শামে গারিবান
শামে গারিবান
আজ ১০ই মহররম আশুরার দিবাগত রাত। ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ ও ভয়াল রাত। কারবালার শহীদদের পবিত্র দেহ থেকে শির ছিন্ন করে নেয়া হয়েছে এবং অশ্ববাহিনী ছুটিয়ে পবিত্র দেহগুলো দলিত মথিত করা হয়েছে । এরপর এজিদের বর্বর সেনারা ইমাম পরিবারের মহিলাদের তাবু লুট করে তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে । নবী বংশের অসহায় নারী ও শিশুরা আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে এবং বহু শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায় । কারবালার আকাশ আজ রাতে রক্তিম আভায় আবৃত। ইতিহাসে এ রাত "শামে গারিবান" নামে পরিচিত । সত্যিই এর চেয়ে করুণ আর হৃদয়বিদারক আর কি হতে পারে ? ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম পরিবারের সদস্যরা অভিভাবকহীন অবস্থায় পোড়া তাবুগুলোর মধ্যে বসে শহীদদের স্মরনে কাঁদছেন, আহাজারি করছেন।
রাসুলে খোদা তার জীবনের প্রতিদান হিসেবে চেয়েছিলেন মুসলিম উম্মত যেন তার বংশধর ও আহলে বাইতকে ভালোবাসে । অথচ তার আহলে বাইতের প্রতি মুসলিম নামধারীদের এ কি আচরণ ! একদিকে এজিদী সৈনিকদের অট্টহাসি আর শরাব পানের উন্মত্ততা আর অন্যদিকে মস্তকবিহীন শহীদদের পবিত্র লাশ ঘিরে নবী বংশের নারীদের বুকভাঙ্গা বিলাপ । এ রাতে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পাপীও দুফোটা অশ্রু না ফেলে পারে না । পরদিন এজিদের সৈন্যরা পৈশাচিক উল্লাসে আহলে বাইতের নারী ও শিশুদেরকে বেঁধে গলায় দড়ি লাগিয়ে খালি উটের পিঠে তুলে দেয় । ৭২জন শহীদের মস্তক বর্শার ফলায় বিদ্ধ করা হয় । নবী বংশের সম্মানিতা মহিলাদের পর্দা কেড়ে নেয়া হয় । কথিত আছে অসুস্থ ইমাম জয়নুল আবেদীনকে কাটাওয়ালা লোহার বেড়ি পরিয়ে দিয়ে খালি পায়ে টেনে হিঁচড়ে কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয় ।
ইমাম হোসাইন (আঃ) আশুরা বিপ্লবের মাধ্যমে মানবতাকে শিখিয়ে গেছেন, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও মানবীয় মর্যাদা ও শিষ্ঠাচারকে সমুন্নত রাখতে হবে। বিপদ ও শঙ্কা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষকে আপোষকামী করে তোলে, কিন্তু আশুরা বিপ্লবে আমরা দেখতে পাই ষড়যন্ত্র ও হুমকি ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তার সঙ্গীদেরকে মুহুর্তের জন্যও দ্বিধাগ্রস্ত করতে পারে নি এবং তাঁরা পিছু হটেন নি। আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতা, ন্যায় ও সত্যকামীতা, আত্মোৎসর্গ, সাহসিকতা ও মানবীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা- ইত্যাদি বিষয় একের পর এক কারবালা বিপ্লবে সবার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ইমাম হোসেইনের আন্দোলনের অলৌকিকতা ছিল এই যে, যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও মানবীয় ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো ভুলণ্ঠিত হয় নি, কারণ, ইমাম ও তার সঙ্গীরা তো এই মূল্যবোধগুলি সমুন্নত রাখার লক্ষ্যেই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।
ইমামের দর্শন ছিল এই যে, ক্ষমতা গ্রহণ করতে গিয়ে মিথ্যা ও কপটতার আশ্রয় নেয়া যাবে না এবং সঠিক পথের সন্ধান দান ও সংস্কারের কাজে হাত দিয়ে জুলুম ও আগ্রাসন চালানো যাবে না। হোসাইন বিন আলী ইসলামের সেই পতাকাকে উড্ডীন রাখতে সংগ্রাম করেছেন, যা প্রথম উড়িয়েছিলেন তার নানা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। ইসলামের দিক নির্দেশনাকারী এই মহান নেতৃবৃন্দ জনগণের প্রতি এতটা সদয় ছিলেন যে, তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং তারা ঈমান না আনলে ব্যাথিত হয়েছেন। ইমাম হোসাইন (আঃ) মানুষকে ভালোবাসতেন নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে। এ কারণে আশুরা বিপ্লবের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত শত্রু সেনাদের জন্য আলোচনার পথ খোলা রেখেছেন এবং তাদের অন্তর জয় করার চেষ্টা করেছেন।
তাঁর মর্মস্পর্শী ভাষণ শত্রুসেনাদের মধ্যে যাদের অন্তরে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিল, হুর ইবনে ইয়াযিদ তাদের অন্যতম। শত্রুসেনার প্রথম যে দলটি ইমামের কুফা যাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল এবং ইমাম বাহিনীকে কারবালায় তাবু গাড়তে বাধ্য করেছিল, হুর ছিল সে দলের অধিনায়ক। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসার কারণে হুরের সেনাবাহিনী ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিল। এ সময় ইমাম তার সঙ্গীদের নির্দেশ দেন হুরের সেনাদের পানি পান করাতে। ইমামের এই ধরনের উন্নত মানবীয় ব্যবহার হুরের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল বলে আশুরার দিন ইমাম শিবিরের বিপদ দেখে তার মন আন্দোলিত হয়ে উঠলো। ইমাম ও তার সঙ্গীসাথীরা যত বেশী কোনঠাসা হয়ে পড়ছিল, হুরের মন ততই ব্যাকুল হয়ে উঠছিল। তিনি সামান্য পদমর্যাদার চেয়ে ইমাম হোসাইন (আঃ) এর জন্য জীবন দেয়াকে শ্রেয় মনে করলেন। হুর ইমামের কাছে এসে অবনত মস্তকে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে লাগলেন। তিনি ক্ষমা চেয়ে ইমামের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, এখনো কী আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ আছে ? ইমাম ধীরস্থীরভাবে এবং প্রসন্ন চিত্তে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়ে হুরের কাঁধ স্পর্শ করলেন। ইমামের অনুমতি নিয়ে হুর যুদ্ধের ময়দানে গেলেন এবং বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে বহু শত্রুসেনাকে খতম করার পর শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন।
আল্লাহর স্মরণ ও তার সাথে ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতা ছিল ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তার সঙ্গীসাথীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ কারণে তারা পুরোটা সময় জুড়ে ছিলেন স্থিরচিত্ত এবং এক মুহুর্তের জন্যও তাদের মনে কোন দ্বিধাসংশয় কাজ করে নি। শত্রুসেনার বিশাল বাহিনী এবং তাদের সমর সম্ভার ইমাম শিবিরকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারে নি। মাসুম শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই কারবালার ময়দানে রচনা করেছেন অভূতপূর্ব বীরত্বগাঁথা।
কারবালার ময়দানে আত্মোৎসর্গের সবচেয়ে বড় নিদর্শন স্থাপন করেন ইমাম হোসাইন (আঃ) এর ভাই আবুল ফজল আব্বাস। তিনি লড়াইয়ের ময়দানে নেমে বহু শত্রুসেনাকে খতম করেন এবং বাকি সেনারা ভয়ে তার তরবারির নাগাল থেকে পালিয়ে বাঁচে। হযরত আব্বাস ছোটবেলা থেকে ইমাম হোসাইনকে ভীষণভাবে ভালোবাসতেন এবং ইমামের যে কোন চাওয়া পাওয়াকে নিজের ইচ্ছের ওপর স্থান দিতেন। কারবালার ময়দানে ইসলামের সমুহান পতাকা উড্ডীন রাখার দায়িত্ব পড়েছিল হযরত আব্বাসের কাঁধে। যুদ্ধ শুরুর আগ মুহুর্তে ইমাম তাঁকে শিবিরের তৃষ্ণার্ত নারী ও শিশুদের জন্য পানি সংগ্রহ করার দায়িত্ব দিলেন। কারণ, কয়েকদিন ধরে এজিদের পাষন্ড সেনারা ফোরাতের তীর দখল করে ইমাম শিবিরের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। হযরত আব্বাস নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎবেগে শত্রুসেনা ভেদ করে ফোরাতের তীরে পৌঁছে গেলেন। প্রচন্ড গরমের মধ্যে তিনি নিজেও ভীষণভাবে তৃষ্ণার্ত ছিলেন।
ফোরাত নদীতে নেমে তিনি আজলা ভরে পানি নিয়ে মুখে দিতে গেলেন। কিন্তু সাথে সাথে তার মনে পড়ে গেল রাসূলের দৌহিত্র ও তাঁর পরিবারের নারী ও শিশুদের কথা। তৃষ্ণার্ত শিশুরা কান্নার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। ঐসব ছোট ছোট শিশুর আগে পানি পান করতে তার পৌরুষে বাঁধলো। হাতের পানি নদীতে ফেলে দিয়ে তিনি পানির মশক ভর্তি করলেন। এরপর তিনি সমস্ত শক্তি দিয়ে পানি নিয়ে ছুটলেন ইমাম শিবিরের দিকে। কিন্তু শত্রু সেনারা তাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে তার ওপর মুহুর্মুহু হামলা চালাতে লাগলো। প্রথমে তারা তাঁর হাত কেটে ফেললো, এরপর তিনি মাটিতে পড়ে গেলে তাকে নির্মমভাবে শহীদ করা হলো।
ইমাম হোসাইন (আঃ) জালিম ইয়াজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন যে, কোন শাসক ইসলামের নীতিমালা থেকে দুরে সরে গেলে কিংবা অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করলে তার বিরুদ্ধে নিজের সাধ্যনুযায়ী সংগ্রাম করতে হবে ৷ ইমাম হোসাইন নিজের, পরিবার পরিজনের এবং সঙ্গী সাথীদের জীবন উত্স র্গ করে ইসলামকে যেভাবে রক্ষা করে গেছেন, বিশ্বের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে হবে ৷ তাহলেই ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে ৷ আশুরা বিপ্লবের পর কারবালার হৃদয়বিদারক কাহিনী প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম হোসাইন (আঃ) এর বোন হযরত যেইনাব সালামুল্লাহি আলাইহা এবং ইমাম পুত্র তথা আহলে বাইতের চতুর্থ ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ)। তাঁরা কারবালার নিষ্ঠুর অত্যাচার অবিচারের কাহিনী জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেন ।
ইসলামের বিপ্লবী নায়িকা হযরত জেইনাব যদি না থাকতেন তাহলে কারবালার আত্মত্যাগের কাহিনী মানুষের কাছে অজানা থেকে যেত । সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইন ইসলামী বিপ্লবের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন তার পরবর্তী আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন হযরত জেইনাব । ''হাল মিন নাসেরিন ইয়ানসুরনা '' অর্থাৎ ''আমাদের সাহায্য করার কেউ আছে কি ?'' ইমাম হোসাইনের এই কালজয়ী আহবানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন হযরত জেইনাব সালামুল্লাহি আলাইহা । আজো সেই আহবান মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয় আশুরার বিপ্লব থেকে শিক্ষা নেয়ার- ইসলামকে নতুন করে জানার।
শামে গারিবান
আজ ১০ই মহররম আশুরার দিবাগত রাত। ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ ও ভয়াল রাত। কারবালার শহীদদের পবিত্র দেহ থেকে শির ছিন্ন করে নেয়া হয়েছে এবং অশ্ববাহিনী ছুটিয়ে পবিত্র দেহগুলো দলিত মথিত করা হয়েছে । এরপর এজিদের বর্বর সেনারা ইমাম পরিবারের মহিলাদের তাবু লুট করে তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে । নবী বংশের অসহায় নারী ও শিশুরা আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে এবং বহু শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায় । কারবালার আকাশ আজ রাতে রক্তিম আভায় আবৃত। ইতিহাসে এ রাত "শামে গারিবান" নামে পরিচিত । সত্যিই এর চেয়ে করুণ আর হৃদয়বিদারক আর কি হতে পারে ? ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম পরিবারের সদস্যরা অভিভাবকহীন অবস্থায় পোড়া তাবুগুলোর মধ্যে বসে শহীদদের স্মরনে কাঁদছেন, আহাজারি করছেন।
রাসুলে খোদা তার জীবনের প্রতিদান হিসেবে চেয়েছিলেন মুসলিম উম্মত যেন তার বংশধর ও আহলে বাইতকে ভালোবাসে । অথচ তার আহলে বাইতের প্রতি মুসলিম নামধারীদের এ কি আচরণ ! একদিকে এজিদী সৈনিকদের অট্টহাসি আর শরাব পানের উন্মত্ততা আর অন্যদিকে মস্তকবিহীন শহীদদের পবিত্র লাশ ঘিরে নবী বংশের নারীদের বুকভাঙ্গা বিলাপ । এ রাতে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পাপীও দুফোটা অশ্রু না ফেলে পারে না । পরদিন এজিদের সৈন্যরা পৈশাচিক উল্লাসে আহলে বাইতের নারী ও শিশুদেরকে বেঁধে গলায় দড়ি লাগিয়ে খালি উটের পিঠে তুলে দেয় । ৭২জন শহীদের মস্তক বর্শার ফলায় বিদ্ধ করা হয় । নবী বংশের সম্মানিতা মহিলাদের পর্দা কেড়ে নেয়া হয় । কথিত আছে অসুস্থ ইমাম জয়নুল আবেদীনকে কাটাওয়ালা লোহার বেড়ি পরিয়ে দিয়ে খালি পায়ে টেনে হিঁচড়ে কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয় ।
ইমাম হোসাইন (আঃ) আশুরা বিপ্লবের মাধ্যমে মানবতাকে শিখিয়ে গেছেন, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও মানবীয় মর্যাদা ও শিষ্ঠাচারকে সমুন্নত রাখতে হবে। বিপদ ও শঙ্কা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষকে আপোষকামী করে তোলে, কিন্তু আশুরা বিপ্লবে আমরা দেখতে পাই ষড়যন্ত্র ও হুমকি ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তার সঙ্গীদেরকে মুহুর্তের জন্যও দ্বিধাগ্রস্ত করতে পারে নি এবং তাঁরা পিছু হটেন নি। আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতা, ন্যায় ও সত্যকামীতা, আত্মোৎসর্গ, সাহসিকতা ও মানবীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা- ইত্যাদি বিষয় একের পর এক কারবালা বিপ্লবে সবার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ইমাম হোসেইনের আন্দোলনের অলৌকিকতা ছিল এই যে, যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও মানবীয় ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো ভুলণ্ঠিত হয় নি, কারণ, ইমাম ও তার সঙ্গীরা তো এই মূল্যবোধগুলি সমুন্নত রাখার লক্ষ্যেই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।
ইমামের দর্শন ছিল এই যে, ক্ষমতা গ্রহণ করতে গিয়ে মিথ্যা ও কপটতার আশ্রয় নেয়া যাবে না এবং সঠিক পথের সন্ধান দান ও সংস্কারের কাজে হাত দিয়ে জুলুম ও আগ্রাসন চালানো যাবে না। হোসাইন বিন আলী ইসলামের সেই পতাকাকে উড্ডীন রাখতে সংগ্রাম করেছেন, যা প্রথম উড়িয়েছিলেন তার নানা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। ইসলামের দিক নির্দেশনাকারী এই মহান নেতৃবৃন্দ জনগণের প্রতি এতটা সদয় ছিলেন যে, তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং তারা ঈমান না আনলে ব্যাথিত হয়েছেন। ইমাম হোসাইন (আঃ) মানুষকে ভালোবাসতেন নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে। এ কারণে আশুরা বিপ্লবের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত শত্রু সেনাদের জন্য আলোচনার পথ খোলা রেখেছেন এবং তাদের অন্তর জয় করার চেষ্টা করেছেন।
তাঁর মর্মস্পর্শী ভাষণ শত্রুসেনাদের মধ্যে যাদের অন্তরে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিল, হুর ইবনে ইয়াযিদ তাদের অন্যতম। শত্রুসেনার প্রথম যে দলটি ইমামের কুফা যাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল এবং ইমাম বাহিনীকে কারবালায় তাবু গাড়তে বাধ্য করেছিল, হুর ছিল সে দলের অধিনায়ক। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসার কারণে হুরের সেনাবাহিনী ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিল। এ সময় ইমাম তার সঙ্গীদের নির্দেশ দেন হুরের সেনাদের পানি পান করাতে। ইমামের এই ধরনের উন্নত মানবীয় ব্যবহার হুরের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল বলে আশুরার দিন ইমাম শিবিরের বিপদ দেখে তার মন আন্দোলিত হয়ে উঠলো। ইমাম ও তার সঙ্গীসাথীরা যত বেশী কোনঠাসা হয়ে পড়ছিল, হুরের মন ততই ব্যাকুল হয়ে উঠছিল। তিনি সামান্য পদমর্যাদার চেয়ে ইমাম হোসাইন (আঃ) এর জন্য জীবন দেয়াকে শ্রেয় মনে করলেন। হুর ইমামের কাছে এসে অবনত মস্তকে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে লাগলেন। তিনি ক্ষমা চেয়ে ইমামের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, এখনো কী আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ আছে ? ইমাম ধীরস্থীরভাবে এবং প্রসন্ন চিত্তে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়ে হুরের কাঁধ স্পর্শ করলেন। ইমামের অনুমতি নিয়ে হুর যুদ্ধের ময়দানে গেলেন এবং বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে বহু শত্রুসেনাকে খতম করার পর শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন।
আল্লাহর স্মরণ ও তার সাথে ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতা ছিল ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তার সঙ্গীসাথীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ কারণে তারা পুরোটা সময় জুড়ে ছিলেন স্থিরচিত্ত এবং এক মুহুর্তের জন্যও তাদের মনে কোন দ্বিধাসংশয় কাজ করে নি। শত্রুসেনার বিশাল বাহিনী এবং তাদের সমর সম্ভার ইমাম শিবিরকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারে নি। মাসুম শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই কারবালার ময়দানে রচনা করেছেন অভূতপূর্ব বীরত্বগাঁথা।
কারবালার ময়দানে আত্মোৎসর্গের সবচেয়ে বড় নিদর্শন স্থাপন করেন ইমাম হোসাইন (আঃ) এর ভাই আবুল ফজল আব্বাস। তিনি লড়াইয়ের ময়দানে নেমে বহু শত্রুসেনাকে খতম করেন এবং বাকি সেনারা ভয়ে তার তরবারির নাগাল থেকে পালিয়ে বাঁচে। হযরত আব্বাস ছোটবেলা থেকে ইমাম হোসাইনকে ভীষণভাবে ভালোবাসতেন এবং ইমামের যে কোন চাওয়া পাওয়াকে নিজের ইচ্ছের ওপর স্থান দিতেন। কারবালার ময়দানে ইসলামের সমুহান পতাকা উড্ডীন রাখার দায়িত্ব পড়েছিল হযরত আব্বাসের কাঁধে। যুদ্ধ শুরুর আগ মুহুর্তে ইমাম তাঁকে শিবিরের তৃষ্ণার্ত নারী ও শিশুদের জন্য পানি সংগ্রহ করার দায়িত্ব দিলেন। কারণ, কয়েকদিন ধরে এজিদের পাষন্ড সেনারা ফোরাতের তীর দখল করে ইমাম শিবিরের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। হযরত আব্বাস নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎবেগে শত্রুসেনা ভেদ করে ফোরাতের তীরে পৌঁছে গেলেন। প্রচন্ড গরমের মধ্যে তিনি নিজেও ভীষণভাবে তৃষ্ণার্ত ছিলেন।
ফোরাত নদীতে নেমে তিনি আজলা ভরে পানি নিয়ে মুখে দিতে গেলেন। কিন্তু সাথে সাথে তার মনে পড়ে গেল রাসূলের দৌহিত্র ও তাঁর পরিবারের নারী ও শিশুদের কথা। তৃষ্ণার্ত শিশুরা কান্নার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। ঐসব ছোট ছোট শিশুর আগে পানি পান করতে তার পৌরুষে বাঁধলো। হাতের পানি নদীতে ফেলে দিয়ে তিনি পানির মশক ভর্তি করলেন। এরপর তিনি সমস্ত শক্তি দিয়ে পানি নিয়ে ছুটলেন ইমাম শিবিরের দিকে। কিন্তু শত্রু সেনারা তাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে তার ওপর মুহুর্মুহু হামলা চালাতে লাগলো। প্রথমে তারা তাঁর হাত কেটে ফেললো, এরপর তিনি মাটিতে পড়ে গেলে তাকে নির্মমভাবে শহীদ করা হলো।
ইমাম হোসাইন (আঃ) জালিম ইয়াজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন যে, কোন শাসক ইসলামের নীতিমালা থেকে দুরে সরে গেলে কিংবা অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করলে তার বিরুদ্ধে নিজের সাধ্যনুযায়ী সংগ্রাম করতে হবে ৷ ইমাম হোসাইন নিজের, পরিবার পরিজনের এবং সঙ্গী সাথীদের জীবন উত্স র্গ করে ইসলামকে যেভাবে রক্ষা করে গেছেন, বিশ্বের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে হবে ৷ তাহলেই ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে ৷ আশুরা বিপ্লবের পর কারবালার হৃদয়বিদারক কাহিনী প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম হোসাইন (আঃ) এর বোন হযরত যেইনাব সালামুল্লাহি আলাইহা এবং ইমাম পুত্র তথা আহলে বাইতের চতুর্থ ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ)। তাঁরা কারবালার নিষ্ঠুর অত্যাচার অবিচারের কাহিনী জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেন ।
ইসলামের বিপ্লবী নায়িকা হযরত জেইনাব যদি না থাকতেন তাহলে কারবালার আত্মত্যাগের কাহিনী মানুষের কাছে অজানা থেকে যেত । সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইন ইসলামী বিপ্লবের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন তার পরবর্তী আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন হযরত জেইনাব । ''হাল মিন নাসেরিন ইয়ানসুরনা '' অর্থাৎ ''আমাদের সাহায্য করার কেউ আছে কি ?'' ইমাম হোসাইনের এই কালজয়ী আহবানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন হযরত জেইনাব সালামুল্লাহি আলাইহা । আজো সেই আহবান মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয় আশুরার বিপ্লব থেকে শিক্ষা নেয়ার- ইসলামকে নতুন করে জানার।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন