চির সংগ্রামী আল্লামা ফাজলুল্লাহ
চির সংগ্রামী আল্লামা ফাজলুল্লাহ
মৃত্যুর আগ মুহুর্তের কথা। হাসপাতালের বেডে মৃত্যুশয্যায় শায়িত আল্লামা ফাজলুল্লাহকে বেশ অস্থির মনে হচ্ছিল। তাই এক নার্স তাকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনি একটু শান্ত হোন প্লিজ। উত্তরে তিনি বললেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমি শান্ত হবো না। এরপর ফজরের নামাজের সময় হয়েছে কী না, তা জানতে চাইলেন। নার্স জবাবে বললেন, নামাজের সময় হয়নি এখনো। এরপর আল্লামা ফাজলুল্লাহ তিনবার 'আল্লাহু আকবার' উচ্চারণ করে ঘুমিয়ে গেলেন, আর জাগলেন না। এভাবেই গত চৌঠা জুলাই আল্লামা ফাজলুল্লাহ ৭৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
আল্লামা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ হোসেন ফাজলুল্লাহর জন্ম ইরাকের পবিত্র নাজাফ শহরে ১৯৩৫ সালে। তিনি কয়েক বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর নয় বছর বয়সে ধর্মীয় শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। বাবা নিজে বড় আলেম হবার কারণে ঘরোয়া পরিবেশেই ধর্মীয় শিক্ষার সাথে বিশদ পরিচিতি লাভ করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি তিনি ইরাকের বিশিষ্ট আলেমদের কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে ছাত্রজীবনেও তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সব সময় সক্রিয় থেকেছেন। আরব বিশ্বের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও এর অশুভ পরিণতি আঁচ করতে পেরে তিনি তখন থেকেই তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করে তোলার কাজে সময় দিতে থাকেন। আল্লামা ফাজলুল্লাহ ও শহীদ আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মোহাম্মদ বাকের সাদ্রের যৌথ চেষ্টায় 'হেয্বুদ্দাওয়াতুল ইসলামিয়া' নামে একটি দল গঠিত হয়।
১৯৬৬ সালে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে পিতৃভূমি লেবানন সফর করেন আল্লামা ফাজলুল্লাহ। সে সময় লেবাননের মুসলমানদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না। এ অবস্থা দেখে তিনি লেবাননিই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং লেবাননের তৎকালীন শীর্ষ আলেম ইমাম মুসা সাদ্রের সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। আল্লামা ফাজলুল্লাহ তরুণদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বৈরুতে 'আল মোয়াহহেদুশশারয়ি আল ইসলামিয়া' নামক ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর বেশিরভাগ নেতাই ঐ ধর্মীয় কেন্দ্রে পড়ালেখা করেছেন। এছাড়াও তিনি দক্ষিণ লেবাননের সুর শহরে আল মোর্তজা ধর্মীয় মাদ্রাসা ও বৈরুতে মহিলা মাদ্রাসা গড়ে তুলেন। পাশাপাশি ইসরাইলের আগ্রাসন ও গৃহযুদ্ধে হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন আল্লামা ফাজলুল্লাহ।
অবিসংবাদিত নেতা ইমাম খোমেনী (রহ:)'র নেতৃত্বে ইরানের ইসলামী বিপ্লব আল্লামা ফাজলুল্লাহর ওপর দারুণ প্রভাব ফেলেছিলো। তিনি ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিশ্বে প্রকৃত ইসলাম তুলে ধরার ক্ষেত্রে এক বিরাট অর্জন বলে মনে করতেন। তিনি ইরানের বিপ্লব ও ইমাম খোমেনী (রহঃ) সম্পর্কে লিখেছেন, ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বাধীন ইরানের বিপ্লব বর্তমান যুগে বিশ্বের বুকে ধর্মীয় নেতৃত্বের ভিত্তিতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছে। ধর্ম ও রাজনীতি যে আলাদা নয়, ইমাম খোমেনীর এই দর্শনের প্রতি আল্লামা ফাজলুল্লাহর পূর্ণ সমর্থন ছিলো। তিনি এই দর্শনকে ইসলামী জাগরণ ও মুসলিম ঐক্য জোরদার এবং বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলার জন্য জরুরি বলে মনে করেন। এছাড়া, দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য সংগ্রামের ওপর ইমাম খোমেনী (রহঃ)'র গুরুত্বারোপ, ইহুদিবাদী দখলদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয়ে আল্লামা ফাজলুল্লাহর আগ্রহ ও স্পৃহাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিলো।
লেবাননের হিজবুল্লাহর নির্বাহী পরিষদের উপ-প্রধান আব্দুল করিম ওবায়েদ বলেছেন, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলার বিষয়ে ইসলামী ইরানের অবস্থানকে আল্লামা ফাজলুল্লাহ পুরোপুরি সমর্থন করতেন। তিনি প্রতিরোধের দর্শনকে কেবল লেবাননে নয় গোটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে আল্লামা ফাজলুল্লাহ ইরানি প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাতে ইরানকে ইসলামী চিন্তা ও সংস্কৃতির লালন কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করেন। ইরানের সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদ বিরোধী নীতির প্রতি আল্লামা ফাজলুল্লাহর সমর্থনের কারণে পাশ্চাত্য ও ইহুদিবাদী সরকারগুলো তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয় এবং তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তার বিরুদ্ধে চার দফা হত্যা চেষ্টা হলেও তিনি বেঁচে যান।
লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের ওপর আল্লামা ফাজলুল্লাহর চিন্তা ও দর্শনের গভীর ও স্থায়ী প্রভাব পড়েছে। আজ যে হিজবুল্লাহর সদস্যরা আগ্রাসীদের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে, তারা আল্লামা ফাজলুল্লাহর হাতে গড়া বীর মুজাহিদ। তারা সবাই এই মহান আলেমের ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। এ কারণেই পশ্চিমা মিডিয়া আল্লামা ফাজলুল্লাহকে হিজবুল্লাহর আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে অভিহিত করে থাকে। আল্লামা ফাজলুল্লাহ হিজবুল্লাহর সাংগঠনিক কোন পদে না থাকলেও তার চিন্তা-দর্শন হিজবুল্লাহর ওপর ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। এ কারণে হিজবুল্লাহর মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ তার মৃত্যুর পর বলেছেন, আমরা এক দয়াশীল পিতা ও বিজ্ঞ পথপ্রদর্শককে হারালাম। আল্লামা ফাজলুল্লাহ ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন। তিনি আল-জাজিরা টিভি চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আল্লাহতায়ালা ইহুদিদের বসবাসের জন্য একটি পবিত্র ভূখণ্ডের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে যে দাবি করা হয়, তা বড় মিথ্যাচার এবং এর কোন ভিত্তি নেই। তিনি আরও বলেছেন, ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিন দখল করে নারী ও শিশুসহ ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর নানা পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে।
ইহুদিবাদ বিরোধী চিন্তা-দর্শন ও অবস্থানের কারণে আল্লামা ফাজলুল্লাহর মৃত্যুর পর ইসরাইল এ বিষয়ে শোক প্রকাশকেও মেনে নিতে পারেনি। লেবাননে নিযুক্ত বৃটিশ রাষ্ট্রদূত এই নেতার মৃত্যুর পর "এক মহান ব্যক্তিত্বের বিদায়" শিরোনামে এক শোকবাণী লিখে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্লগে প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত তার শোকবাণীতে লিখেছিলেন, আল্লামা ফাজলুল্লাহর মৃত্যুতে শোক ও মাতমের জন্য লেবানন ছোট্ট একটি স্থান। লেবানন ছাড়িয়ে অন্য প্রান্তেও তার অনুপস্থিতি উপলব্ধি করা যাচ্ছে। তার মতো আরও বেশি ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন রয়েছে এ বিশ্বের। এই শোকবাণী প্রকাশের পরপরই ইহুদিবাদী চাপের মুখে ব্রিটিশ সরকার তা ব্লগ থেকে সরিয়ে নেয়। এছাড়া, আল্লামা ফাজলুল্লাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশের দায়ে ইহুদিবাদ প্রভাবিত মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএন, তাদের সিনিয়র সম্পাদিকা অক্টাভিয়া নাস্রকে বরখাস্ত করেছে। সিএনএন'র এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যের বাক-স্বাধীনতার দাবির অসারতা আরো এক স্পষ্ট হয়েছে।
পশ্চিমা মিডিয়া আল্লামা ফাজলুল্লাহর মৃত্যুর খবর প্রচার করতে গিয়ে একটি ভিত্তিহীন বিষয় প্রচারের চেষ্টা করেছে। পশ্চিমা মিডিয়া বলতে চেয়েছে, হিজবুল্লাহ ও ইরানি নেতাদের সাথে আল্লামা ফাজলুল্লাহর মতবিরোধ ছিলো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আল্লামা ফাজলুল্লাহ ইসলামী ইরান ও সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীকে পশ্চিমা আধিপত্য ও ইসরাইলী আগ্রাসনের মোকাবেলায় ঝাণ্ডাবাহী হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং তিনি হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের নিজের সন্তান বলে মনে করতেন। অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতাও আল্লামা ফাজলুল্লার মৃত্যুতে এক শোকবার্তায় বলেছেন, ধর্ম ও রাজনৈতিক অঙ্গনে আল্লামা ফাজলুল্লাহ ছিলেন এক মহান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি আল্লামা ফাজলুল্লাহর সমর্থনেরও তিনি প্রশংসা করেছেন।
আল্লামা ফাজলুল্লাহ শুধু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিই ছিলেন না তিনি একজন প্রভাবশালী কবিও বটে। আল্লামা ফাজলুল্লাহ মৃত্যুর আগে তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থের রচনা সমাপ্ত করেছেন। এছাড়া, আল্লামা ফাজলুল্লাহর লেখা বইয়ের সংখ্যা ৭০। তবে তিনি এমন সময় পৃথিবী ত্যাগ করলেন যখন বিশ্বে নতুন করে পরিবর্তনের সুর বেজে উঠেছে। মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও দূরত্ব কমে আসতে শুরু করেছে এবং ইসলামী জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি আল্লামা ফাজলুল্লাহর স্বপ্নের কিছুটা বাস্তবায়ন হলেও তার সবচেয়ে বড় স্বপ্নটি এখনও অপূর্ণ রয়ে গেছে। আর তাহলো, ইহুদিবাদীদের হাত থেকে ফিলিস্তিনীদের মুক্তি। তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পতনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
ইমাম জাওয়াদ (আ) এর শুভ জন্মবার্ষিকী
হিজরী ১৯৫ সালের দশই রজব একটি ঐতিহাসিক দিন,একটি পূণ্যময় দিন। কেননা এই দিন পৃথিবীতে এসেছিলেন ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর খান্দানের এমন এক মহান মনীষী, যিনি ছিলেন সবসময় সত্যান্বেষী এবং কল্যাণের পথে অটল অবিচল। তিনি হলেন নবীবংশের নবম ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ)। আল্লাহর দরবারে অশেষ কৃতজ্ঞতা এজন্যে যে,তিনি এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের আদর্শের উজ্জ্বলতা দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন। যে আলোয় মানুষ পেয়েছে জ্ঞানের বিচিত্র সম্ভার, চারিত্র্যিক অনাবিল মাধুর্যসহ মন ও মাননিক অশেষ ফযিলত। আসলে নবীজীর আহলে বাইতের সদস্যগণ কেবল মুসলমানদেরই ধর্মীয় নেতা নন বরং যারাই সত্য পথের সন্ধানী কিংবা কল্যাণকামী-তাদের সবারই নেতা। আহলে বাইতের এই মহান ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ) এর জন্মবার্ষিকীতে আপনাদের সবার প্রতি রইলো অশেষ অভিনন্দন ও প্রাণঢালা মোবারকবাদ।
ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জীবনকাল ছিল খুবই স্বল্প তবে বেশ সমৃদ্ধ। এই স্বল্পায়ু জীবনে তিনি প্রকৃত ইসলামের ওপর বিবর্ণতার যে চাদর পড়েছিল তা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। সেইসাথে আব্বাসীয় হুকুমাতের বৈরী সময়ে মানুষকে সঠিক ইসলামের প্রাণদায়ী শিক্ষায় উজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। আব্বাসীয় শাসকদের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর সবসময়ই রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরোপিত ছিল। এ কারণে তাঁর সম্পর্কিত খবরাখবর সময়মতো মানুষের কানে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিন্তু সূর্যকে মেঘ যতোই আড়াল করুক না কেন তাতে কি পৃথিবী আলোবঞ্চিত থাকে? কিছুতেই না। শাসকরা যদিও ইমামের কর্মকাণ্ড বা তৎপরতায় সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল তারপরও ইমামের জ্ঞানের আলো এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম উম্মাহর কাছে সূর্যের আলোর মতোই ছড়িয়ে পড়েছিলো ঠিকই।
ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জীবনকাল পঁচিশ বছরের বেশি ছিল না। অথচ ইতিহাসে অন্তত তাঁর ১১০ জন ছাত্রের নাম উল্লেখ করা হয়েছে যাঁরা তাঁরই জীবনাদর্শ ও শিক্ষার আলোকে সুশিক্ষিত হয়েছেন, সমৃদ্ধ হয়েছেন। তাদেঁর মধ্য থেকে বহু মহান মনীষীর নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে যাঁরা তাদেঁর সমকালে ছিলেন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের অন্তর্ভুক্ত, ফিকাহ ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁরা ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। ইমাম জাওয়াদ (আ) জ্ঞানের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেনঃ ‘জ্ঞান অর্জন সবার জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ,জ্ঞান দ্বীনি ভাইদের মাঝে ঘনিষ্ট সম্পর্ক সৃষ্টি করে এবং জ্ঞান হচ্ছে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। জ্ঞান হচ্ছে মজলিসের জন্যে একটি উপযুক্ত তোহফা, ভ্রমণে জ্ঞান হচ্ছে একজন সঙ্গী এবং বিশ্বস্ত বন্ধু এবং নির্জন একাকীত্বে পরম সহচর।' অন্যত্র তিনি বলেছেনঃজ্ঞান ও প্রজ্ঞা হচ্ছে পূর্ণতা প্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। তিনি মানুষের উদ্দেশ্যে উপদেশ দিয়ে বলেছেনঃ ইহকালীন এবং পরকালীন সকল বৈধ সকল চাহিদা মেটানোর জন্যে জ্ঞানের বাতিকে কাজে লাগাও।
ইমাম জাওয়াদ (আ) বলেছেনঃ ‘চারটি বস্তু মানুষকে পূণ্য ও কল্যাণমূলক কাজগুলো আঞ্জাম দিতে সহযোগিতা করে। এই চারটি জিনিস হলোঃ সুস্থতা, সক্ষমতা বা সম্পদ, জ্ঞান এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া তৌফিক।' অনেকে দুনিয়াবী জীবনকে তুচ্ছ বলে মনে করেন। অথচ মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দুনিয়াবী কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের শক্তিমত্তা, মানুষের চিন্তা-চেতনা-মেধা ইত্যঅদির বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই দুনিয়াতেই। মানুষের যে পরিচয়-চাই তা ভালোই হোক অথবা মন্দ-পার্থিব এই পৃথিবীতেই তার প্রাপ্তিযোগ ঘটে।এদিক থেকে পার্থিব এই পৃথিবীর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।পৃথিবীটা হলো পূণ্য ও কল্যাণ লাভের ক্ষেত্র। যারা কল্যাণের পেছনে ছুটবে তাদের জন্যে পৃথিবী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার এই পৃথিবীই অনেকের জন্যে ধ্বংসের লীলাভূমি। ইমাম জাওয়াদ (আ ) এ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ ‘দুনিয়া হচ্ছে একটি বাজারের মতো,অনেকই এখানে লাভবান হয়,মুনাফা অর্জন করে,আবার অনেকে এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'
দুনিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলাম। ইমাম জাওয়াদ (আ) দুনিয়াকে পূণ্য অর্জনের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। কিন্তু কখনোই দুনিয়ামুখী ছিলেন না। ইতিহাসে এসেছে তিনি তাঁর অর্জিত সম্পদ বহুবার মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই তাঁর উপাধি হয়েছিলো জাওয়াদ। জাওয়াদ শব্দের অর্থ হচ্ছে বেশি বেশি দানশীল। ইমাম জাওয়াদ এক ব্ক্তৃতায় বলেছেনঃ ‘আল্লাহর এমন কিছু বান্দা আছে যাদেরকে তিনি প্রচুর নিয়ামত দান করেছেন যাতে তাঁরা সেসব নিয়ামত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পথে দান করতে পারে। কিন্তু তারা যদি তা থেকে বিরত থাকে অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় দান না করে তাহলে আল্লাহ তাঁর নিয়ামত ফিরিয়ে নেন।' এ কারণে কারো হাতে সম্পদ বা নিয়ামত দেওয়াটা তার জন্যে এক ধরনের পরীক্ষাস্বরূপ। কেননা সম্পদের অধিকারী যারা তাদেরকে ভাবতে হবে যে এসব নিয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে দান করা হয়েছে।তাই এগুলোকে মানব সেবায় ব্যয় করতে হবে। ইমাম জাওয়াদ (আ) বলেছেনঃ ‘আল্লাহর নিয়ামত কারো ওপর বৃদ্ধি করা হয় না, যদি না তার কাছে মানুষের চাহিদা বা প্রত্যাশা বেড়ে যায়। তাই যারা এই কষ্টটুকু করে না অর্থাৎ অন্যদেরকে দান করে না,তাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামত প্রদানে ভাটা পড়ে।'
মালেকি ফের্কার বিশিষ্ট ফকীহ ইবনে সাব্বাগ ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জীবন-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখেছেনঃ কী বলবো! সবার চেয়ে কম বয়স অথচ তাঁর মান-মর্যাদা ছিলো সবার উপরে। তিনি তাঁর খুব অল্প সময়ের জীবনকালে অনেক বেশি কেরামতি দেখিয়েছেন। তাঁর জ্ঞান, তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত বহু মূল্যবান অবদান এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি শত্রু পক্ষের বক্তব্যকে অত্যন্ত যুক্তিমত্তার সাথে অথচ ঠাণ্ডা মাথায়, মিষ্টি ভাষায় খণ্ডন করে নিজস্ব বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সে সময়কার যতো তর্কবাগিশ আর আলঙ্কারিক ভাষাবিদ ছিলেন সবাইকে তিনি হার মানিয়েছেন। অথচ তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী। তবে যা বলতেন তা ছিল অকাট্য। তিনি বলেছেনঃ কম কথা বলা মানুষের দোষ-ত্রুটিগুলোকে ঢেকে রাখে, কম কথা মানুষকে বিচ্যুতি থেকে ফিরিয়ে রাখে। মানুষ তার জিহ্বার নিচে লুকিয়ে থাকে।
ইমাম জাওয়াদ (আ) এর আরেকটি মূল্যবান বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আলোচনার। তিনি বলেছেনঃ ‘যে-ই আল্লাহর ওপর ভরসা করবে সে প্রকৃত প্রাচুর্যের অধিকারী। আর যে তাকওয়াবান,মানুষ তাকে অন্তর থেকে ভালোবাসে।'
ইমাম হাদি (আঃ)এর শাহাদাৎ বার্ষিকী
সমস্যা সংকুল এই পৃথিবীতে মানব জাতিকে যারা সঠিক পথের দিশা দিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে ইমামগণ অন্যতম। আহলে বাইতের ইমামগণ ছিলেন আল্লাহ মনোনীত, তারা প্রত্যেকেই পরিপূর্ণতম মানুষ। তাদেঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণ, তাদেঁর মন-মানসিকতা, পবিত্র জীবনাদর্শ ও উন্নত মানবিক সত্ত্বাই তা প্রমাণ করে। ইমাম হাদি (আঃ)ও ছিলেন এমনই এক মহান ব্যক্তিত্ব। এই মহান মনীষীর শাহাদাৎবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ আমরা তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।
আহলে বাইতের অন্যান্য ইমামের মতো হাদি (আঃ)ও ছিলেন রহমতের খনি, জ্ঞানের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার এবং হেদায়েত ও পরহেজগারীর মূল কাঠামো। তিনি সব সময় হাসিখুশী থাকতেন। প্রশান্ত চিত্তের অধিকারী ইমাম হাদি (আঃ) এর চাল-চলন ও আচার-আচরণ সবাইকে মুগ্ধ করতো। তিনি খুব সাধারণতবে পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করতেন। ইমামের পোশাক ও জায়নামাজ দেখলেই বোঝা যেত যুগের সর্বোত্তম এই ব্যক্তি কতটা সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ইবনে শাহ্র অশুব, ইমাম হাদি (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন, হযরত হাদি ছিলেন একজন পরিপূর্ণতম মানুষ। তিনি যে নবী পরিবারের সন্তান সেই ঐশ্বর্য তাঁর চেহারায় জ্বলজ্বলে ছিল, কেননা তিনি ছিলেন রেসালাতের বৃক্ষেরই ফল এবং নবীজীর খান্দানেরই মনোনীত।
পৃথিবীর অনেক ঘটনাকে আপাত দৃষ্টিতে অকল্যাণকর বলে মনে হলেও তা যে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে, সে কথা ইমামের বক্তব্যে সব সময় স্পষ্ট ছিলো।
একদিন খুব জটলার মধ্যে আহত এক ব্যক্তির জামা হঠাৎ পাশের একটা শক্ত স্থানে আটকে গিয়ে ছিড়ে গেলো। লোকটির মন-মেজাজ এমনিতে খারাপ ছিলো, জামা ছিড়ে যাওয়ায় তিনি আরও মনোক্ষুন্ন হলেন। তাই তিনি বলে উঠলেন, "আজ দিনটাই খারাপ"। পাশেই ইমাম হাদি(আঃ) ছিলেন। তিনি ঐ ব্যক্তির মন্তব্য শুনে নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? ঐ ব্যক্তি ইমামের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। ইমাম সব শুনে বললেন, আল্লাহতায়ালা কোন দিনকেই খারাপ করে সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ মানুষকে তার কৃতকর্মের ভিত্তিতে পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত করবেন। ইমামের কথা শুনে ঐ ব্যক্তি তার ভুল বুঝতে পারলো। সে উপলব্ধি করলো, যা ঘটছে তা হয়তো এমন কোন কারণে ঘটানো হচ্ছে, যা চূড়ান্ত কল্যাণ নিশ্চিত করবে।
ইমাম হাদি (আঃ) এর জীবনকালে মুতাওয়াক্কিলসহ আব্বাসীয় খলিফাদের বেশ কয়েকজনের শাসনকাল অতিবাহিত হয়েছে। চিন্তা ও রাজনৈতিক দিক থেকে সেই সময়টা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল। সমাজে শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। শাসক গোষ্ঠী ইমাম হাদি (আঃ)এর অস্তিত্বকে মেনে নিতে পাচ্ছিল না। একবার স্বৈরাচারী আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের একজন ঘনিষ্ট সহচর ইমাম হাদি (আঃ)এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করলো। খলিফার কাছে আরও বেশি প্রিয় হবার বাসনায় ঐ ব্যক্তি বললো, ইমাম হাদি তার বাসায় অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে এবং তিনি খলিফা মুতাওয়াক্কিলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। খলিফা নিরাপত্তা বাহিনীকে ইমামের বাড়ী-ঘর তল্লাশির নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা ইমামের বাড়ীতে অস্ত্র খুজে না পেয়ে ইমামকে ধরে নিয়ে গেলো। অবশ্য অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মুতাওয়াক্কিল ইমামকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের যেনতেন অজুহাতে ইমামকে হয়রানি করা হয়েছে, কষ্ট দেয়া হয়েছে।
এসব কারণে আব্বাসীয় শাসনের যুগ যতোই অতিক্রান্ত হচ্ছিল ততোই শাসকদের সম্মান ও মর্যাদা হ্রাস পাচ্ছিল। তাদের মর্যাদা হ্রাস পাবার পেছনে কারণ ছিল-সমাজে তাদের দুর্নীতি এবং তাদের শাসক হবার যোগ্যতাহীনতার ব্যাপারে জনতার মুখে মুখে রব ওঠা-যার ফলে মানুষ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল।
অন্যদিকে,নতুন নতুন চিন্তাধারা আর বিকৃত বিশ্বাসের প্রচলনের কারণে মানুষের চিন্তারাজ্যে এবং বোধ ও বিশ্বাসে ভয়াবহ বিকৃতি জেঁকে বসেছিল। ইমাম হাদি (আঃ) যদি এই দুঃসময়ে ইসলামের উন্নত নীতি-নৈতিকতার চর্চা ও বিকাশ না ঘটাতেন,তাহলে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও নীতিমালাগুলো বিচ্যুতিতে ডুবে যেত। ইমাম হাদি (আঃ) শুরুতে মদীনায় বসবাস করতেন। মদীনা ছিল মুসলিম বিশ্বের জন্যে ইসলামী বিধি-বিধান এবং জ্ঞানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। আর ইমাম জ্ঞানের এই কেন্দ্রটি পরিচালনা বা এর নেতৃত্বের দায়িত্বে ছিলেন।
মুতাওয়াক্কিলের শাসনামলে ইমাম হাদি (আঃ) বাধ্য হয়েছিলেন মদীনা ছেড়ে সামেরায় বসবাস করতে। কেননা মুতাওয়াক্কিল জনগণের মাঝে ইমাম হাদি (আঃ) এর প্রভাব প্রতিপত্তিকে ভয় করতো। তাই সে চাইতো ইমামকে জনগণের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে। এ কারণেই ইমামকে সে সামেরায় অর্থাৎ মুতাওয়াক্কিলের হুকুমাতের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। সামেরা শহরেও ইমাম হাদি (আঃ)কে লোকজন স্বাগত জানায় এবং মুতাওয়াক্কিল শত চেষ্টা চালিয়েও ইমামের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা হ্রাস করতে পারেনি। ইমামের জনপ্রিয়তা হ্রাসের জন্য মুতাওয়াক্কিল নানা কৌশল ব্যবহার করেছ। একদিন মুতাওয়াক্কিলের নির্দেশে ইমাম হাদি (আঃ) কে এমন একটা মজলিসে আনা হলো যেখানে অনেক ধনীলোক এবং রাজদরবারের লোকজন উপস্থিত ছিল। মুতাওয়াক্কিল ইমাম হাদি (আঃ) কে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে বললো। ইমাম প্রথমে এ কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু মুতাওয়াক্কিল ব্যাপক পীড়াপীড়ি করে। অবশেষে ইমাম মজলিসের অবস্থা এবং সেখানে উপস্থিত লোকজনের বিষয়টি বিবেচনা করে অত্যাচারী শাসকদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতনতামূলক একটি কবিতা পড়েন। মানুষ সে যত বড় শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারীই হোক না কেন,তাকে যে মৃত্যুর কাছে পরাজয় মেনে নিতেই হবে, সে কথা ইমাম কবিতার ছন্দে উপস্থিত সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। কাজেই ইমামের অর্থবহ ও শক্তিশালী বক্তব্য মজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয় এমনকি স্বয়ং স্বৈরাচারী শাসক মুতাওয়াক্কিলও ইমামের কবিতার বক্তব্যে আন্দোলিত হয়। অন্য একদিন মুতাওয়াক্কিল এক বিতর্কের আয়োজন করে। ইমামের সাথে বিতর্কের জন্য সে যুগের দুই বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তি ইয়াহিয়া বিন আকসাম ও ইবনে সেক্কিতকে আমন্ত্রন জানানো হয়। ইয়াহিয়া বিন আকসাম প্রথমেই ইমামকে রাসূলদের মোজাজের ভিন্নতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন। ইয়াহিয়া আকসাম বলেন, রাসুলদের মোজেজাগুলোর মধ্যে পার্থক্যের কারণ কি? মূসা (আঃ)র মোজেজা কেন লাঠি, ঈসা (আঃ)র মোজেজা কেন মানুষকে রোগমুক্ত বা পুনরুর্জ্জীবিত করা, আর কেনবাই হযরত মোহাম্মদ (আঃ)র মোজেজা ছিলো কোরান?
ইমাম হাদি (আঃ) উত্তরে বললেন, মূসা (আঃ)র মোজেজা ছিলো লাঠি কারণ সে যুগের সমাজে জাদুর প্রভাব ছিলো সবচেয়ে বেশি। কাজেই মূসা (আঃ) তার লাঠি দিয়ে অন্য সকল জাদুকরের জাদুকে অস্তিত্বহীন করে দিয়ে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। ঈসা(আঃ)এর মোজেজা ছিল বিশেষ রোগে আক্রান্ত রোগীদের রোগমুক্ত করা বা মৃত ব্যক্তিকে পুণরায় জীবীত করা,কারণ সে সময় চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল,তা সে যুগের মানুষকে বিস্মিত করেছিল। সে কারণে ঈসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে মৃত মানুষকে জীবীত করে এবং দূরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে তুলে মানুষকে আল্লাহর ক্ষমতার কিয়দাংশ প্রদর্শন করেছেন। আর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)র সময় কবিতা ও সাহিত্য মানুষের চিন্তা-চেতনায় প্রাধান্য বিস্তার করেছিল সে কারণে তিনি তার মোজেজা পবিত্র কোরানের মাধ্যমে তাদের চিন্তা-চেতনার উপর প্রভাব বিস্তার করেন এবং নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারু ভাবে পালন করেন। ইমামের এই উত্তর শুনে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়। এরপর ইবনে সেক্কিত ইমামকে প্রশ্ন করেন। ইমাম ধৈর্য্যের সাথে সেসব প্রশ্নেরও উত্তর দেন এবং ঐ বিতর্কে বিজয় লাভ করেন। ইমামের উপস্থিতিতে এ ধরনের প্রতিটি বিতর্কই পরিণত হতো মানুষের জন্য মুল্যবান শিক্ষার আসর। কাজেই ইমামের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই আরও বাড়তে থাকে। ফলে আরও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে আব্বাসীয়রা। এরই এক পর্যায়ে আব্বাসীয় খলিফার নির্দেশে ইমামকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। ইমামের শাহাদাতের খবরে গোটা মুসলিম বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে। ইমাম হাদি (আঃ)এর জানাজা নামাজে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ অংশ নিয়েছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। ইরাকের সামেরায় অবস্থিত ইমাম হাদি (আঃ)এর মাজারে আজও প্রতিদিনই মানুষের ঢল নামে। মুসলমানরা মাজারে গিয়ে আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করে, অনুপ্রাণিত হয় রাসূল ও তার আহলে বাইতের পথ অনুসরণ করতে। আমরা সবাই ইমাম হাদি(আঃ)এর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে সফল হবো-এই প্রত্যাশা রইল।
ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আঃ) এর জন্মবার্ষিকী
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ)এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের ৫৭ বছর পর বরকতময় রজব মাসের প্রথম দিন ধরনী আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বনবীর পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আঃ)। ইসলামের ইতিহাসে সেটি ছিলো এক সোনালী মুহুর্ত। তিনি ছিলেন ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর সন্তান এবং সবাই তাঁকে বাকের বলেই চিনতো। ইমাম জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে তাকে বাকের বা প্রস্ফুটনকারী বলে অভিহিত করা হতো । জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিলো এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের অনেক জটিল রহস্য তিনি উন্মোচন করেছেন।
সে সময়ের বিখ্যাত পণ্ডিতরা ইমাম বাকের (আঃ) এর সমূদ্রসম জ্ঞানের কাছে ছিলেন বিন্দুসম পানির মতো । তৎকালীন পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত আব্দুল্লাহ বিন আতা মাক্কী এ সম্পর্কে বলেছেন, ইমাম বাকের (আঃ) এর সাথে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় বিখ্যাত মনিষীদের যেভাবে অসহায় দেখেছি, অন্য কারো সাথে আলোচনায় সেরকমটি হতে দেখি নি। বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হাকাম বিন উতাইবাহকে দেখেছি ইমামের পাশে এমনভাবে বসে থাকতে যেমনটি একজন ছাত্র তার শিক্ষকের পাশে বসে থাকে। এই মহান ইমামের শুভ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর বরকতময় জীবন থেকে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
ইমাম হোসেন (আঃ) পুত্র ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর শাহাদাতের পর তাঁর সন্তান ইমাম বাকের (আঃ) ১৯ বছর মুসলিম বিশ্বের অতি স্পর্শকাতর সময়ে উম্মাহর নেতৃত্ব ও ইমামতের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এই সময়টিতে মুসলিম বিশ্বে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হয় এবং আব্বাসিয়োরা উমাইয়াদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ইমাম এ সময় পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞান ও ইসলামী সংস্কৃতি প্রসারের কাজ করেন। তিনি মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানগত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন, যার ফল পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহ পেতে শুরু করে। তিনি ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠির ইসলাম বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং খাঁটি মোহাম্মাদি ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রসারের কাজে হাত দেন।
বিশিষ্ট মুসলিম মনিষী শেখ তুসি ইমাম বাকের (আঃ) এর ছাত্র সংখ্যা ৪৬২ জন বলে উল্লেখ করেছেন। তৎকালীন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা জ্ঞানের দীক্ষা নেয়ার জন্য ইমামের সমীপে উপস্থিত হতেন। এক্ষেত্রে জাবির বিন ইয়াজিদ, জুহরি, আবু হানিফা, আনাস বিন মালিক এবং শাফিঈ'র নাম উল্লেখ করা যায়, যারা ইমামের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে শিক্ষালাভ করেছেন। মোহাম্মাদ বিন তালহা শাফিঈ ইমাম বাকের (আঃ) সম্পর্কে লিখেছেন : "তিনি ছিলেন জ্ঞানের প্রস্ফুটনকারী। তিনি সংক্ষেপে অর্থবহ কথা বলতেন এবং তাঁর মনের জানালা ছিলো উন্মুক্ত। কাজে কর্মে তিনি ছিলেন পবিত্র মানুষ। মহান চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি। আল্লাহর আদেশ পালনই ছিলো তার ব্রত। তিনি ছিলেন আল্লাহর নিকটতম ব্যক্তিদের অন্যতম এবং মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা তাঁর ছিলো।
ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আঃ) এর ইমামত এমন সময় শুরু হয় যখন ইসলামের বিভিন্ন ফেরকা'র মধ্যে ফিকাহ ও বিশ্বাসগত মতপার্থক্য গভীর আকার ধারণ করেছিলো। এই পরিস্থিতিতে তিনি বিশ্বনবীর আহলে বাইতের নির্দেশিত ইসলামের সঠিক পথ মুসলিম উম্মাহর সামনে তুলে ধরেন। তাঁর অল্প সময়ের প্রচেষ্টায় ভ্রান্ত মতাদর্শের অধিকারী ফেরকাগুলো দুর্বল হতে থাকে এবং মানুষ সঠিক ইসলামের দিকে ফিরে আসে। অন্যদিকে উমাইয়া ও আব্বাসিয়োদের মধ্যে ক্ষমতার দলাদলিতে সে সময় মুসলিম বিশ্বে এক অস্থির রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিরাজ করছিলো। ঘন ঘন খলিফা পরিবর্তিত হচ্ছিলো। ইমামের ১৯ বছরের ইমামতকালে ৫ জন খলিফা পরিবর্তিত হন। এই অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ইমাম ছাত্র তৈরির দিকে মনোনিবেশ এবং ইসলামের স্বরূপ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আঃ) এর যুগে উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর আকিদা বা বিশ্বাসগত ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিলো। এ কারণে অনেক মুসলমান প্রকৃত ইসলামের সন্ধানে পথে পথে ঘুরছিলো। ইমাম তাদের সামনে পথের দিশা তুলে ধরলেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন ইসলাম হিসেবে যা তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, তার কতখানি সঠিক এবং কতখানি ভ্রান্ত ধারণা। ফলে উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি ইসলামকে পথভ্রষ্ট করলেও ইমাম বাকের (আঃ) এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইসলাম নতুনভাবে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়।
সাধারণ মানুষের সাথে ইমাম ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন। অতি সাধারণ মানুষ, যাদেরকে সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো, ইমাম তাদের সাথে বসে খাবার খেতেন এবং তাদের সমস্যার সমাধান করতেন। তাঁর এই মধুর ও অমায়িক ব্যবহারের কারণে সবাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। কোন সাহায্যপ্রার্থী ইমামের কাছ থেকে রিক্ত হস্তে ফিরে যেত না এবং এ ধরনের মানুষের সাথে সম্মানজনক আচরণ করার জন্য তিনি তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিতেন। ইমামের সদালাপী ও সহাস্য আচরণের কারণে তার বিরোধিরাও তাঁর ভক্ত হয়ে উঠতো। ইতিহাসে এসেছে, শাম বা সিরিয়ার অধিবাসী এক ব্যক্তি আকিদাগত দিক থেকে ইমামের বিরোধী হলেও সব সময় তাঁর কাছে থাকতেন।
জ্ঞানগত ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনেও ইমাম বাকের (আঃ) তৎপর ছিলেন। অত্যাচারী রাজাবাদশাহদের অন্যায় কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করতেন তিনি। শাসকগোষ্ঠির অত্যাচারে জনগণ যখন অতিষ্ট, তখন ইমাম তাদের সামনে ন্যায়পন্থী শাসকের উদাহরণ তুলে ধরতেন। ফলে জনগণ উপলব্ধি করতো, তারা কতখানি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ইমাম বাকের (আঃ) বলেছেন : যে ব্যক্তির অন্তরে জ্বলজ্বলে ও সাদা কোন অংশ নেই, সে মুমিন নয়। যখন ব্যক্তি কোন পাপ কাজ করে তখন ঐ সাদা অংশের ওপর কালো একটি ছাপ পড়ে। যদি সে তওবা করে আল্লাহর কাছে অনুশোচনা করে তবে সেই কালো ছাপ মুছে যায়। আর যদি সে তওবা না করে পাপ কাজ অব্যাহত রাখে, তবে কালো ছাপ গভীর থেকে গভীরতর হয়। একসময় তার অন্তরে আর কোন সাদা জায়গা থাকে না, পুরোপুরি কালো হয়ে যায়। এ ধরনের অন্তরের অধিকারীরা কখনো সুপথ পায় না।
পাঠক, ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আঃ) সম্পর্কে তার যুগের এক ব্যক্তির মন্তব্য উল্লেখ করে এই মহান ইমামের জন্মবার্ষিকীর আলোচনা শেষ করবো। জনৈক আসাদ বিন কাসির বলেছেন : আমি একবার আমার দরিদ্র অবস্থা এবং আমার ওপর ভাইদের অত্যাচারের ব্যাপারে ইমামের কাছে নালিশ করলাম। তিনি বললেন : "যে ভাই সামর্থবান ও সম্পদশালী অপর ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে, কিন্তু ঐ ভাই দরিদ্র হয়ে গেলে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ও তার ওপর অত্যাচার চালায় সে অত্যন্ত খারাপ মানুষ।" এরপর তিনি আমাকে ৭০০ দেরহাম দান করার নির্দেশ দিলেন যাতে আমি সেই অর্থ দিয়ে আমার দারিদ্র্য দূর করতে পারি। এরপর ইমাম আমাকে বললেন : "তুমি স্বচ্ছল হতে পারলে কিনা তা আমাকে জানিও"।
যে আলো কখনও নেভে না
(নবী নন্দিনী হযরত ফাতিমা (সাঃ)'র শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিশেষ আলোচনা)
شهادت حضرت فاطمه زهراء (ع)
হযরত ফাতিমা যাহরা (সাঃ) ছিলেন এমন এক মহামানবী যার তুলনা কেবল তিনি নিজেই। অতুলনীয় এই নারী কেবল নারী জাতিরই শ্রেষ্ঠ আদর্শ নন, একইসাথে তিনি গোটা মানব জাতিরই শীর্ষস্থানীয় আদর্শ। তাই যে আলো তিনি বিশ্বে ছড়িয়েছেন তা কখনও নির্বাপিত হবে না, বরং সমস্ত সুন্দর গুণাবলীর এই অনন্য উৎস থেকে পবিত্র আলোক-রশ্মি দিনকে দিন প্রজ্জ্বোলতর হচ্ছে। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই নারীর শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক শোক ও সমবেদনা।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত ফাতিমা (সাঃ) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সাঃ)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সাঃ)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সাঃ)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট।
এখন প্রশ্ন হল, এমন অসাধারণ ও উচ্চতর মর্যাদা কিভাবে অর্জন করেছেন হযরত ফাতিমা (সাঃ)? এটা কি কেবল এ জন্যে যে তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র কন্যা? এমন প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন স্বয়ং বিশ্বনবী (সাঃ)। ফাতিমা যদি নবী-নন্দিনী নাও হতেন তাহলেও নিজ যোগ্যতার কারণেই তিনি এমন শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হতেন বলে মহানবী (সাঃ) উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ খোদাভীরু, দানশীলা, কর্তব্য-সচেতন, ন্যায়-নিষ্ঠ এবং জ্ঞানী। সর্বোপরি ইসলামের জন্য অসাধারণ ত্যাগ-তিতিক্ষাও তাঁকে পরিপূর্ণ আদর্শ মানব ও শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। সিদ্দিকা বা সত্যবাদী, তাহিরা বা পবিত্র, রাজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, মুবারাকাহ বা জ্ঞান, কল্যাণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বরকতময় প্রভৃতি ছিল হযরত ফাতিমা (সাঃ)'র কিছু উপাধি। রাসূল (সাঃ)'র প্রতি তিনি এত যত্নবান ছিলেন যে তাঁকে বলা হত উম্মু আবিহা বা পিতার মাতৃতুল্য।
এ ছাড়াও হযরত ফাতিমা সিদ্দিকা (সাঃ) ছিলেন একজন আদর্শ জননী, একজন আদর্শ স্ত্রী এবং একজন আদর্শ কন্যা। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক যুগে যখন নারীর জন্মকে আরবরা কলংক বলে মনে করতো। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও নারীরা ছিল অবহেলিত ও উপেক্ষিত এবং এমনকি মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বনবী (সাঃ)'র কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় মক্কার মুশরিক আরবরা তাঁকে নির্বংশ বা আবতার বলে উপহাস করত। কিন্তু মহান আল্লাহ এসব উপহাসের জবাব দিয়েছেন সূরা কাওসারে। এ সূরায় হযরত ফাতিমা (সাঃ)কে কাওসার বা প্রাচুর্য্য বলে উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ এবং কাফেররাই নির্বংশ হবে বলে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। হযরত ফাতিমা (সাঃ)'র মাধ্যমে নবীবংশ বা আহলে বাইত (আঃ)'র পবিত্র ধারা রক্ষিত হয়েছে।
নারী যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে সে দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন হযরত ফাতিমা (সাঃ)। তিনি ইমামত বা বেলায়েতের দায়িত্বপ্রাপ্ত না হলেও হযরত আলী (আঃ) ছাড়া আহলে বাইত (আঃ'র অন্য ১১ জন সদস্য বা পবিত্র ইমামের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শিক পূর্বসূরী। বিশ্বনবী (সাঃ)'র ওফাতের পরও তিনি মুসলমানদেরকে পথ-নির্দেশনা দান অব্যাহত রেখেছিলেন। পবিত্র কোরআন ও রাসূল (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইত (আঃ)কে অনুসরণ করার জন্য বিশ্বনবীর তাগিদ সত্ত্বেও পিতার ওফাতের পর সৃষ্ট জটিল ও অনাকাঙ্ষিনুত পরিস্থিতি দেখতে পেয়ে তিনি পিতার উম্মতকে পথ নির্দেশনা দেয়ার জন্য বলেছিলেন, তোমরা কেন বিপথে যাচ্ছ? অথচ তোমাদের মধ্যে কোরআন রয়েছে। কোরআনের বক্তব্য ও বিধি-বিধান সুস্পষ্ট। এ মহাগ্রন্থের দেখানো পথ-নির্দেশনাগুলো স্পষ্ট এবং সতর্কবাণীগুলোও স্পষ্ট।
হযরত ফাতিমা (সাঃ) নিজ জীবনে পবিত্র কোরআনের শিক্ষাগুলো বাস্তবায়নে অগ্রণীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। তাঁর মাত্র প্রায় ১৮ বছরের জীবন এ ধরনের অনেক বরকতময় ঘটনায় ভরপুর। যেমন, আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ)'র সাথে তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এক দরিদ্র মহিলা তাঁর কাছে পোশাক চাইলে তিনি তার বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য কেনা নতুন জামাটি উপহার দেন। তিনি ইচ্ছে করলে তার পুরনো জামাও দিতে পারতেন। কিন্তু নবীনন্দিনী এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের কথা স্মরণ করেন, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনো কিছু দান করার ক্ষেত্রে ও তা কবুল হবার জন্য সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি দান করার কথা বলা হয়েছে। অনেক সময় দেখা গেছে ঘরে খাদ্যের অভাব থাকা সত্ত্বেও স্বামী যাতে বিব্রত না হন, বা গুরুত্বপূর্ণ অন্য কাজে বাধাগ্রস্ত না হন সে জন্য তিনি সে অভাবের কথা তাঁকে জানান নি। এবাদতের পর মুনাজাতের সময় তিনি নিজ ও নিজ পরিবারের জন্য নয় বরং পাড়া-পড়শী ও পিতার উম্মতের জন্য দোয়াকে প্রাধান্য দিতেন। হযরত ফাতিমা (সাঃ) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একটানা তিন দিন নিজের ও নিজ পরিবারের খাবার দরিদ্রদের দান করে শুধু পানি দিয়ে ইফতার করেছিলেন।
আজকাল মুসলিম বিশ্বের অনেকেই নারীমুক্তির কথা বলেন এবং পশ্চিমা নারীদের অনুসরণকেই তারা নারীর মুক্তি ও প্রগতির পথ বলে মনে করছেন। কিন্তু নারীর প্রকৃত মুক্তির পথ যে নবীনন্দিনী (সাঃ) বহু আগেই মানবজাতিকে দেখিয়ে গেছেন তা তারা হয় জানেন না, বা জানার চেষ্টাও করেন না। পারিবারিক অশান্তির জন্য তারা শরণাপন্ন হচ্ছেন মনোবিজ্ঞানীদের। কিন্তু তারা যদি নিজ জীবনে হযরত ফাতিমা (সাঃ)'র আদর্শ অনুসরণের চেষ্টা করতেন এবং তার সাদা-সিধে ও অনাড়ম্বর জীবন থেকে শিক্ষা নিতেন তাহলে আজকের যুগে তালাক প্রবণতা বৃদ্ধিসহ যেসব জটিল পারিবারিক সমস্যা দেখা যায় সেগুলোর সমাধান সহজ হয়ে যেত।
মুসলিম বিশ্ব ও উম্মাহ হযরত ফাতিমা (সাঃ)-কে হারিয়েছিল অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় বা অত্যন্ত দূর্দিনে। তাঁর শাহাদত এবং জীবনের রেখে যাওয়া শিক্ষাগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবো ও তাঁকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে মুসলিম মা-বোনদেরকে ভালো মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবো-এটাই হোক এই অশেষ শোকের দিনে আমাদের প্রধান প্রার্থনা ও সংকল্প।
আয়াতুল্লাহ শহীদ মোতাহারী (রহঃ)
একই ব্যক্তির মধ্যে বহুমুখী প্রতিভা, সততা ও ধার্মিকতা, যুগের চিন্তাগত এবং আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণের যোগ্যতা খুব কমই দেখা যায়। যুগান্তকারী ইসলামী চিন্তাবিদ আয়াতুল্লাহ শহীদ মূর্তাজা মোতাহারী (রহঃ) ছিলেন এমনই একজন মহান আলেম এবং বিরল প্রতিভাসম্পন্ন মুসলিম চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। উদ্ভাবনী ধারার আলেম, চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং গভীর অথচ সৃজনশীল বিশ্লেষক ও আধুনিক গবেষকদের জন্য তাকে পূর্ণাঙ্গ আদর্শ বলা যেতে পারে। অধ্যাপক মোতাহারী ছিলেন অসাধারণ মনীষাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ, ধার্মিক বা খোদাভীরু হাকিম বা বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, আল্লাহপ্রেমিক আরেফ এবং উঁচু পর্যায়ের দার্শনিক। তার লেখনীতেই এইসব মহান গুণ স্পষ্ট। আসলে আয়াতুল্লাহ শহীদ মূর্তাজা মোতাহারী (রহঃ)' লেখনী ও বক্তৃতায় ঝরে পড়তো জ্ঞান, প্রজ্ঞা, খোদাপ্রেম ও ধর্মের প্রতি গভীর আন্তরিকতা বা মমত্ববোধ এবং নির্ভরযোগ্য, আকর্ষণীয় ও বিচিত্র তথ্যের অমূল্য মণি-মুক্তারাশি। তিনি নিজেই বলেছিলেন যে ইসলামী বিষয়গুলোর প্রতি তার গভীর আকর্ষণ ও মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়েছিল ১৩ বছর বয়সে।
মানুষের মুক্তি বা সৌভাগ্য লাভের উপায় এবং ধর্মকে সঠিকভাবে চেনার প্রতি আল্লামা মোতাহারী (রহঃ)'র ব্যাপক গুরুত্ব তার লেখনী থেকেই স্পষ্ট। ইসলাম যে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত জীবন বা প্রকৃত প্রাণ সঞ্চার করে তা তিনি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ও যুক্তিসহ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনের সূরা আনফালের ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আহ্বানে সাড়া দাও, যখন সে তোমাদের নবজীবনের দিকে আহ্বান করে... ... ।
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, মানুষের প্রকৃত জীবন তথা সৌভাগ্য রয়েছে ইসলামকে জীবনের সবক্ষেত্রে বাস্তবায়নের মধ্যে। ইসলাম যে সৌভাগ্যের পথ দেখায় সেটাই স্থায়ী সৌভাগ্য। এ জন্যই আয়াতুল্লাহ শহীদ মূর্তাজা মোতাহারী (রহঃ) বলেছেন, ইসলামের সূর্য কখনও অস্তমিত হবে না। তার মতে, সৌভাগ্য ও প্রকৃত জীবনকে পেতে হলে মানুষের চিন্তা ও কাজে ইসলামকে বাস্তবায়িত করতে হবে। আল্লামা মোতাহারী (রহঃ)'র শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এ সংক্রান্ত তার বক্তৃতার কিছু অংশের অনুবাদ আমরা এখানে তুলে ধরছিঃ
সামাজিক বিষয়গুলো অব্যাহত রাখার জন্য মানুষের ইচ্ছেগুলো বাস্তবায়িত হওয়া জরুরী। মানুষের ইচ্ছে বা চাহিদাগুলো দু ধরনেরহঃ প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক। যেমন, গবেষণা ও জ্ঞান অন্বেষণ মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা। চা ও ধুমপান একটি অস্বাভাবিক অভ্যাস এবং ইচ্ছে করলে মানুষ এ ধরনের অভ্যাস বা চাহিদা ত্যাগ করতে পারে। চিন্তাবিদ ও গবেষকরা মনে করেন, কেবল প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বিষয়গুলোই টিকে থাকে। তাই ইসলাম বা যে কোনো ধর্মকে টিকে থাকতে হলে এ ব্যাপারে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বা চাহিদা থাকতে হবে, অথবা মানুষের চাহিদাগুলো পুরণের যোগ্যতা বা ক্ষমতা থাকতে হবে ধর্মের মধ্যে। ধর্ম যদি এ ব্যাপারে ব্যর্থ হয় তাহলে মানুষ এ ব্যাপারে বিকল্প কোনো আদর্শ বা ব্যবস্থাকে বেছে নেবে। মানুষের অগ্রগতির পথে পরিস্থিতি বা পরিবেশ বদলে গেলে এ কারণে অনেক কিছুই বদলে যায়। যেমন, বিদ্যুৎ আবিষ্কৃত হওয়ায় মানুষ মোমবাতি ও চেরাগ আর ব্যবহার করছে না। কিন্তু কোনো কোনো বিষয় কখনও পরিবর্তিত হয় না। ধর্ম হল এমনই এক বিষয়। কারণ, ধর্ম মানুষের এমন এক প্রকৃতিগত চাহিদা যে অন্য কোনো কিছুই এর স্থলাভিষিক্ত বা বিকল্প হতে পারে না। পবিত্র কোরআনের সূরা রূমে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তুমি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ধর্মের প্রতি মনোনিবেশ কর বা ইসলাম ধর্মের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত কর। এটা হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতি এবং তিনি মানুষকে এই প্রকৃতি দিয়েই সৃষ্টি করেছেন।
আয়াতুল্লাহ শহীদ মূর্তাজা মোতাহারী (রহঃ) একই প্রসঙ্গে আরো বলেছেন, মানুষের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন ভয় ও অজ্ঞতার কারণেই ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে। কারো কারে মতে ন্যায়বিচার ও শৃংখলার প্রতি আগ্রহই এর কারণ। অনেকে বলতেন, বিজ্ঞানের আরো উন্নতি ঘটতে থাকলে ধর্ম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির পরও ধর্ম বিলুপ্ত হয় নি। বরং ধর্মের ভূমিকা ও অবদান এখনও অব্যাহত রয়েছে এবং মানুষ বুঝতে পেরেছে যে ধর্ম বিলুপ্ত হবার মত বিষয় নয়। পশ্চিমা মনোবিজ্ঞানী ইয়ং ধর্মকে মানুষের জন্মগত বা সহজাত প্রকৃতির অংশ বলে অভিহিত করেছেন এবং মানুষ নিজের অজান্তেই ধর্মমুখী। "ধর্ম ও মন" শীর্ষক বইয়ে মার্কিন মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস বলেছেন, "আমাদের অনেক ইচ্ছা বা চাহিদা অবস্তুগত এবং ধর্মের মধ্যে রয়েছে নম্রতা, ভালবাসা, আন্তরিকতা, দয়া, ত্যাগ প্রভৃতি অবস্তুগত বিষয়। ধর্মীয়-মনোবৃত্তিগুলোর সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনা হয় না।"
ফরাসী লেখক ও চিকিৎসক এ্যালেক্সিস কার্ল প্রার্থনা বা এবাদত শীর্ষক বইয়ে মানুষের বিবেকের কথা উল্লেখ করেছেন যা মানুষকে নিজের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয় এবং মানুষকে ভুল-পথ ও সংকীর্ণ চিন্তা থেকে দূরে রাখে।
আল্লামা শহীদ মোতাহারী (রহঃ)'র মতে মানুষ ব্যক্তিগত ও সামাজিক দিক থেকে ধর্মের মুখাপেক্ষী। রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয়কে যখন প্রশ্ন করা হয় ঈমান বা বিশ্বাস কি? তখন তিনি বলেছেন, বিশ্বাস হচ্ছে তা যা নিয়ে মানুষ জীবন যাপন করে এবং ঈমানই মানুষের জীবনের পুঁজি।
মানুষ তার কল্পনায় অসীমত্ব বা স্থায়ীত্ব নিয়ে ভাবে। মানুষ নিজেকে ও নিজের নামকে চিরস্থায়ী করতে চায়। যুদ্ধ ও অপরাধযজ্ঞগুলোর পেছনেও এ চিন্তা সক্রিয়। ধর্মই মানুষের অনুভূতিতে ভারসাম্য আনতে পারে এবং তাকে সঠিক পথ দেখাতে পারে। ভিক্টর হুগোর মতে,মানুষ যদি মনে করে যে এ জীবনের পর আর কোনো জীবন নেই, তাহলে জীবন তার কাছে অর্থহীন মনে হবে। ধর্ম মানুষকে এ অর্থহীনতা থেকে মুক্তি দেয়, তার দৃষ্টিকে করে প্রসারিত ও কাজে-কর্মে দেয় আনন্দ।
আয়াতুল্লাহ শহীদ মূর্তাজা মোতাহারী (রহঃ)'র মতে, ধর্মই আইন ও নৈতিকতার পৃষ্ঠপোষক। ধর্মবিহীন নৈতিকতার কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই বলে তিনি মনে করতেন। ন্যায়বিচার, সাম্য বা সমতা, মানবতা, সহমর্মিতা- এসবের ভিত্তি যদি ধর্ম না হয় তাহলে তা বাস্তবায়িত হবে না বলে আল্লামা শহীদ মোতাহারী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন। এ্যালেক্সিস কার্লও এ বাস্তবতা স্বীকার করে বলেছেন, "বর্তমানে মানুষের মগজ বা বুদ্ধি অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার মন বা অন্তর দূর্বল হয়ে পড়েছে। একমাত্র ঈমানই অন্তরকে শক্তিশালী করে।"
উইল ডুরান্ট বলেছেন, ধর্মের রয়েছে শত প্রাণ। অন্য যে কোনো বিষয় একবার মরে গেলে তা চিরতরে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু ধর্ম শত বার মারা গেলেও আবারও জীবন্ত হয়। এ কারণেই আল্লামা শহীদ মোতাহারী (রহঃ) বলেছেন, ধর্মের সূর্য কখনও নির্বাপিত হবে না। তার মতে, ধর্মের নামে কূসংস্কার ও অযৌক্তিক বিষয় চালু হলে ধর্মের অবনতি ঘটতে পারে। কিন্তু, পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী মানুষ ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারলে তারা দলে দলে এতে দীক্ষিত হবে।
ইমাম হাদি (আ:) এর জন্মবার্ষিকী
ইমামগণ হলেন এমন মহান ব্যক্তিত্ব যাঁরা আল্লাহর মনোনীত।তাদেঁর কথাবার্তা,আচার-আচরণ,তাদেঁর মন-মানসিকতা,তাদেঁর পবিত্র জীবনাদর্শ ও উন্নত মানবিক সত্ত্বাই তা প্রমাণ করে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের উন্নত নীতি-আদর্শবান ব্যক্তিত্বদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং তাদেঁর জীবনাদর্শের অনুসরণ করা সততা ও কল্যাণময় উন্নত জীবন লাভের একমাত্র পথ। এমনই এক মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম হাদি (আ) এর শুভ জন্মদিন উপলক্ষ্যে আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক প্রীতি,শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
ইমাম হাদি (আ) ছিলেন একজন গভীর জ্ঞানসম্পন্ন এবং পূর্ণতা ও তাকওয়ার অধিকারী মহান এক ব্যক্তিত্ব। ইমামদের সম্পর্কে ইমাম হাদি (আ) বলেছেনঃতাঁরা হলেন রহমতের খনি,জ্ঞানের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার এবং হেদায়েত ও পরহেজগারীর মূল কাঠামো। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ইবনে শাহ্র অশুব ইমাম হাদি (আ) এর জ্ঞান ও আল্লাহর সাথে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে বলেছেনঃ হযরত হাদি ছিলেন একজন পরিপূর্ণতম মানুষ।যখনই তিনি চুপচাপ থাকতেন খুবই মর্যাদাবান মনে হতো,আবার যখন কথা বলতেন তাঁর সেই মর্যাদা আরো বেড়ে যেত। তিনি যে নবী পরিবারের সন্তান সেই ঐশ্বর্য তাঁর চেহারায় জ্বলজ্বলে ছিল,কেননা তিনি ছিলেন রেসালাতের বৃক্ষেরই ফল এবং নবীজীর খান্দানেরই মনোনীত।
ইমাম হাদি (আ) ২১২ হিজরীর মধ্য জ্বিলহাজ্বে অর্থাৎ জ্বিলহাজ্ব মাসের ১৫ তারিখে মদীনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ইমাম জাওয়াদ (আ) এর শাহাদাতের পর তিনি মুসলমানদের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তেত্রিশ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ইমাম হাদি (আ) এর জীবনকালে মুতাওয়াক্কিলসহ আব্বাসীয় খলিফাদের বেশ কয়েকজনের শাসনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। চিন্তা ও রাজনৈতিক দিক থেকে এই মেয়াদকাল ভিন্ন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছিল। আব্বাসীয় শাসনের যুগ যতোই অতিক্রান্ত হচ্ছিল ততোই তাদের সম্মান ও মর্যাদা হ্রাস পাচ্ছিল। তাদের মর্যাদা হ্রাস পাবার পেছনে কারণ ছিল-সমাজে তাদের দুর্নীতি এবং তাদের শাসক হবার যোগ্যতাহীনতার ব্যাপারে জনতার মুখে মুখে রব ওঠা-যার ফলে মানুষ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল।
অন্যদিকে,নতুন নতুন চিন্তাধারা আর বিকৃত বিশ্বাসের প্রচলনের কারণে মানুষের চিন্তারাজ্যে এবং বোধ ও বিশ্বাসে ভয়াবহ বিকৃতি জেঁকে বসেছিল। ইমাম হাদি (আ) যদি এই দুঃসময়ে ইসলামের উন্নত নীতি-নৈতিকতার চর্চা ও বিকাশ না ঘটাতেন,তাহলে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও নীতিমালাগুলো বিদায়াত আর বিচ্যুতিতে ডুবে যেত। ইমাম হাদি (আ) শুরুতে মদীনায় বসবাস করতেন। মদীনা ছিল মুসলিম বিশ্বের জন্যে ইসলামী বিধি-বিধান এবং জ্ঞানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। আর ইমাম জ্ঞানের এই কেন্দ্রটি পরিচালনা বা এর নেতৃত্বের দায়িত্বে ছিলেন। মুতাওয়াক্কিলের শাসনামলে ইমাম হাদি (আ) বাধ্য হয়েছিলেন মদীনা ছেড়ে সামেরায় বসবাস করতে। কেননা মুতাওয়াক্কিল জনগণের মাঝে ইমাম হাদি (আ) এর প্রভাব প্রতিপত্তিকে ভয় করতো। তাই সে চাইতো ইমামকে জনগণের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে। এ কারণেই ইমামকে সে সামেরায় অর্থাৎ মুতাওয়াক্কিলের হুকুমাতের কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
ইমাম হাদি (আ) যেহেতু আব্বাসীয় সেনাদের কড়া নজরদারিতে ছিলেন, সে কারণে জনগণের সাথে তাঁর সম্পর্ক রাখার পদ্ধতিটি ছিল একটু আলাদা। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর প্রতিনিধি নির্বাচন করেছিলেন এবং প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিনিধিদের কাজ ছিল জনগণের কাছে ইমামের বক্তব্য,চিন্তাদর্শ,বিধিবিধান ও দৃষ্টিভঙ্গিগুলো পৌঁছানো এবং ইমামকেও জনগণের মূল সমস্যাদি সম্পর্কে অবহিত করা। অবশ্য রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ইমামের প্রতিনিধিগণ খুব সহজে ইমামের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারতেন না। তাঁরা তাই বিভিন্ন রকম বেশে যেমন লেবাস পরিবর্তন করে কিংবা বিক্রেতার বেশে ইমামের কাছে আসতে বাধ্য হতেন।
সামেরা শহরেও ইমাম হাদি (আ)কে লোকজন স্বাগত জানায় এবং মুতাওয়াক্কিল চেষ্টা করে জনগণের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা কমানোর। একদিন মুতাওয়াক্কিলের নির্দেশে ইমাম হাদি (আ) কে এমন একটা মজলিসে আনা হলো যেখানে অনেক ধনীলোক এবং রাজদরবারের লোকজন উপস্থিত ছিল। মুতাওয়াক্কিল ইমাম হাদি (আ) কে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে বললো। ইমাম প্রথমে এ কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু মুতাওয়াক্কিল ব্যাপক পীড়াপীড়ি করে। অবশেষে ইমাম মজলিসের অবস্থা এবং সেখানে উপস্থিত লোকজনের বিষয়টি বিবেচনা করে অত্যাচারী শাসকদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতনতামূলক একটি কবিতা পড়েন। তাঁর পঠিত কবিতাটির অর্থ ছিল এ রকম :
উঁচু উঁচু চূড়া নিজের বাসস্থানের জন্যে নির্বাচন করা হলো, সশস্ত্র ব্যক্তিদেরকে সেই বাসস্থান পাহারা দেওয়ার জন্যে মোতায়েন করা হলো এবং নিরাপত্তার সকল সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হলো। তবু কোনো কিছুই মৃত্যু ঠেকাতে পারলো না। নিজের বাসস্থানটিকে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচানোর জন্যে কতো দীর্ঘ সময়ই না ব্যয় করা হলো, তবু আজ্রাইলের ডাকে সাড়া দিয়ে সেইসব অট্টালিকাকে বিদায় বলতে হলো। সু-উচ্চ চূড়ায় তাদের সেইসব অট্টালিকা কালের পরিক্রমায় মাটির টিলায় পরিনত হলো।
ইমামের অর্থবহ ও শক্তিশালী বক্তব্য মজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয় এমনকি স্বয়ং স্বৈরাচারী শাসক মুতাওয়াক্কিলও ইমামের কবিতার বক্তব্যে আন্দোলিত হয়।
হালাল রুটি-রুযির ব্যাপারে ইমাম ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের বাইরে সম্পদের পার্থিব চাকচিক্যের প্রতি মোটেও আকৃষ্ট ছিলেন না তিনি,বরং সমাজের অসহায়-গরীবদের সাহায্যে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ইমাম হাদি (আ) এর অর্থনৈতিক সাহায্য সমাজ থেকে দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। জনগণ তাঁর কাছ থেকে সাহায্য প্রাপ্তির ব্যাপারে ছিল আশাবাদী এবং বলা যায় তাঁর বাসা ছিল অসহায় দরিদ্রদের একরকম আশ্রয় শিবির। ইমাম ছিলেন ধৈর্য-সহিষ্ণুতা ও ঔদার্যের ক্ষেত্রে অনন্য এক দৃষ্টান্ত।যে লোকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইমামকে সামেরায় যেতে হয়েছিল,ইমাম তাকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ইমামের একটি বাণী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শেষ করবো আজকের আলোচনা। তিনি বলেছেনঃ 'আল্লাহ সৌন্দর্যপ্রিয়,তিনি মুমিনদের বিশৃঙ্খলা পছন্দ করেন না। তিনি তাঁর বান্দাদের মাঝে তাঁর নিয়ামতের প্রভাব বা প্রতিফলন দেখতে ভালোবাসেন। কিন্তু বান্দা কী করে তা প্রকাশ করবে? এ রকম প্রশ্নের জবাবে ইমাম বলেনঃনিজের জামা-কাপড় পরিষ্কার রাখবে,সুগন্ধি ব্যবহার করবে এবং নিজের ঘরটাকে পরিচ্ছন্ন রাখবে।' #
ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ) এর শাহাদাৎ বার্ষিকী
নবীজীর আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ) এর বেদনা বিধুর শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আপনাদের প্রতি রইলো আন্তরিক শোক ও সমবেদনা। ইমাম বাকের (আ) এর সমৃদ্ধ জীবনাদর্শ নিয়ে খানিকটা আলোচনা করে এবং সেসব আদর্শকে নিজেদের জীবনে কাজে লাগিয়ে আমরাও আমাদের জীবনকে যথাসম্ভব সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করবো-এই প্রত্যাশা রইলো।
যেদিন ইমাম বাকের (আ) এর শাহাদাতের খবর মদীনা শহরে ছড়িয়ে পড়লো সেদিন আহলে বাইতের অনুরাগীদের অন্তর শোকে-দুঃখে ভীষণ কাতর হয়ে পড়েছিল। কারণ হলো তারা আর নবীজীর আহলে বাইতের ঐ নূরানী ও সদয় চেহারাটি আর দেখবে না,মসজিদে আর তাঁর হৃদয়গ্রাহী উষ্ণ বক্তব্য শুনতে পাবে না-এই চিন্তায় তাদের মন ভেঙ্গে গেল। ইমামের অস্তিত্বহীনতা তাঁর ঘনিষ্ট সহচরদের জন্যে ছিল খুবই কষ্টের ব্যাপার। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন জাবের ইবনে ইয়াযিদ জোফি। দুঃখের মুহূর্তগুলো যেন তার কাটছিল না। তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠছিল ইমামের প্রিয় সান্নিধ্যের বহু অমর স্মৃতি। জাবের প্রথমবারের মতো যখন ইমামকে মসজিদে দেখেছিলেন তখন বহু কৌতূহলী মানুষ ইমামের চারদিকে বৃত্তাকারে বসে ছিলেন। সবাই তাঁর যুক্তিপূর্ণ ও প্রজ্ঞাময় কথা শুনছিলো। প্রথম যেই উপদেশটি তিনি ইমামের কাছ থেকে শুনেছিলেন সেটা তিনি কখনোই ভোলেন নি,সবসময় তা তার স্মরণে ছিল।
ইমামের ঐ উপদেশ তাকে সবসময় জ্ঞান-অন্বেষী করে রেখেছিল। ইমাম বাকের (আ) বলেছিলেনঃ 'জ্ঞান অন্বেষণ করো! কেননা জ্ঞান অন্বেষণ করা পূণ্যের কাজ। জ্ঞান তোমাকে অন্ধকারে পথ দেখাবে, দুঃসময়ে জ্ঞান তোমাকে সাহায্য করবে। জ্ঞান হলো মানুষের সবচেয়ে উত্তম বন্ধু।' এই উপদেশ পাবার কারণে জাবের ইমাম বাকের (আ) এর যুক্তি বাহাসের জলসায় এবং যে-কোনো জ্ঞানের আসরে উপস্থিত থাকতেন। ইমামের প্রজ্ঞাময় বক্তৃতা থেকে ভীষণ উপকৃত হতেন। জাবের তাই ইমামকে হারাবার ব্যথায় বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। ইমামের স্মৃতিময় সান্নিধ্যের কথা মনে করে কাঁদতে লাগলেন আর আনমনে ইমামের সেই বাণীটি আওড়ালেনঃ 'হে জাবের!যার অস্তিত্বে বা সত্ত্বায় আল্লাহর স্মরণের মাহাত্ম্য বিদ্যমান রয়েছে তার অন্তরে আর অন্য কোনো কিছুর প্রতি ভালোবাসা জাগবে না। খোদাকে যারা অন্বেষন করে,যারা তাকেঁ পেতে চায় তারা দুনিয়া পুজারী হয় না,পার্থিব জগতের মোহ তাদের মাঝে থাকে না। তাই চেষ্টা করো আল্লাহ তাঁর হেকমাত ও দ্বীনের যা কিছু তোমার কাছে আমানত রেখেছেন তা রক্ষণাবেক্ষণ করো!'
জাবেরও ইমামের জন্যে শোকাভিভুত জনতার কাতারে গিয়ে শামিল হলো। একদল লোক ইমামের পবিত্র লাশ কাধেঁ করে নিয়ে মদীনা শহরের বাকি কবরস্থানে নিয়ে গেল এবং তাকেঁ সেখানে দাফন করলো। এই দিনটিই সেইদিন অর্থাৎ ১১৪ হিজরীর জ্বিলহাজ্জ্ব মাসের ৭ তারিখ। যেখানেই সত্য,ন্যায় ও বাস্তবতার নিদর্শন দেখা যাবে সেখানেই আহলে বাইতের নাম জ্বলজ্বল করবে। কেননা তাঁরা ছিলেন নীতিনৈতিকতার বিচারে সবোর্চ্চ পর্যায়ের। তাঁরা সবসময় অঙ্গনে এসেছেন সত্য-কল্যঅন ও মানবীয় পূর্ণতায় পৌঁছার পথ দেখাতে। মানুষের মাঝে তাদেঁর অস্তিত্বই ছিল সূর্যের মতো উজ্জ্বল পথ প্রদর্শকের মতো।
ইমাম বাকের (আ) এর ইমামতির মেয়াদকাল ছিল ১৯ বছর। হিজরী ৯৫ সালে তাঁর এই মেয়াদকালের সূচনা হয়। এই সময়টাতে ইসলামী সমাজ উমাইয়া শাসকদের শেষ দিককার এবং আব্বাসীয় শাসনের শুরুর দিককার সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিল। এই মেয়াদকালে বহু কিতাব এবং দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ অনূদিত হয়েছিল। সেইসাথে কালের এই ক্রান্তিলগ্নে সমাজে বহুরকম বিকৃত ফের্কার বিস্তার ঘটেছিল। মানুষ তাই বিকৃত চিন্তার বেড়াজালে আটকে পড়ার সুযোগ ছিল খুব সহজেই। ইমাম বাকের (আ) এবং তাঁর সন্তান ইমাম সাদেক (আ) ইতিহাসের সেই ক্রান্তিলগ্নে দ্বীনের যথার্থ স্বরূপ প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মাঝে প্রকৃত ইসলামকে তুলে ধরার জোর প্রচেষ্টা চালান। তাদেঁর এই প্রচেষ্টা ছিল বেশ প্রভাব বিস্তারকারী। বিশেষ করে তাঁরা মদীনায় একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
জ্ঞানপিপাসু ও আধ্যাত্মিকতার আলো প্রত্যাশীরা দলে দলে তাই মদীনায় যেতে শুরু করেন। এভাবে দ্বীনের ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটে। এ কারণেই তাকেঁ বাকেরুল উলুম নামে অভিহিত করা হয়। যার অর্থ হলো পণ্ডিত বা জ্ঞানের বিশ্লেষক। ইমাম বাকের (আ) তাঁর সময়ে ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ রক্ষার সীমান্তপ্রহরী ছিলেন। ইসলামের বিশ্বদৃষ্টি ও নৈতিকতার বিকাশে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিকৃত আকিদা ও চিন্তাচেতনার বিচার-বিশ্লেষণ করা এবং ইসলামের বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলোর দৃঢ়তা ও মজবুতির ক্ষেত্রে ইমাম বাকের (আ) মূল্যবান অবদান রেখেছিলেন।
একটি সমাজের ভবিষ্যৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই যেসব শাসক অত্যাচারী এবং কেবল নিজেদের স্বার্থচিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং মানবীয় কোনো নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন নয় তারা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করে। ইমাম বাকের (আ) এর ইমামতি কালটি ছিল তেমনি এক শাসকগোষ্ঠির শাসনকাল। ইমাম তাই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরেন এবং একজন সৎ নেতৃত্বের গুণাবলি জনগণের সামনে তুলে ধরেন। এভাবে অত্যাচারী খলিফাদের কাজকর্ম জনগণের সমালোচনার মুখে পড়ে।সে কারণে আব্বাসীয় শাসক বিশেষ করে হিশাম বিন আব্দুল মালেকের ব্যাপক চাপের মুখে ছিলেন ইমাম।
ইমাম বাকের (আ) সঠিক নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পর্কে বলেনঃ নিঃসন্দেহে যাদের মাঝে তিনটি গুণের সমাবেশ নেই তারা নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নয়। ঐ তিনটি গুণ হলো-এ্যাকঃ আল্লাহকে ভয় করা এবং খোদার নাফরমানী থেকে নিরাপদ থাকা, দুইঃ সহিষ্ণুতা ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকা এবং তিনঃ অধীনস্থদের ব্যাপারে পিতৃসুলভ সদয় হওয়া এবং তাদের সাথে সদাচরণ করা।
ইমাম বাকের (আ) ছিলেন পরোপকারী ও অসহায়-বঞ্চিত জনগোষ্ঠির প্রতি সদয়। তিনি নিঃস্ব-হতদরিদ্রদের সাথে মিশতেন। তাদের সাথে কথা বলে তাদের ক্লান্ত আত্মাকে প্রশান্ত করতেন। তিনি সবাইকে বলতেন বঞ্চিতদেরকে যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ডাকা না হয়। তাঁর জ্ঞান আর মিষ্টি আচার-আচরণের কারণে জনগণ তাঁর কথায় ব্যাপক আকৃষ্ট হত। বহু ছাত্র তিনি তৈরি করে গেছেন। তাঁর থেকে বর্ণিত অসংখ্য হাদিস এখনো মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজে লাগছে। হিশাম বিন আব্দুল মালেক ইমামের এই প্রভাব সঞ্য করতে পারলো না। সে ছিল অর্থলোভি এক পাথর-হৃদয়। সে তার অধীনস্থদের আদেশ দেয় বিভিন্নভাবে ইমামকে যেন চাপের মুখে রাখা হয়। কিন্তু কোনোরকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করে ইমামকে তাঁর দায়িত্ব পালন থেকে দূরে রাখতে পারে নি। ইমামের বিরুদ্ধে তাই হিশামের অন্তরে ক্ষোভের আগুণ আরো বহুগুণ বেড়ে গেল।
অবশেষে হিশাম ইমামের নূরানী অস্তিত্বকেই বিলীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করলো। সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে ইমাম বাকের (আ) কে বিষপ্রয়োগে শহীদ করা হয়। তাঁর শাহাদাতের সেই শোকাবহ স্মৃতিময় দিনটিই হলো ৭ ই জ্বিলহাজ্জ্ব।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন