছাই করেন এবং তাদের চাহিদাকে পূরণ করার জন্যে, আল্লাহকে দর্শনের দরখাস্ত করেন।
رَبِّ أَرِني‏ أَنْظُرْ إِلَيْكَ قالَ لَنْ تَراني‏ وَ لكِنِ انْظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكانَهُ فَسَوْفَ تَراني‏ فَلَمَّا تَجَلَّى رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا وَ خَرَّ مُوسى‏ صَعِقاً فَلَمَّا أَفاقَ قالَ سُبْحانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَ أَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنينَ
'হে আমার প্রভু! আমাকে দর্শন দাও, আমি তোমাকে দেখব।' তিনি (আল্লাহ) বল্লেন, 'তুমি আমাকে কখনই দেখতে পাবেনা। তুমি বরং পাহাড়ের দিকে দেখ, সেটি যদি স্বস্থানে স্থির থাকে তবে তুমি আমাকে দেখতে পাবে।' তারপর যখন তাঁর রব পর্বতের উপর জ্যোতি প্রকাশ করলেন তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করল এবং মুসা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। অতঃপর যখন তাঁর জ্ঞান ফিরে এল, বল্লেন: 'মহিমময় তুমি, আমি অনুতপ্ত হয়ে তোমাতেই প্রত্যাবর্তন করলাম এবং মোমিনদের মধ্যে আমিই প্রথম।' (সুরা: আল্‌ আ'রাফ, ১৪৩।)
এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে,
হজরত মুসা (আঃ) তো জানতেন যে, আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়; তাহলে কেন তিনি দেখার জন্যে আবেদন করেন?
উত্তর এই যে,
হজরত মুসা (আঃ) - এর এই দরখাস্ত প্রকৃতপক্ষে নিজের পক্ষ হতে ছিল না। কেননা তিনি জানতেন যে, আল্লাহ্‌কে বাহ্যিক চোখের মাধ্যমে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর উম্মত বায়না ধরেছিল যে, তারা আল্লাহ্‌কে স্বচক্ষে না দেখে তাঁর প্রতি ইমান আনবে না। বিধায় হজরত মুসা (আঃ) তাঁর উম্মতের অহেতুক দাবী এড়াতে না পেরে এই দরখাস্ত করেন।

দায়িত্বপালন সহজ হওয়ার জন্যে দোয়া
দায়িত্ব পালন করার জন্যে উদারতা ও প্রশস্ত হৃদয়-মনের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। ধৈর্য-সহ্য কম হলে, বিভিন্ন চাপের মুখে টিকে থাকা সম্ভব নয়। হজরত মুসা (আঃ) দীনপ্রচার করতে গিয়ে সফলকাম হওয়ার জন্যে নিম্নোরূপে দোয়া করেন:
رَبِّ اشْرَحْ لي‏ صَدْري * وَ يَسِّرْ لي‏ أَمْري * وَ احْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِساني يَفْقَهُوا قَوْلي
হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দাও। আমার কর্ম সহজ করে দাও এবং আমার জিহ্বার জড়তা দূর কর, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। (সুরা: ত্বাহা, ২৫-২৮।)

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
১) যেকোনো কাজে সফল হওয়ার জন্যে প্রশস্ত হৃদয়-মনের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন।
২) কোনো দায়িত্বকে ভয় না করে সর্বপ্রথম আল্লাহর নিকট সাহায্য কামনাকরা উচিত।
৩) আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে।
৪) জালেমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে ধৈর্যধারণ করতে হবে।
৫) উগ্রতা ও রূঢ়তার মাধ্যমে দীনপ্রচার করা সম্ভব নয়।
৬) উদারতা থাকলে সহজেই কাজ আন্‌জাম দেওয়া যায়।
৭) লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পৌঁছতে হলে মানুষকে সহজভাষায় বোঝাতে হবে।

ফেরাউনের বিরুদ্ধে হজরত মুসার (আঃ) দোয়া
হজরত মুসা (আঃ) দীর্ঘদিন যাবৎ ফেরাউনকে আল্লাহর পথে দাওয়াত করেন। কিন্তু সে এবং তার অনুসারীরা একত্ববাদের দাওয়াত তো কবুল করেইনি বরং হজরত মুসার (আঃ) অনুসারীদেরকে অত্যাচার ও নির্যাতন করতে থাকে এবং মসজিদগুলো ভেঙ্গে দেয়। এমতাবস্থায় তিনি তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
رَبَّنا إِنَّكَ آتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَ مَلَأَهُ زينَةً وَ أَمْوالاً فِي الْحَياةِ الدُّنْيا رَبَّنا لِيُضِلُّوا عَنْ سَبيلِكَ رَبَّنَا اطْمِسْ عَلى‏ أَمْوالِهِمْ وَ اشْدُدْ عَلى‏ قُلُوبِهِمْ فَلا يُؤْمِنُوا حَتَّى يَرَوُا الْعَذابَ الْأَليمَ
হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি ফেরাউন ও তার নেতৃবৃন্দকে পার্থিব জীবনে সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদ দান করেছ যদ্বারা, হে আমাদের প্রতিপালক! ওরা মানুষকে তোমার পথ হতে বিভ্রান্ত করে। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের সম্পদগুলি বিলুপ্ত করে দাও এবং তাদের অন্তরসমূহকে মোহর করে দাও, ওরা তো মর্মন্তুদ শাস্তি না দেখা পর্যন্ত ইমান আনবে না। (সুরা: ইউনুস, ৮৮)

হজরত ইসার (আঃ) দোয়া
হাওয়ারিরা হজরত ইসার (আঃ) নিকট ঘোষণা করে, 'আমরা আপনার সঙ্গেই আছি; তবে আমাদের দরখাস্ত হচ্ছে আপনি আল্লাহর নিকট হতে আমাদের জন্যে মায়েদা'র (খাদ্যভর্তি খাঞ্চা) জন্যে দোয়া করেন যা থেকে আমরা ভক্ষণ করব এবং এর ফলে আমাদের অন্তর পরিতৃপ্ত হবে।' হজরত ইসা (আঃ) আল্লাহর নিকট দোয়া করেন:
اللَّهُمَّ رَبَّنا أَنْزِلْ عَلَيْنا مائِدَةً مِنَ السَّماءِ تَكُونُ لَنا عيداً لِأَوَّلِنا وَ آخِرِنا وَ آيَةً مِنْكَ وَ ارْزُقْنا وَ أَنْتَ خَيْرُ الرَّازِقين ‏
হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা প্রেরণ কর; তা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার জন্যে হবে আনন্দোৎসবস্বরূপ এবং তোমার পক্ষ হতে এক নিদর্শন। আর আমাদেরকে রুজিদান কর; তুমিই তো সর্বোত্তম রুজিদাতা। (সুরা: আল্‌ মায়েদা, ১১৪।)
এ দোয়ায় বিশেষ একটি লক্ষণীয় দিক হল: 'আল্লাহুম্মা' শব্দ দ্বারা শুরু হয়েছে। অথচ অন্যান্য সব নবির দোয়াই 'রব্বানা' শব্দ দ্বারা শুরু হয়েছে। কোনো কোনো মোফাস্‌সেরের মতে, এ ঘটনাটি বিশেষগুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ উক্ত দোয়াটি কবুল করেন এবং তাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, 'আমি তোমাদের জন্যে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা প্রেরণ করব, তবে সাবধান! এ খাদ্যভর্তি খাঞ্চা প্রেরণের পর তোমাদের দায়িত্ব হবে অত্যন্ত ভারী। এই স্পষ্ট মোজেযা দেখার পরও যদি কেউ কুফরির পথ অবলম্বন করে তাহলে তাকে এমন ভয়াবহ শাস্তি দেব যা পৃথিবীর কাউকেই দেইনি!'
এ মায়েদা বা খাদ্যভর্তি খাঞ্চাতে কি ধরনের খাদ্য ছিল, সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করা হয়নি। তবে ইমাম বাকের (আঃ) হতে বর্ণিত হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, এ খাঞ্চাতে কয়েকটি রুটি ও কয়েকটি মাছ ছিল। (তাফসিরে নমুনা, খঃ ৫, পৃঃ ১৩০।)

মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) - এর দোয়া
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদকে (সাঃ) যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষা দান করেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে দোয়া। নবি করিমকে (সাঃ) বিভিন্নভাবে দোয়া শিক্ষা দেন এবং তার সাথে সাথে দোয়া করার নির্দেশও দেন। এরশাদ হচ্ছে:
قُلِ اللَّهُمَّ فاطِرَ السَّماواتِ وَ الْأَرْضِ عالِمَ الْغَيْبِ وَ الشَّهادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبادِكَ في‏ ما كانُوا فيهِ يَخْتَلِفُونَ
বলুন, 'হে আল্লাহ, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা, দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী! তোমার বান্দাগণ যে বিষয়ে মতবিরোধ করে, তুমি তাদের মধ্যে তার ফয়সালা করে দিবে।' (সুরা: জুমার, ৪৬।)
قُلْ رَبِّ إِمَّا تُرِيَنِّي ما يُوعَدُونَ * رَبِّ فَلا تَجْعَلْني‏ فِي الْقَوْمِ الظَّالِمين ‏
বলুন, 'হে আমার পালনকর্তা! যে বিষয়ে তাদেরকে ওয়াদা দেওয়া হচ্ছে তা যদি তুমি আমাকে দেখাতে চাও, তবে হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে জালেম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করিও না।' (সুরা: আল্‌ মুমিনুন, ৯৩-৯৪।)
এটা চিরসত্য যে, নবি করিম (সাঃ) কখনই এমন আমল আন্‌জাম দেননি যার কারণে অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাছাড়া এটাও মহান আল্লাহর আদল বা ইনসাফের বিপরীত যে, আল্লাহ তাআলা কোনো গোনাহ্‌কারীর কারণে অন্যকে শাস্তি দিবেন। কিন্তু যেহেতু মহানবি (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশে উক্ত দোয়া করেছেন সেহেতু এর কারণ হল:
১) এখানে কাফেরদেরকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে যে, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও চূড়ান্ত। সুতরাং মহানবির মত ব্যক্তিত্বও যেন এ বিষয়ে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং তাঁর নিকট মুক্তি কামনা করেন।
২) এখানে সমস্ত উম্মতের জন্যে শিক্ষণীয় বিষয় হল: কখনই কেউ যেন নিজকে শাস্তিমুক্ত মনে করে, আল্লাহকে ভুলে না যায়। বরং সর্বাবস্থায়ই আল্লাহর সাহায্য কামনা করে।
মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবিকে (সাঃ) আরও শিক্ষা দেন, 'হে নবি! আপনি নিম্নোক্তরূপে দোয়া করবেন':
وَ قُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزاتِ الشَّياطينِ* وَ أَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُون ‏
বলুন, 'হে আমার পালনকর্তা! আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি। হে আমার রব! আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট ওদের উপস্থিতি হতে।' (সুরা: আল্‌ মুমিনুন, ৯৭-৯৮।)
মহানবির (সাঃ) মত ব্যক্তিত্ব, যিনি পাপশূন্য হওয়া সত্ত্বেও যদি এভাবে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন তাহলে অন্যদের করণীয় কি!? অবশ্যই সকল মোমেন বান্দারই উচিত, সব সময় এভাবে আল্লাহর নিকট দোয়া করা যাতেকরে কখনই যেন শয়তানের প্ররোচনার শিকার না হন।
সুরা আলে ইমরানের মধ্যেও আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসুলকে (সাঃ) শিক্ষা দেন:
قُلِ اللَّهُمَّ مالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشاءُ وَ تَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشاءُ وَ تُعِزُّ مَنْ تَشاءُ وَ تُذِلُّ مَنْ تَشاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلى‏ كُلِّ شَيْ‏ءٍ قَدير * تُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهارِ وَ تُولِجُ النَّهارَ فِي اللَّيْلِ وَ تُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَ تُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَ تَرْزُقُ مَنْ تَشاءُ بِغَيْرِ حِسابٍ
বলুন, 'হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! আপনি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নেন; যাকে ইচ্ছা আপনি পরাক্রমশালী করেন আর যাকে ইচ্ছা হীন করেন। আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। আপনিই রাতকে দিনে পরিণত করেন এবং দিনকে রাতে পরিণত করেন। আপনিই মৃত হতে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটান, আবার জীবন্ত হতে মৃতের আবির্ভাব ঘটান। আপনি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিজ্‌ক দান করেন।' (সুরা: আলে ইমরান, ২৬-২৭।)
এছাড়াও 'সুরা ফালাক ও সুরা নাস' নামক পরিপূর্ণ দুটি সুরা অবতীর্ণ হয় যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় নবি (সাঃ) ও সমস্ত মুসলমানকে শিক্ষা দেন যে, কিভাবে আল্লাহর আশ্রয়গ্রহণ করতে হবে এবং ফলশ্রুতিতে সমস্ত ক্ষতিকারকের ক্ষতি হতে বেঁচে থাকা যাবে।

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمنِ الرَّحيمِ ‏
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ * مِنْ شَرِّ ما خَلَقَ * وَ مِنْ شَرِّ غاسِقٍ إِذا وَقَبَ * وَ مِنْ شَرِّ النَّفَّاثاتِ فِي الْعُقَدِ * وَ مِنْ شَرِّ حاسِدٍ إِذا حَسَدَ
পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
বলুন, 'আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের প্রতিপালকের, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে, রাতের অনিষ্ট থেকে যখন তা গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়, এবং সে সব নারীর অনিষ্ট হতে যারা গ্রন্থিতে ফুৎকার দেয় এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।'
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمنِ الرَّحيمِ ‏
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ * مَلِكِ النَّاسِ * إِلهِ النَّاسِ * مِنْ شَرِّ الْوَسْواسِ الْخَنَّاسِ * الَّذي يُوَسْوِسُ في‏ صُدُورِ النَّاسِ * مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ
পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
বলুন, 'আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের রবের, মানুষের অধিপতির, মানুষের মাবুদের নিকট আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জিন্নের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।
এ সুরাদ্বয়ের শানে নুজুল বর্ণনায় বিভিন্ন হাদিস এসেছে এবং অনেক তাফসিরেই নিম্নোক্তভাবে শানে নুজুল বর্ণনা করা হয়েছে:
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে, জনৈক ইহুদি রসুলুল্লাহ্‌ (সাঃ) - এর উপর জাদু করে। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। জিবরাইল (আঃ) আগমন পূর্বক সংবাদ দেন যে, জনৈক ইহুদি জাদু করেছে এবং যে জিনিসে জাদু করা হয়েছে, তা অমুক কূপের মধ্যে আছে। রসুলুল্লাহ (সাঃ) লোক পাঠিয়ে সে জিনিসটি কূপ থেকে উদ্ধার করেন। তাতে কয়েকটি গ্রন্থি ছিল। তিনি গ্রন্থিগুলো খুলার সাথে সাথেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, পৃঃ ১৪৮৪।)
পক্ষান্তরে মরহুম তাবারসিসহ অনেক মোফাসসেরই এ ধরনের শানে নুজুল গ্রহণ করেন নি। কেননা জাদুগ্রস্ত হওয়াকে নবুওতের পরিপন্থী বলে মনে করেন। কারণ হল:

১) উপরের শানে নুজুল সম্পর্কিত হাদিসটি হজরত আয়েশা ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত অন্য হাদিস অনুযায়ী, এ সুরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে প্রমাণিত। অপরদিকে রসুলের মক্কি জীবনে ইহুদিদের সহিত কোনো মতবিরোধ ছিলনা বরং মুশরিকরা রসুলের বিরোধিতা করত। রসুল (সাঃ) মদিনায় হিজরতের পর ইহুদিরা তাঁর সহিত বিরোধিতা শুরু করে।
২) মহানবি (সাঃ) এত সহজেই যদি জাদুকরদের প্রভাবে জাদুগ্রস্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং জাদু তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করে, তাহলে কিভাবে তিনি রেসালতের এ মহান দায়িত্ব পালন করবেন? তাছাড়া মহান আল্লাহ যিনি তাঁর রসুলকে রেসালতের এ মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, অবশ্যই তিনি তাঁকে জাদুকরদের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন; যাতেকরে নবুওতকে তারা হুমকির মুখে ফেলতে না পারে।
৩) জাদু যদি মহানবির শরীরের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তাহলে তাঁর আত্মার উপরেও প্রভাব ফেলা সম্ভব। আর আত্মার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারলে, রসুলের চিন্তাধারা জাদুকরদের ষড়যন্ত্রের স্বীকার হতে পারে। এতেকরে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে দুর্বলতা আসাই স্বাভাবিক। এ কারণেই পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টিকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যথা:
وَ قالَ الظَّالِمُونَ إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلاَّ رَجُلاً مَسْحُوراً
জালেমরা বলে, 'তোমরা তো নিছক একজন জাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছ।' (সুরা: আল্‌ ফুরক্বান, ৮।)
৪) 'নবি করিম (সাঃ) জাদুকরদের প্রভাব থেকে বেঁচে থাকার জন্যে আল্লাহ তাআলার নিকট আশ্রয় কামনা করেন;' - এর অর্থ এই নয় যে, রসুল (সাঃ) নিজেও জাদুগ্রস্ত হন। যেমন- তিনি অন্যান্য দোয়ায় যাবতীয় রকমের ভুল-ত্রুটি হতে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করেন; অথচ তিনি জীবনে কোনো গুনাহে লিপ্ত হননি। বরং তিনি মাসুম বা নিষ্পাপ। এখানেও ঠিক অনুরূপ, জাদুগ্রস্ত না হওয়ার জন্যে আল্লাহর নিকট আশ্রয় কামনা করেন। বিধায় এমন সন্দেহযুক্ত হাদিস মানা যাবেনা যার কারণে নবুওতের পবিত্রতা প্রশ্নের সম্মুখিন হয়। (তাফসিরে নমুনা, খঃ ২৭, পৃঃ ৪৫৪-৪৫৭।)

সুরা নাস ও ফালাক তেলাওতের ফজিলত
ইমাম বাকের (আঃ) বলেন: যেব্যক্তি বেতর নামাজে (নামাজে শাফ্‌আ' এবং বেতর) সুরা ফালাক, সুরা নাস ও সুরা ইখলাস তেলাওত করে, তাকে বলা হয়, 'হে আল্লাহর বান্দা! তোমার জন্যে সুসংবাদ, আল্লাহ তাআলা তোমার বেতরের নামাজ কবুল করেছেন।' (তাফসিরে নুরুস্‌ সাকালাইন, খঃ ৫, পৃঃ ৭৬৬।)
মহানবি (সাঃ) বলেন: 'যেব্যক্তি সুরা ফালাক ও সুরা নাস তেলাওত করে, সে যেন সকল নবির প্রতি অবতীর্ণ কিতাবসমূহ তেলাওত করল।' (তাফসিরে মাজমাউল বায়ান, খঃ ১০, পৃঃ ৮৬৪।)

ন্যায়বিচার প্রার্থনা করে দোয়া
মহানবি (সাঃ) কাফেরদেরকে সৎপথের দাওয়াত দেন। তারা দাওয়াত কবুলকরা তো দূরের কথা, বরং বিভিন্নভাবে মহানবির দাওয়াতি কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তিনি তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর দরবারে দু'হাত তুলে দোয়া করেন:
رَبِّ احْكُمْ بِالْحَقِّ وَ رَبُّنَا الرَّحْمنُ الْمُسْتَعانُ عَلى‏ ما تَصِفُون‏
রসুল বল্লেন, 'হে আমার রব! তুমি ন্যায়ের সহিত ফয়সালা করে দিও, আর আমাদের পালনকর্তা তো দয়াময়, তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে একমাত্র সহায়স্থল তিনিই।' (সুরা: আল্‌ আম্বিয়া, ১১২।)
আল্লাহ তাআলা সব সময়ই ন্যায় ও সঠিক ফয়সালা করে থাকেন। তবুও নবি করিম (সাঃ) সঠিক ফয়সালার উল্লেখ করে দোয়া করেন; এর অর্থ হচ্ছে, 'হে আল্লাহ! তুমি সত্যকে বাতিলের উপর দৃশ্যমান করে দাও।' (তাফসিরে আল্‌ মিজান, খঃ ১৪, পৃঃ ৩৩৩।)
হাদিসে এসেছে, রসুল (সাঃ) যখনই যুদ্ধে মুশরিকদের মুখোমুখি হতেন তখনই উক্তভাবে দোয়া পাঠ করতেন। এটা প্রমাণ করে যে, 'চেষ্টা এবং দোয়া' দুটোই আন্‌জাম দিতে হবে। (তাফসিরে হেদায়াত, খঃ ৮, পৃঃ ৭।)

সঠিকভাবে কাজ আন্‌জাম দেওয়ার দোয়া
মহান আল্লাহ তাঁর রসুলকে (সাঃ) তাহাজ্জুদ নামায পড়ার নির্দেশদানের পর নিম্নোক্ত দোয়াটি শিক্ষা দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'হে রসুল! আপনি এ প্রার্থনা করুন':
ْ رَبِّ أَدْخِلْني‏ مُدْخَلَ صِدْقٍ وَ أَخْرِجْني‏ مُخْرَجَ صِدْقٍ وَ اجْعَلْ لي‏ مِنْ لَدُنْكَ سُلْطاناً نَصيراً
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে (প্রতিটি কাজে) কল্যাণের সহিত প্রবেশ করাও এবং আমাকে কল্যাণের সহিত বের করাও এবং তোমার নিকট হতে (কাফেরদের উপর) আমাকে দান করো সাহায্যকারী শক্তি। (সুরা: বনিইসরাইল, ৮০।)
সততা যেকোনো ব্যক্তি বা কাজকে সৌন্দর্য দান করে। যে কাজ অসৎ, অহঙ্কার, ধোঁকাবাজি ও অন্যায়ের নিয়তে শুরু হয়, সেকাজে বরকত থাকেনা এবং তার পরিণামও ভাল হয় না।
ইমাম সাদিক (আঃ) বলেন: 'যদি কোনো কাজ শুরু করতে ভয় পাও তাহলে প্রথমে উক্ত আয়াতটি পাঠ কর, তারপর পদক্ষেপ নাও।' (তাফসিরে নুর, খঃ ৭, পৃঃ ১০৭।)

ক্ষমাপ্রার্থনা
ইহা এমন এক দোয়া যা মহানবি (সাঃ) সব সময়ই পাঠ করতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর রসুলকে (সাঃ) শিক্ষা দেন যে, নিজের জন্যে এবং উম্মতের জন্যে নিম্নোক্ত দোয়া করুন:
رَبِّ اغْفِرْ وَ ارْحَمْ وَ أَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمين‏
হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন ও অনুগ্রহ করুন। আর আপনি সর্বশ্রেষ্ট অনুগ্রহকারী। (সুরা: আল্‌ মোমিনুন, ১১৮।)

জ্ঞানবৃদ্ধির জন্যে দোয়া
বিদ্যা এমনই এক সম্পদ যা কখনই কারও নিকট উদ্বৃত্ত হয় না। মহানবির (সাঃ) মত ব্যক্তিত্ব যার জ্ঞান অবশ্যই সমস্ত মাখলুকের চেয়ে বেশী, তবুও তিনি নিম্নোক্তরূপে দোয়া করতেন:
رَبِّ زِدْني‏ عِلْما
হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটান। (সুরা: ত্বাহা, ১১৪।)
বিদ্যাশিক্ষার জন্যে কোনো স্থানের সীমাবদ্ধতা নেই। মহানবি (সাঃ) বলেন, 'বিদ্যার্জন কর, যদিও চীনে যেতে হয়।'
বিদ্যার্জনের জন্যে কালের সীমাবদ্ধতা নেই। দোলনা হতে কবর পর্যন্ত বিদ্যা শিখতে হবে।
বিদ্যাশিক্ষার জন্যে শিক্ষকের ব্যাপারেও কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। হেকমত বা প্রজ্ঞা হচ্ছে মোমিন ব্যক্তির হারানো সম্পদের ন্যায়। যেকারও নিকট হোক না কেন, তা গ্রহণ করতে হবে। মণি-মুক্তা যেস্থানেই থাক না কেন সবাই তার মূল্যায়ন করে। ইসলামি দর্শনে 'শিক্ষাসমাপনী' শব্দটি অর্থহীন। একজন প্রকৃত মুসলমানের শিক্ষা কখনই শেষ হয় না। তিনি সব সময়ই ছাত্র।
ইমাম সাদিক (আঃ) তাঁর একজন সাহাবাকে বলেন: 'প্রত্যেক শুক্রবার রাতে আমাদের একটি বিশেষ আনন্দ রয়েছে।' সাহাবি বিনয়ের সহিত প্রশ্ন করল, 'আল্লাহ তাআলা এ অনন্দকে আরও বৃদ্ধি করুন! তবে সে আনন্দটি কি?' তিনি (ইমাম) বল্লেন, 'যখন শুক্রবারের রাত হয় তখন রসুলুল্লাহর (সাঃ) পবিত্র রুহ, ইমামগণের (আঃ) পবিত্র রুহ এবং তাঁদের সহিত আমাদের রুহ আল্লাহর আরশে যায়। অতঃপর আমাদের রুহগুলি নতুন জ্ঞান দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে দেহে ফিরে আসে। আর যদি এমনটি না হতো তাহলে আমাদের বিদ্যা সসীম হয়ে যেত।' (তাফসিরে নুরুস্‌ সাকালাইন, খঃ ৩, পৃঃ ৩৯৭।)
মহানবি (সাঃ) বলেন: 'সেব্যক্তি সর্বাধিক জ্ঞানী, যিনি নিজের জ্ঞানভাণ্ডারকে অন্যের জ্ঞান দ্বারা সমৃদ্ধ করেন। আর তিনিই সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি যিনি সবচেয়ে জ্ঞানী। এবং সেই সবচেয়ে মূল্যহীন ব্যক্তি যার জ্ঞান সবচেয়ে কম।' (সাফিনাতুল বিহার, খঃ ২, পৃঃ ২১৯।)
উপরোক্ত আলোচনা হতে আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলাম জ্ঞানার্জনকে কত গুরুত্ব দিয়েছে! বিধায় আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করব এবং সর্বদাই নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করব:
رَبِّ زِدْني‏ عِلْما
হে আমার রব্‌! আমার জ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটান।

শবে মেরাজে রসুল (সাঃ) - এর দোয়া
মহানবি (সাঃ) তাঁর আধ্যাত্মিক সফর মেরাজে যাওয়ার পর নিজের পক্ষ হতে এবং ইমানদারদের পক্ষ হতে নিম্নোক্তরূপে দোয়া করেন:
رَبَّنا لا تُؤاخِذْنا إِنْ نَسينا أَوْ أَخْطَأْنا رَبَّنا وَ لا تَحْمِلْ عَلَيْنا إِصْراً كَما حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذينَ مِنْ قَبْلِنا رَبَّنا وَ لا تُحَمِّلْنا ما لا طاقَةَ لَنا بِهِ وَ اعْفُ عَنَّا وَ اغْفِرْ لَنا وَ ارْحَمْنا أَنْتَ مَوْلانا فَانْصُرْنا عَلَى الْقَوْمِ الْكافِرين ‏
হে আমাদের রব্‌! আমরা যদি ভুলে যায় কিংবা ভুল করি তবে আমাদেরকে পাকড়াও করিও না। হে আমাদের রব্‌! আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেমন গুরুদায়িত্ব অপর্ণ করেছিলে আমাদের উপর তেমন দায়িত্ব অর্পণ করিও না। হে আমাদের রব্‌! আমাদের উপর এমন কোনো ভার অর্পণ করিও না যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আর আমাদের পাপমোচন কর, আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি কৃপা কর। তুমিই আমাদের অভিভাবক। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে জয়যুক্ত কর। (সুরা: আল্‌ বাক্বারা, ২৮৬।)
এ দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সবধরনের করুণা প্রার্থনা করা হয়েছে। যথা:
প্রথমতঃ এমন ক্ষমার দরখাস্ত করা হয়েছে যাতে গুনাহ্‌র 'বাহ্যিক প্রভাব ও শাস্তি' উভয় হতেই যেন পরিত্রাণ দেওয়া হয়। গুনাহ্‌র বাহ্যিক প্রভাব রয়েছে। যেমন- কেউ কাউকে ভুল করে আঘাত করলেও আঘাতকৃত ব্যক্তি ব্যথা পাবে - যদিও আঘাতকারীকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয়তঃ এমন ক্ষমা চাওয়া হয়েছে যাতেকরে গুনাহ্‌র আত্মিক প্রভাবও যেন নিশ্চিহৃ হয়ে যায়।
তৃতীয়তঃ আল্লাহর রহমত হতে উপকৃত এবং কাফেরদের উপর বিজয় কামনা করা হয়েছে।
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন