লাইলাতুল বরাত ফযিলতপূর্ণ হওয়ার কারণ
লাইলাতুল বরাত ফযিলতপূর্ণ হওয়ার কারণ
শবে বরাত যে ফযিলত সম্পন্ন, তা প্রমাণিত করার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে ভাবগাম্ভির্যসহ গভীর দৃষ্টি রাখার অনুরোধ রাখছি, যথা:
নবী(সা.)-এর কোন এক স্ত্রী ১৫ শা’বানের রাতে তাঁর অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: সে রাতে নবী(সা.) আমার কাছে ছিলেন। হঠাৎ তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করে তাঁর খোঁজে বের হলাম, খোঁজাখুজির পরে তাকে অনুরূপ কাপড়ের স্তুপাকৃত হয়ে সিজদারত অবস্থায় জমিনে পড়ে থাকতে দেখলাম এবং সিজদায় তাকে এরূপ বলতে শুনলাম:
اصبحت اليك فقيرا خائفا مستجيرا فلا تبدل اسمى ولاتغير جسمى ولاتجهد بلائى واغفرلى
অর্থ: “ভীত সন্ত্রস্ত, শুন্য হাতে তোমার পানে এসেছি আশ্রয় নিতে। সুতরাং আমার নামকে ফিরিয়ে দিও না এবং আমার শরীরের পরিবর্তন ঘটিও না, আমার কষ্টকে বৃদ্ধি করো না এবং আমার উপর থেকে তোমার আযাব পরিহার কর”।
তারপর সিজদাহ্ থেকে মাথা তুললেন এবং পুনরায় সিজদায় গিয়ে এরূপ বললেন:
سجد لك سوادى و خيالى و امن بك فوادى هذه يداى بما جنيت على نفسى يا عظيم ترجى لكل عظيم اغفرلى ذنبى العظيم فانه لايغفرالعظيم الاالعظيم
অর্থ: “আমার সমস্ত অস্তিত্ব তোমার জন্য সিজদারত এবং আমার অন্তর তোমার প্রতি ঈমান এনেছে; আর নিজের উপর স্বীয় দু’হাতে যত অন্যায় করেছি, সুতরাং হে মহান সমস্ত বড় কাজই আঞ্জাম দেয়ার জন্য আশা-আকাঙ্খাসমূহ তোমার প্রতিই ধাবিত; তাই আমার সকল বড় গোনাহ্ থেকে তোমার আযাব পরিহার করে নাও। কেননা শুধুমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তায় পারেন বড় গোনাহ থেকে পরিত্রাণ দিতে”।
উক্ত বাক্যসমূহ উচ্চারণের পর তিনি মাথা উঠালেন এবং পুনরায় সিজদায় গিয়ে এরূপ বললেন:
اعوذ برضاك من سخطك و اعوذ بمعافاتك من عقوبتك و اعوذ بك منك انت كما اثنيت على نفسك و فوق ما يقول القائلون
অর্থ: “তোমার আযাব থেকে তোমার সন্তুষ্টির প্রতি আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তোমার সাজার থেকে তোমার ক্ষমার প্রতি আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তোমার নিকট থেকে তোমার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তুমি তাই যা তুমি নিজে বর্ণনা দিয়েছো এবং তুমি তার থেকেও অধিক উপরে যা অন্যরা বলে থাকে”।
কিছু সময় পর তিনি সিজদাহ থেকে মাথা উঠালেন এবং পূনরায় সিজদায় গিয়ে এরূপ বললেন:
اللهم انى اعوذ بنور وجهك الذى اشرقت له السموات والارض و قشعت به الظلمات و صلح به امرالاولين والاخرين ان يحل على غضبك او ينزل على سخطك اعوذبك من زوال نعمتك و فجاة نقمتك و تحويل عافيتك و جميع سخطك لك العتبى فيما استطعت و لاحول ولا قوة الا بك
অর্থ: হে আল্লাহ্ তোমার নূরেই তো আসমান ও যমিন আলোকিত হয়েছে, অন্ধকারসমূহ ওই নূরের ছটায় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে এবং পূর্ব ও পরগণ ওই নূরের ছটাতেই সংশোধিত হয়েছে সেই নূরের তলার আশ্রয় চাইছি,তোমার দেয়া আযাব এবং তোমার শত্রু তা আমার উপর পতিত হবার আগেই। আশ্রয় চাইছি তোমার কাছে তোমার নেয়ামত হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে, তোমার হটাৎ আযাব প্রদান থেকে, তোমার পক্ষ হতে বালা নাযিল হওয়া থেকে এবং যা কিছু তোমাকে রাগান্বিত করে তা থেকে। আমার যা কিছু তোমাকে সন্তুষ্ট করে তা তো তোমারই দেয়া। কেননা এমন কোন শক্তিই নেই যার কারণ তুমিনও।
নবী(সা.)-এর এরূপ অবস্থা দেখে তাকে রেখেই তড়িৎ গতিতে বাড়ীর দিকে রওনা হলাম। হাপাতে হাপাতে বাড়ীতে এসে পৌছালাম। যখন তিনি বাড়ী ফিরে আসলেন তখন আমাকে দেখে তিনি বললেন: কি হয়েছে, হাপাচ্ছো কেন? বললাম: আমি আপনার খোঁজে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন: তুমি কি জান যে এ রাত কোন রাত?! এ রাত হচ্ছে ১৫ইশা’বানের রাত। এ রাতে সমস্ত আমল লিপিবদ্ধ হবে, রুযিসমূহ বন্টন হবে, মৃত্যুর সময়নির্ধারণ হবে। আর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা সকলকে ক্ষমা করে দিবেন। তবে যারাশির্ক করবে অথবা জুয়া খেলায় মত্ত থাকবে অথবা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে অথবা মদ্যপায়ী হবে অথবা গোনাহ্ করার জন্য পীড়াপীড়ি করবে তারা ব্যতীত ...। (ইবনে তাউউস, আলীবিন মুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.- ২১৬-২১৭, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুলআয়া’লামি লিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী)
ইমাম আলী (আ.)-এর একজন বিশিষ্ট সাহাবা কুমাইল বিন যিয়াদ, ইমামের উদ্ধৃতি দিয়ে এভাবে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেন: একদা বাসরার মসজিদে আমার মাওলার নিকট বসে ছিলাম এবং সেখানে তাঁর একদল সাথীও উপস্থিত ছিল। আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন ইমাম(আ.)-কে প্রশ্ন করল: আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতা’য়ালার এ فيها يفرق كل امر حكيم -ওই রাতে প্রতিটিনির্দেশই হিকমতের সাথে নির্দিষ্ট ও নির্বাচিত হবে- সূরা: দুখান, আয়াত নং-৪) উক্তিরঅর্থ কি?
ইমাম বললেন: “তাঁর কসম, যার হাতে আলীর জীবন! মধ্য শা’বান থেকে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত সকল ভাল-মন্দ দিক যা বান্দার উপর জারি হয় তা এই রাতে নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। এমন কোন বান্দা নেই যে, এ রাতে জাগ্রত থেকে খাযার নামক দোয়া পাঠ করবে তার দোয়া অবশ্যই কবুল হবে”।
এরপর ইমাম আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি রাতে তাঁর বাড়ীতে গেলাম। ইমাম আমাকে বললেন: কি হয়েছে কুমাইল? বললাম: হে আমিরূল মু’মিনিন দোয়ায়ে খাযার শিক্ষা নেয়ার জন্য এসেছি,যদি আমাকে শিক্ষা দেন। তিনি বললেন: বস হে কুমাইল! যখন এ দোয়াটি আমার থেকে শিক্ষা নিবে এবং মুখস্ত করবে, আল্লাহর শপথ প্রতি জুময়া’র রাতে অথবা প্রতি মাসে একবার অথবা বছরে একবার অথবা অন্ততপক্ষে সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় একবার তা পড়বে, যাতে করে আল্লাহ্সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার সাহায্য তোমার উপর বর্তায় এবং তোমাকে রুযি ও ক্ষমা দানকরুন। হে কুমাইল! যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে তুমি আমাদের সাথে রয়েছো তাই আমাদের দায়িত্বহচ্ছে তোমার বৈধ চাওয়া পূরণ করা। তখন তিনি আমাকে উক্ত দোয়াটি শিক্ষা দেন...।
উল্লিখিত দোয়াটি হচ্ছে সেইদোয়া যা বর্তমানে দোয়ায়ে কুমাইল নামে আমাদের মাঝে পরিচিত। (ইবনে তাউউস, আলীবিন মুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.- ২২০, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুলআয়া’লামি লিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী।)
ইমাম আলী(আ.) অন্য একটি রেওয়ায়েতে ১৫ ই শা’বানের ফযিলত সম্পর্কে এরূপ বর্ণনা করেন: “আমি আশ্চর্য হয়ে যাই যখন দেখি কোন ব্যক্তি চারটি রাত বেহুদা কাটায়: ১- ঈদুল ফিতরের রাত, ২- ঈদুল আযহার রাত, ৩- ১৫ই শা’বানের রাত ও ৪-রজব মাসের প্রথম রাত। (আল্ মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকির, বিহরুল আনওয়ার, খণ্ড-৯৪, পৃ.-৮৭, হা.-১২, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক:মুয়াস্সিসাতুল ওয়াফা, ১৪০৩ হিজরী।)
ইমাম সাদিক(আ.) বলেছেন যে, তাঁর সম্মানীয় পিতার কাছে কেউ একজন ১৫ ই শা’বনের ফযিলত জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেন: “এ রাত লাইলাতুল ক্বদরের পরে সব থেকে উত্তম রাত। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা এ রাতের ফযিলতকে তাঁর বান্দাদের উপর জারি করবেন এবং এ রাতের উছিলায় তাদের গোনাহসমূহকে ক্ষমা করে দিবেন। সুতরাং চেষ্টা কর যাতে করে এ রাতে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালার নিকটবর্তী হতে। এ রাত হচ্ছে সেই রাত যে রাতের ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতা’য়ালা স্বীয় অস্তিত্বের উপর কসম করে বলেছেন যে, এ রাতের আবেদনকারীকে, যদি তার আবেদন অবৈধ না হয় তবে তাকে নিজের দরগাহ্ থেকে দুরে সরাবেন না। এ রাত এমন রাত, যে রাতকে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন, যেমনভাবে শবে ক্বদরের রাতকে আমাদের নবী(সা.)-এর জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। সুতরাং রাতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার উদ্দেশ্যে হামদ ও ছানা পাঠ করবে, কেননা যারাই এ রাতে একশ’বার আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিনের তসবিহ্ পড়বে, একশ’বার তাঁর হামদ করবে, একশ’বার তাঁর তকবির পড়বে এবং একশ’বার তাঁর একক সত্তার যিকির(لاالهالاالله)পাঠ করবে, তিনি তাদের সকল অতীত গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের সকল চাওয়াকে পূরণ করে দিবেন। এমনই যে, তারা যে আবেদন সমূহ করছে এবং যে আবেদনসমূহ করি নি সেগুলোকেও। কেননা তিনি স্বীয় জ্ঞানে সব কিছুর ব্যাপারে জ্ঞাত ...। (ইবনে তাউউস, আলীবিন মুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.- ২০৯, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুলআয়া’লামি লিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী। আল্ মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকির, বিহরুল আনওয়ার, খণ্ড-৯৪,পৃ.-৮৫, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল ওয়াফা, ১৪০৩ হিজরী। আস্সাদুক, মুহাম্মদ বিন আলি ইবনুল হুসাইন, খণ্ড-২, পৃ.-৪২৪, হা.-১।)
এরূপ বহু হাদীস রয়েছে যা ১৫ই শা’বানের ফযিলত সম্পর্কিত। তবে এ ক্ষুদ্র পরিষরে তার সব গুলোই উল্লেখ করা সম্ভবনয়, তাই বিশেষ বিশেষ হাদীসগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরা হল এবং উল্লেখিত হাদীসসমূহ সব দিক থেকেই সন্দেহ মুক্ত। কেননা, রিজাল শাস্ত্র মতে উল্লেখকারী রাবীগণ হচ্ছেন ‘সেকাহ্’ অর্থাৎ সত্যবাদী যা নির্দিধায় তাদের বর্ণিত হাদীসসমূহ গ্রহণযোগ্য।
তবে উল্লেখিত রেওয়ায়েতসমূহ পাঠ করে হয়তো আমাদের মনে এ প্রশ্ন আসতে পারে যে, অন্যান্য অনেক হাদীসে মৃত্যুর সময় নির্ধারণ ও রুযি বন্টন রমযান মাসের শবে ক্বাদরের রাতে সংঘটিত হবে বলা হয়েছে, কিন্তু উপরে উল্লেখিত দু’টি হাদীসে ১৫ ই শা’বানে তা সংঘটিত হবে বলা হচ্ছে, এ দু’অবস্থাকে কিভাবে একত্রিত করা সম্ভব?
আমাদের বিজ্ঞ ব্যক্তিত্বমরহুম সাইয়্যেদ বিন তাউউস (মৃত: ৬৬৪ হিজরী) এ প্রশ্নের সুন্দর উত্তর দিয়েছেন এবং উক্ত দু’অবস্থাকে একত্রিত করেছেন যা কোন সমস্যার সৃষ্টি করে না। উত্তরটি লক্ষ্য করুন:
১- ‘উল্লিখিত হাদীসদ্বয়েরভাবার্থ এমন হতে পারে যে, মৃত্যুর সময় নির্ধারণ ও রুযি বন্টন যেরূপে বিলুপ্ত ওপ্রমাণীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেরূপে ১৫ই শা’বানে রূপ লাভ করে, কিন্তু সেগুলোরপ্রকৃত নির্ধারণ ও বন্টন শবে ক্বাদরের রাত্রসমূহে হয়ে থাকে।
২- উল্লিখিত হাদীসদ্বয়ের ভাবার্থ এমনও হতে পারে যে, ১৫ই শা’বান লৌহে মাহফুযে মৃত্যুর সময় নির্ধারণ ও রুযি বন্টন হয়ে থাকে, কিন্তু বান্দাদের মধ্যে তা নির্ধারণ ও বন্টন শবে ক্বাদরে হয়ে থাকে।
৩- ‘উল্লিখিত হাদীসদ্বয়ের ভাবার্থ এমনও হতে পারে যে, মৃত্যুর সময় নির্ধারণ ও রুযি বন্টন ১৫ই শা’বান ও শবে ক্বদরে উভয় রাতে সংঘটিত হয়ে থাকে এরূপে; শবে ক্বদরে যা নির্ধারণ ও বন্টন করা হবে ১৫ই শা’বানে তার ওয়াদা দেয়া হয়ে থাকে। অনুরূপ কোন রাজা ১৫ই শা’বানের রাতে কোন প্রজাকে ওয়াদা দিল যে শবে ক্বাদরের রাতে সে তাকে কিছু অর্থ দান করবে। এ দৃষ্টিকোণে উভয় রাতের ব্যাপারে প্রদত্ত হাদীসসমূহ সঠিক এবং একটি অন্যটির অন্তরায় নয় বরং পরিপূরক। শবে বরাতের রাত যে ফযিলত সম্পন্ন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এখন কথা হচ্ছে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা ফযিলত দান করার জন্য ১৫ ই শা’বানের রাতকে কেন বেছে নিলেন! আরো অন্যান্য রাত তো ছিলো। অতএব নিশ্চয়ই আগে থেকেই আল্লাহ্ রাব্বুলআ’লামিন এ রাতকে ফযিলত মণ্ডিত করেছেন এবং পরবর্তিতে তা পাওয়ার জন্য মানুষকে শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে জিব্রাঈল(আ.) মারফত নবী(সা.)-কে ওই রূপে ইবাদত করে দেখাতে ও ওই রাতের স্বরূপ বর্ণনা করতে বলেছেন।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন