তাসুয়া

মুহররমের নয় তারিখে কারবালায় ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনার বার্ষিকী আবারো আমাদের স্মৃতির দরোজায় কড়া নাড়ছে। আরবি ভাষায় এর প্রতিশব্দ হচ্ছে তাসুয়া। তাসুয়া আয়নার মতো আমাদের সামনে আসে আর তাতে প্রতিবিম্বিত হই আমরা সবাই। কী করেছিলেন ইমাম হোসাইন (আ),কী করনীয় আমাদের,আর

তাসুয়া
মুহররমের নয় তারিখে কারবালায় ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনার বার্ষিকী আবারো আমাদের স্মৃতির দরোজায় কড়া নাড়ছে। আরবি ভাষায় এর প্রতিশব্দ হচ্ছে তাসুয়া। তাসুয়া আয়নার মতো আমাদের সামনে আসে আর তাতে প্রতিবিম্বিত হই আমরা সবাই। কী করেছিলেন ইমাম হোসাইন (আ),কী করনীয় আমাদের,আর কী করছি আমরা-এসবের একটা অনুভূতি জাগিয়ে দেয় আমাদের মনে। ইসলামের ইতিহাসে তাই এই দিনটি খুবই তাৎপর্যবহ। আমরা তাই তাসুয়া সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করে ইমাম হোসাইন (আ) এর মহান আত্মত্যাগসমৃদ্ধ বিশেষ আন্দোলনের সাথে নিজেদের যোগসূত্র তৈরীর চেষ্টা করবো-আল্লাহ আমাদের এই প্রচেষ্টা কবুল করুন।

কারবালার ঘটনার একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ইমাম হোসাইন (আ) এর বিশেষ এই বিপ্লব ছিল মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের বিপ্লব,আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের পথে প্রাণবাজি রাখার অকুতোভয় বিপ্লব। এই বিপ্লব তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনা ছিল না বরং এটা ছিল একটা সংস্কৃতিক বিপ্লব যা সর্বদা অম্লান এবং জীবন্ত। যেই সংস্কৃতির উত্থান ঘটেছিল ইসলামের শিক্ষার আলোকে, যেই সংস্কৃতি ইসলামের চিরন্তন মূল্যবোধগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেজন্যে কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনা যুগ যুগ ধরে ঝর্ণাধারার মতো সত্য ও ন্যায়ের তৃষ্ণায় তৃষিতদের পিপাসা নিবারণ করেছে এবং সেইসাথে বহু সত্য ও ন্যায়কামী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে।
ইমাম হোসাইন (আ) এর সঙ্গী-সাথী বা সৈনিকদের ব্যাপারে একটা বিষয় ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে তা হলো ইমামের সাথীরা ইমামকে যথার্থভাবেই চিনতে পেরেছিলেন এবং জেনে-শুনে-বুঝেই তাঁর আন্দোলনে একাত্ম হয়েছিলেন। ইমামকে ভালোবেসে স্বতস্ফূর্তভাবে ইমানী শক্তিতে বলিয়ান হয়েই তাঁর প্রদর্শিত পথে জীবন উৎসর্গ করতে অকুতোভয় ছিলেন। মানুষের মাঝে যে অজ্ঞতা বা মূর্খতা বিরাজ করছিল তা ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জন্যে তরবারীর আঘাতের চেয়েও ছিল বেশি কষ্টকর। সেজন্যে মানুষের চিন্তারাজ্য থেকে অজ্ঞতার পর্দাগুলো সরিয়ে ফেলার জন্যে একটা জেহাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত ছিল। কারবালার ইতিহাসে এসেছেঃ ইমামের সাথীরা অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং সুস্পষ্ট চিন্তার আলোকেই সত্য ও ন্যায়ের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন।
সংঘর্ষ চলাকালে ইমাম হোসাইন (আ) এর সঙ্গী-সাথীগণ প্রথমে প্রাণবন্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ইমাম এবং নবীজীর খান্দানের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন, তারপর যুদ্ধের ময়দানে পা রেখেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে শত্রুরা নবীজীর খান্দানের স্বরূপ ধ্বংস করার জন্যে ব্যাপক অপপ্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল। এ কারণে ইমামের সাথীগণ প্রতিটি মুহূর্তে ইমাম হোসাইন (আ) এর আন্দোলন,তাঁর পদ্ধতি ও আদর্শকে রক্ষায় তৎপর হতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরহেজগারী ছিল ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গীদের আদর্শ। তাদেঁর পবিত্র চিন্তা এবং উন্নত আত্মার কারণে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-অত্যাচারের মোকাবেলায় চুপ করে বসে থাকতে পারেন নি। নিঃসন্দেহে কারবালার যুবকদের প্রশিক্ষিত এবং উন্নত নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী ছিল। এসব গুণের সমাবেশ তাঁদেরকে ইতিহাসের অমর চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (আ) এর সাথীগণ ছিলেন ইমানের সবোর্চ্চ শিখর আরোহী,নৈলে এভাবে প্রাণ বিলানো সহজ ব্যাপার ছিল না।

কারবালার ইতিহাস স্রষ্টাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে-কোনো মূল্যে ইমাম হোসাইন (আ) এর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাগুলোর ব্যাপারে আন্তরিক ও বিশ্বস্ত থাকা। চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তাঁরা ইমামের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে রাজি ছিলেন না। ইমামের সাথীদের মাঝে হযরত আব্বাস (আ) এর স্থান ছিল অনেক উর্ধ্বে। আব্বাস ছিলেন ইমাম আলী (আ) এর সন্তান এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর ভাই। তাঁর মায়ের নাম ছিল উম্মুল বানিন। ইমাম হোসাইন (আ) এর খান্দানের লোকজন বিশেষ করে যুবকদের মাঝে তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং নৈতিক ও চারিত্র্যিক গুণের প্রশংসা ছিল সবার মুখে মুখে। তাঁর চেহারা ছিল চাদেঁর মতো সুন্দর ,সে কারণে তাকেঁ উপাধি দেওয়া হয়েছিল বনি হাশেমের চাঁদ। ইমাম হোসাইন (আ) এর ব্যাপারে ছোটোবেলা থেকেই তাঁর আলাদা একটা টান যেমন ছিল তেমনি ছিল শ্রদ্ধা ও সম্মান।
তিনি সবসময়ই ইমাম হোসাইন (আ) কে শ্রদ্ধা করতেন। কারবালার সংগ্রামে সৈনিকদের অধিনায়কের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পন করা হয়েছিল। ইমাম হোসাইনের যত্ন নেওয়া,নারী ও শিশুদের তাঁবুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা, ইমাম হোসাইনের সন্তানদের জন্যে পানি আনার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয়ে কারবালায় হযরত আব্বাসের অবিস্মরণীয় ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় তাকেঁ মহাকাব্যের বীরের মতো অমর করে রেখেছে। ইয়াযিদের সেনারা ইমাম হোসাইন এবং তাঁর সঙ্গীদেরকে পর্যুদস্ত করার জন্যে পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু ইমামের সন্তানেরা যখন পানির পিপাসায় কাতরাচ্ছিল তখন আব্বাস (আ) নির্ভীকচিত্তে নজিরবিহীন এক কাণ্ড ঘটালেন। তিনি শত্রুপক্ষের অবরোধ ভেঙ্গে দিয়ে ফোরাত নদীতে গিয়ে পৌঁছলেন। নদীতে নেমে আঁজলা ভরে পানি নিলেন খাবার জন্যে।এমন সময় ইমাম হোসাইনের তৃষিত সন্তানের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি আর পানি খেতে পারলেন না।
তিনি মশক বা পানির পাত্র ভর্তি করে হাতে নিয়ে দ্রুত তাঁবুর পথে রওনা হয়ে গেলেন। এমন সময় শত্রুদের একটি তীর তাঁর ঐ হাতে এসে বিধেঁ যায়।আব্বাস পানির পাত্রটি অপর হাতে নিলেন।এবার ঐ হাতটিকেও শত্রুদের তীর এসে কেটে দেয়। তারপরও তিনি যে-কোনো উপায়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন ইমামের তাঁবুর কাছে পানির মশক নিয়ে যেতে।তাই পানির মশকটি মুখে নিলেন। কিন্তু শত্রুদের তীর সেখানেও আঘাত হানে। এভাবে ইমাম হোসাইন (আ) এর সিপাহীদের পতাকাবাহী হযরত আব্বাস (আ) শাহাদাত বরণ করেন।
এভাবে ইমামের সন্তান আলী আকবার,হুর ইবনে ইয়াযিদ রিয়াহি,হাবিব ইবনে মাজাহের,ওহাব,কাসেম ইবনে ইমাম হাসান সবারই বীরত্বপূর্ণ এবং আনুগত্যপূর্ণ কাহিনীতে কারবালার ইতিহাস ভরপুর। এরকম নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গী-সাথীদের উদ্দেশ্যে ইমাম মোনাজাতে বলেছিলেনঃ ''আমি আমার সাথীদের মতো এতো ভালো ও উন্নত আর কোনো সঙ্গী দেখি নি। আমার সাথে সহযোগিতা করার জন্যে আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করুন।  সূত্রঃ ইন্টারনেট ''
 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন