কারবালার নূরানি কাফেলা
কারবালার নূরানি কাফেলা
গভির শোকাবহ মুহররম আবারো এসেছে ফিরে। এসেছে কারবালার ঐতিহাসিক ত্যাগের কথা, মর্মন্তুদ শাহাদাতের কথা আর নবীজীর সন্তানের ওপর বর্বর নৃশংসতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে। ইমাম হোসাইন (আ) এর বিপ্লব কেবল একটা মুখোমুখি সংঘর্ষ কিংবা যুদ্ধই ছিল না বরং এই বিপ্লবের মধ্যে ছিল উন্নত নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতার উচ্চতরো শিক্ষা। কারবালা বিপ্লবের এই শিক্ষাগুলো নিয়ে আমরা কথা বলার চেষ্টা করবো আজকের এ আসরে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক উপলব্ধি দিন এ প্রত্যাশা রইলো।
ইমাম হোসাইন (আ) এর আন্দোলনের সূচনালগ্নে আহলে বাইতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কুফার বিশাল জনগোষ্ঠি ইমামের অনুসারী ছিলো। কেননা তারা ইয়াযিদের অত্যাচার সম্পর্কে অবহিত ছিল এবং ইমাম হোসাইন বিন আলী (আ) এর মর্যাদা সম্পর্কে জানতো। কিন্তু বিশাল এই জনগোষ্ঠির খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশই কেবল ইমামের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিল। সমূহ বিপদের মুখেও এই ক্ষুদ্র অংশটি কেন ইমামের সাথে জীবন বিলিয়ে দিলো-সে বিষয়টি অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে। ইমামের এই সঙ্গীদের এমন কী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল কিংবা ইমামের আন্দোলনেরই বা কী ধরনের বৈশিষ্ট্য ছিল সে বিষয়ে খানিকটা কথা না বললে কারবালা বিপ্লবের গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
ইমামের সঙ্গীগণের উন্নত বৈশিষ্ট্য ছিল গভীর বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতা। বিশ্বাস হচ্ছে অগ্নিশিখার মতো যা সর্বপ্রকার সন্দেহ আর প্রতারণার জাল পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। সেইসাথে আধ্যাত্মিকতা যদি না থাকে তাহলে বিপথগামী এবং বিচ্যুতির আশঙ্কা থাকে। ইমামের সঙ্গীগণ ছিলেন আধ্যাত্মিকতার ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ। তাঁরা জানতেন কার সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন এবং কোথায় যাবেন। তাঁরা যেমন পথ চিনতেন তেমনি বিপথও চিনতেন। আশি বছরের বৃদ্ধ হাবিব বিন মাজাহের খুব সুন্দর তিলাওয়াৎ করতেন। তিনি কারবালা যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনে ইমামের খেদমতে হাজির হলেন। ইমাম তাকেঁ বুকে জড়িয়ে নিলেন। হাবিব সুযোগ পেলেই শত্রু সেনাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতেন এ আশায় যে যদি এখনো তাদেরকে তাদের ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত থেকে ফেরানো যায়। একবার তিনি শত্রু সেনাদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ
"হে কওম! তোমরা খুবই বাজে লোক। গতকাল চেঠি লিখেছো, হোসাইন ইবনে আলী (আ) কে দাওয়াত করেছো, আর আজ চুক্তি ভঙ্গ করছো, সম্মানটুকুও বজায় রাখলে না। যদি রাসূলে খোদার সন্তানকে তাঁর রাতজাগা পরিবার পরিজন এবং সঙ্গী-সাথীদেরসহ হত্যা করো কাল কিয়ামতের দিন কী জবাব দেবে!" আশুরার রাতে হাবিব তাঁর সাথীদের বলেছিলেনঃ "আগামীকাল আমি হবো রণাঙ্গনের প্রথম শহীদ। যতোক্ষণ আমাদের দেহে প্রাণ থাকবে ততোক্ষণ বনী হাশিম অর্থাৎ হোসাইনের খান্দানকে যুদ্ধের ময়দানে যেতে দেবো না।" এ সব বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে ইমামের সঙ্গীগণ ভালো করেই জানতেন তাঁরা এই যুদ্ধে ইমামের সাথে থাকলে শহীদ হয়ে যাবেন। তারপরও জেনেশুনে তাঁরা যে শাহাদাতের পথ বেছে নিলেন এটা সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। ইমামের প্রতি কী পরিমাণ আস্থা-বিশ্বাস থাকলে এবং কতোটা আধ্যাত্মিক দৃঢ়তা থাকলে এরকম সিদ্ধান্তে অটল থাকা যায় তা ভাববার বিষয়।
পরদিন সত্যি সত্যিই রাসূলে খোদা (সা) এর সাহাবি, ইমাম আলি (আ) এর সঙ্গী হাবিব বিন মাজাহের শহীদ হয়ে গেলেন। তাঁর কর্তিত মস্তক দেখে ইমাম হোসাইন (আ) কান্না বিজড়িত কণ্ঠে গুঞ্জনের সুরে বললেনঃ "হে হাবিব! খোদা তোমাকে বরকত দিন। কী রকম ফযিলতের অধিকারী ব্যক্তি ছিলে তুমি। প্রতিটি রাত ভোর হতো তোমার কোরআন খতমের মধ্য দিয়ে।"
কিছু কিছু মানুষ আছে পৃথিবীর মোহে পড়ে মৃত্যুকে ভয় করে। মৃত্যুর ভয়ে তারা সর্বপ্রকার তাচ্ছিল্যপূর্ণ বন্দিময় জীবন বেছে নিয়ে হলেও বেচেঁ থাকতে কুণ্ঠা বোধ করে না। পক্ষান্তরে স্বাধীন জীবনে বিশ্বাসী মানুষেরা প্রাণের বিনিময়ে হলেও অপমান বা ভোগান্তিকে মেনে নিতে রাজি নয়। আত্মসম্মান এবং মর্যাদাময় জীবনই হলো স্বাধীন জীবন। এ জীবন সম্পর্কে ইমাম হোসাইন (আ) বলেছেনঃ "সম্মানজনক মৃত্যু অপমানজনক জীবনের চেয়ে উত্তম।" আশুরা আন্দোলন ছিল হোসাইন (আ) এবং তাঁর নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীদের ঔদার্য ও স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তির মূর্তপ্রকাশ। ইসলামে এই মনোবৃত্তিকে মহান বলে মূল্যায়ন করা হয়েছে। স্বাধীনতা এবং ই্চ্ছা মানুষের অস্তিত্বের সাথে একাকার হয়ে মিশে আছে। এই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে মানুষের বিকাশ ও পূর্ণতার জন্যে এবং আত্মিক ও আধ্যাত্মিকতার উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করা হয়। হযরত আলী (আ) তাঁর সন্তানকে ওসিয়্যৎ করেছিলেন যেঃ "হে আমার সন্তান! যা কিছুই হাতছাড়া করো বা বিক্রি করো সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব। কিন্তু একটি জিনিস আছে সমগ্র বিশ্বে যার মূল্য খুজেঁ পাওয়া যাবে না, তা তুমি নিজে। যদি তুমি তোমার আত্মা বা জীবনকে বিক্রি করো সমগ্র পৃথিবী তার মূল্যের সমান হবে না।"
পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগি করা থেকে রেহাই পাওয়াটাই স্বাধীনতা। আল্লাহর আনুগত্য করলে দ্বীনের প্রতি একনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয় এবং গোমরাহির সর্বপ্রকার অন্ধকার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সূরা যুমারের দুই নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ অতএব আপনি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদাত করুন। ইসলামে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগি করা কিংবা গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া এক ধরনের বন্দিত্ব বা দাসত্বের মতো। যারা দুনিয়াবি স্বার্থের মোহে বন্দি তারা উন্নত লক্ষ্যে পৌঁছুতে সক্ষম নয়। সম্পদ হারানোর ভয় কিংবা আশা পূরণ হওয়া থেকে বঞ্চিত হবার ভয় বড়ো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।কিন্তু যারা স্বাধীনচেতা তারা সম্পদের মোহের কাছে বন্দি নন।কারবালার ঐতিহাসিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে একথাগুলো স্মরণ রাখতে হবে। ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ ছিলেন মুক্ত ও উদার হৃদয় এবং স্বাধীনচেতা। সেজন্যেই তাঁর পৃথিবীর মোহ ত্যাগ করে মানবিক ও ঐশী মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণ করার জন্যে আত্মত্যাগ করতে কুণ্ঠা বোধ করেন নি। হুরের বিপ্লবী ভূমিকার কথা উল্লেখ করে শেষ করবো আজকের আলোচনা।
হুর ইবনে ইয়াযিদ রিয়াহি ছিলেন ইয়াযিদ বাহিনীর শ্রেষ্ঠ এক বীর সেনানী। কুফার শাসক ওবায়দুল্লাহ হুরের সেনাপতিত্বে এক হাজার সেনার একটি বাহিনী পাঠিয়ে ইমাম হোসাইনের দলবল নিয়ে কুফায় যেতে আদেশ দিয়েছে। আদেশ অনুযায়ী হুরের বাহিনী ইমামের পথ রোধ করে দাঁড়ায় এবং তাকেঁ কারবালায় যেতে বাধ্য করে। সেখানে যুদ্ধের দশম দিনে ত্রিশ হাজার ইয়াযিদি বাহিনীর সামনে ইমামের বাহাত্তর জন সঙ্গীর একটি কাতার। সবাই ইমামের নেতৃত্বে শহীদদ হবার জন্যে প্রস্তুত। হুর এসব ভেবে তার কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনা বোধ করতে লাগলো। ঘোড়াকে পানি খাওয়ানোর বাহানায় ইয়াযিদি বাহিনী থেকে দূরে সরে গিয়ে তাঁর পদমর্যাদাকে পদদলিত করে হঠাৎ করেই শৃঙ্খলমুক্ত এবং স্বাধীন হয়ে চলে এলো হোসাইন বিন আলী (আ) এর পক্ষে। এসেই তওবা করলো। তারপর বললো "আমি সবার আগে আপনার পথ রোধ করেছিলাম, এখন অনুমতি দিন সবার আগে আপনার প্রদর্শিত পথে শহীদ হই,হয়তোবা এর ওসিলায় কিয়ামতের দিন নবীজীর পাশে বসার তৌফিক লাভ করতে পারি।"
এই বলে ইমামের অনুমতি নিয়ে হুর যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হন। ইমাম তাঁর পাশে গিয়ে বললেনঃ "চোখ খোলো! দেখো! তুমি স্বাধীন। এই পৃথিবীতেও স্বাধীন, আখেরাতেও স্বাধীন।" এই ছিল ইমাম হোসাইন (আ) এর সঙ্গীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তারা সবাই আসলে চেয়েছিল ইমামের পরিচালনায় সত্য ও সঠিক পথে জীবন দিয়ে ইহকালীন এবং পরকালীন সৌভাগ্যের অধিকারী হতে। আল্লাহ তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করুন আর তাদের সেই আত্মত্যাগের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলুন বর্তমান বিশ্বের তরুণ প্রজন্মকে। সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন