দশই মহররম
দশই মহররম
মরুভূমির লাল সূযটা দিগন্তের ওপারে মুখ লুকানো । সে হয়তো লজ্জায় দুঃখে পালিয়ে বাঁচল । ইমাম শিবিরের করুণ আহাজারী, হয়তো তারও সহ্য হয়নি । পিপাসায় কাতর প্রাণ উষ্ঠাগত । কচি শিশুদের দুঃখে, পাষাণ হৃদয়ও বিচলিত হয় । কিন্তু নরাধম এজিদ বাহিনীর হৃদয়ে কোন দয়ামায়া নেই । তিনদিন ধরে নবীবংশের প্রিয়জনরা পানিও পাচ্ছে না । দুরাত্মা এজিদ পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে । একি নিষ্ঠুরতা ! ইমাম বাহিনীর সবাই পরম ধৈর্যের সাথে, তাদের জীবনের শেষ রাতটি ইবাদত বন্দেগীতে কাটালেন । অন্তপুরে নারী শিশুদের করুণ কান্নার ধ্বনি । কারবালার সেই রাত্রীকে আরো ভারী করে তুলেছিল । গভীর নিশীথের মরু হাওয়া যেন অশুভ সংকেত নিয়ে ছুটে গেল কোন অজানার পথে । এরপর আযানের ধ্বনী যেন হৃদয়কে স্পর্শ করলো । এই সুমধুর ধ্বনী করুণ আর্তনাদ হয়ে যেন বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিল তোমরা কে কোথায় আছো দেখে যাও আজ কি ঘটতে চলেছে । বর্ণিত আছে হযরত আলী আকবরের কন্ঠস্বর ছিল মহানবী (সঃ) এর অনুরুপ । তার কন্ঠে আজানের ধ্বনী এমনকি এজিদ বাহিনীর মাঝেও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল । কিন্তু পিশাচদের মাঝে তার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি । আশুরার দিন ভোরে ফজরের নামাজের ইমামতি করলেন ইমাম হোসেন (আঃ) । এই নামাজই ছিল কারবালার শহীদদের শেষ নামাজ । আল্লাহর সৈনিকদের এই নামাজ শেষ হবার আগেই এজিদ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়ে যায় । দুরাচার সেনাপতি ওমর সাদ প্রথমে একটি তীর নিক্ষেপ করে যুদ্ধ শুরু করে । তীর বৃষ্টির মধ্যেই ইমাম ও তার সাথীরা নামাজ শেষ করলেন । ইমার তার সাথীদেরকে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিয়ে দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন । ভাই আব্বাসকে দিলেন পতাকা রক্ষার দায়িত্ব । এ সত্যের পতাকাবাহী হযরত আব্বাস " আব্বাস-ই- আলমদার " নামে বিখ্যাত ।
পথভ্রষ্ট দুরাত্মাদেরকে আবারও বুঝাবার চেষ্টা করলেন ইমাম হোসেইন । ভুল বুঝার শেষ সুযোগ দিয়ে , এজিদ বাহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন, হে জনসাধারণ , ক্ষান্ত হও । তোমরা কি জান আমি কে ? আমাকে হত্যা করা কি উচিত হবে ! আমি কি তোমাদের নবী কণ্যা ফাতেমার সন্তান নই । আলী মুর্তাজা কি আমার পিতা নন ? তোমরা কি জানোনা মহানবী (সাঃ) বলেছেন আমি ও আমার ভাই বেহেশতে যুবকদের সরদার ? আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে তোমরা জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী, আবু সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনে সা'দ সাঈদী, যায়েদ ইবনে আরকাম, আনাস ইবনে মালিকের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নাও । এরপরও কি তোমরা আমাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকবে না ? কিন্তু পাষাণ হৃদয় দুরাচারদের মাঝে কোন ভাবান্তর হলো না । ওমর সাদ, শিমারসহ অন্যান্য পাপিষ্ঠরা যুদ্ধ করার জন্যে সৈন্যদের লেলিয়ে দিল । এই অবস্থায় এজিদ বাহিনীর এক সেনাপতি হুরের মাঝে ভাবান্তর হলো । ইমামের ভাষণ শুনে সে নিজের ভুল বুঝতে পারলো । ইমাম হোসেইনের কাছে এসে সে বলল, হযরত আপনি আমাকে ক্ষমা করুন । আমি অনেক পাপ করেছি । আমি আপনাকে বাধা দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছি । আপনাদের এই অবস্থার জন্যে আমি দায়ী । আমি অনুতপ্ত হয়ে আপনার কাছে ফিরে এসেছি, আমার তওবা কি কবুল হবে । ইমাম মৃদু হেসে তাকে আশ্বাস দিলেন , হুর দেরী না করে তলোয়ার চালাতে চালাতে এজিদ বাহিনীর দিকে ছুটে গেল । হোরের সাথে সাথে তার ছেলে , ভাই, এবং ক্রীতদাসও এজিদ বাহিনী ত্যাগ করে ইমাম বাহিনীতে এসে যোগ দিল । এরা সকলে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেল । মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই তীব্র আকার ধারন করলো । এ ছিল অসম যুদ্ধ । মাত্র ৭০/৮০ জন মুসলমানের সাথে হাজার হাজার মোনাফেকের যুদ্ধ । এ ছিল এক অসহায় মুষ্টিমেয় ঈমানদারের প্রতিরোধ যুদ্ধ । একদল ধর্মপ্রাণ আল্লাহর বান্দাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে হিংস্র নেকড়ের দল । ছোট্ট একদল মোমিন কারবালার এই মরু প্রান্তরে যে অসীম সাহসিকতা, বীরত্ব ও ধৈর্য্যরে পরিচয় দিলেন মানব ইতিহাসে তেমনটি আর কখনো দেখা যায় নি এবং ভবিষ্যতেও হয়ত দেখা যাবে না ।
তিন দিন ধরে পিপাসায় কাতর ইমাম বাহিনী ছিলেন ঈমানের তেজে বলীয়ান । পার্থিব শক্তি সামর্থ তখন ছিল গৌণ ব্যাপার । ধৈর্য আর ঈমানের পরীক্ষাই ছিল মুখ্য । মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতকে রক্ষা করার জন্যে ইমাম হোসেনের সাথীরা সিংহ বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রু সৈন্যের উপর । প্রচন্ড আক্রমনে অসংখ্য এজিদ সৈন্য খতম করে নিজেরা শহীদ হতে লাগলেন । এভাবে একে একে ইমাম বাহিনীর বিখ্যাত বীরেরা শহীদ হয়ে গেলেন । তারা সকলেই ইমাম হোসেন ও তার আহলে বাইতের চারপাশে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে যুদ্ধ করেছেন । ইমামের দিকে ছুটে আসা তীর ও বর্শার আঘাত তারা বুক পেতে নিয়েছেন । ইমামের সামনে তারা একে একে শহীদ হয়ে গেছেন । বাকি রইলেন শুধু আহলে বাইতের সদস্যগণ । মহাকালের এই মহা কোরবানির জন্যে এবার ইমাম হোসেন ও তার আহলে বাইত প্রস্তুত হলেন । কারবালার আকাশে প্রচন্ড তেজে জ্বলছে সূর্য । সুহাওয়ার করুণ দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে । আল্লাহর প্রিয়তমদের প্রতি শয়তানদের আক্রমণে বিস্ময় বিমুঢ় হয়ে আসছে বিশ্ব প্রকৃতি । নবীজীর প্রিয় নাতনী হযরত যয়নব (সাঃ) তার দুই শিশু সন্তান অউন এবং মোহাম্মদকে ডেকে বললেন, এখনও তোমরা বসে আছো ? আল্লাহর পথে শহীদ হবার সময়তো এসে গেছে । ১০ বছর ও ৯ বছরের দুই ভাই সমস্বরে বলে উঠলেন, না মা, আমরা শুধু পবিত্র ইমামের হুকুমের অপেক্ষায় আছি । হযরত যয়নব (সাঃ) ভাই ইমাম হোসেনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তার দুই সন্তানকে এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিলেন । ক্ষুদে বীর অউন এবং মোহাম্মদ অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন । ইমাম হোসেন (আঃ) ও আব্বাস ছুটে গিয়ে তাদের পবিত্র দেহ দুটো এনে হযরত যয়নাবের সামনে রাখলেন । হযরত যয়নাব নিজ সন্তানের নূরানী মুখে চুমু খেতে খেতে বললেন প্রিয় বাছারা আমার । এখন আমি তোমাদের উপর খুশী হয়েছি । তোমরা সত্যের জন্যে যুদ্ধ করে আল্লাহ ও তার নবীকে খুশী করেছ । ছোট্ট এ শিশু দুটোর শাহাদাতের পর আহলে বাইতের অন্যান্য ছেলে সন্তানদের মধ্যে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেল । ১৪ বছরের কিশোর কাসিম ইবনে হাসান ইমামের অনুমতি নিয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন ।
ইমাম হোসেন (আঃ)এর ছেলে কাসিম একাকী তলোয়ার চালাতে চালাতে শত্রু বাহিনীর ভেতর ঢুকে পড়লেন । তিনি একাই পাঁচজন শত্রু সেনাকে খতম করে শহীদ হয়ে গেলেন । ইমাম হোসেন (আঃ) ভাইপোর মৃতদেহ তুলে আনার আগেই শয়তানের দল তার উপর ঘোড়া চালিয়ে দেয় । কাসিমের শাহাদাতে ইমাম শিবিরে কান্নার রোল পড়ে যায় । ইমাম হোসেন সকলকে শান্ত করে যুদ্ধ পরিচালনা করতে লাগলেন । কাসিমের মৃত্যু দেখে মহাবীর আব্বাস আর সহ্য করতে পারলেন না । তিনি ইমামকে সালাম করে এজিদের সেনাবাহিনীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ শুরু করলেন । তার ঘোড়া বিদ্যুৎ গতিতে শত্রু ব্যুহ ভেদ করছে । আব্বাসের তলোয়ারের আঘাতে শত্রুসেনারা কচুকাটা হচ্ছে । এই মহাবীরের সামনে সহজে কেউ আসার সাহস পাচ্ছে না । আব্বাস শত্রু সেনাদের মাঝখান দিয়ে পথ করে ফোরাতের তীরে এসে পৌছুলেন । তাকে কেউ আটকে রাখতে পারল না । প্রচন্ড পিপাসা কাতর আব্বাস, পানি খাওয়ার জন্যে নিচু হলেন । কিন্তু সাথে সাথে আঁজলা থেকে পানি ফেলে দিলেন । ইমাম শিবিরের কচি শিশুদের কথা তার মনে পড়ল । দুধের বাচ্চারা এক ফোটা পানির জন্যে কাতরাচ্ছে । তাদের ফেলে তিনি কি করে পানি পান করবেন ? একটি থলেতে পানি ভরে ফিরতে লাগলেন আব্বাস । অমনি গোপন জায়গা থেকে অসংখ্য তীর এসে তাকে আঘাত করল । যুদ্ধাহত বীর আব্বাস ফোরাতের তীরেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন । মহাবীর আব্বাস শহীদ হওয়ার পর ইমাম হোসেনের ছেলে আলী আকবর ময়দানে এলেন । আলী আকবর ছিলেন দেখতে অনেকটা মহানবীর (সঃ)এর মত । তাকে যুদ্ধের ময়দানে দেখে শত্রু সেনারা থমকে গেল । কেউ তাকে আঘাত করার সাহস পেলনা । বীর আলী আকবর প্রচন্ড বেগে তলোয়ার চালাতে চালাতে শত্রু সেনাদেরকে চারদিকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন । বহু শত্রু সেনা খতম করে আলী আকবর ইমামের কাছে ফিরে এসে বললেন আব্বাজান আমি বড্ড পিপাসার্ত । ইমাম হোসেন পুত্রকে সান্তনা দিয়ে আবার যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দিলেন । আলী আকবর বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে গেলেন ।
এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ শুরু করলেন । হঠাৎ একটি তীর এসে তার কন্ঠে বিদ্ধ হলে তিনি ধরাশায়ী হন । এভাবে ইমাম হোসেনের চোখের সামনেই তার পুত্র, ভ্রাতুস্পুত্র, ও বন্ধু বান্ধবরা একে একে প্রাণ বিসর্জন দিলেন । এ আত্ম বিসর্জনে কারো মাঝে কোন প্রকার ভয়ভীতি বা দ্বিধা দ্বন্দ ছিল না । সবাই স্বত:স্ফূর্তভাবে ইমাম হোসেনের আহবানে সাড়া দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্যে মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজেদের বিলীন করে দিয়েছেন । ইমাম হোসেন দেখলেন চূড়ান্ত সময় এসে গেছে । পৃথিবীর বুকে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন তিনি । মহানবী ( সাঃ) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্যে যে প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল সেটাই তিনি উপস্থাপন করে বিশ্ব তাগুতী শক্তিকে হতবাক করে দিলেন । ইমাম হোসেন ও তার সাথীরা এজিদী ইসলামের মোকাবেলায় মোহাম্মদী ইসলামের ঝান্ডাকে উচিয়ে ধরলেন । বাতিল শক্তির মুখোশ উম্মোচন করে সত্যের মশালকে প্রজ্জ্বলিত করেছেন । সকলকে হারিয়ে আজ এই মুহুর্তে কারবালার মরুপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছেন ইমাম হোসেন । এত বিষাদ, এত বেদনা, এত বিরহের মাঝেও ইমামের মিশনকে কৃতকার্য করার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন তিনি । এখন তো কেবল শেষ পোঁচ দেয়াই বাকি । তিনি নিজে এই মহাকান্ডের সমাপ্তি টানবেন । দুধের শিশু আলী আসগরকে দেখার সাধ জাগল । ইমাম হোসেন তাঁবুতে গিয়ে কচি শিশু আলী আসগরকে দুহাতে বুকে তুলে নিলেন । পিপাসায় কাতর এই শিশুকে দেখে ইমাম আর স্থির থাকতে পারলেন না, শত্রুদের উদ্দেশ্যে বললেন, হে জনসাধারণ ! তোমরা আমার সাথে যুদ্ধ করছো আমাকে হত্যা করাই তোমাদের উদ্দেশ্য । এই শিশু তো কোন দোষ করে নি , একে অন্তত: একটু পানি দাও । ইমামের এই আহবানের জবাবে একটি বিষাক্ত তীর এসে ইমামের হাতে বিদ্ধ হলো । তীরের ফলা ইমামের হাত ভেদ করে শিশু আলী আসগরের কন্ঠ এফোঁড় ওফোড় করে দিল । ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল । ইমাম সেই রক্তমাখা হাত আকাশের দিকে তুলে ফরিয়াদ জানালেন হে প্রভু তুমি এর বিচার কর । শিশুপুত্রকে মাটিতে রেখে ইমাম হোসেন চূড়ান্ত ফায়সালার জন্যে প্রস্তুত হলেন । তাবুতে অসুস্থ পুত্র জয়নুল আবেদীনের কাছে ইমামতের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে পরিবারের জন্য সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন ।
ইমাম হোসেন যুদ্ধের ময়দানে এসে মুর্খ সেনাদের উদ্দেশ্যে শেষবারের মতে আবারো উপদেশ দিতে চাইলেন । এজিদ বাহিনীকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, হে জনসাধারণ ! তোমরা কেন আমাকে হত্যা করতে চাও ? আমার কি অপরাধ ? শত্রুদের কাছ থেকে কোন উত্তর পেলেন না তিনি । শত্রু পরিবেষ্টিত ইমাম একাকী দাঁড়িয়ে আছেন । তীরের আঘাতে জর্জরিত তার দেহ থেকে রক্ত ঝরছে । তিনি আবার ডাক দিলেন, হাল মিন নাসেরিন ইয়ানসুরুনা ? আমাদের সাহায্য করার কেউ আছে কি ? কারো কাছ থেকে কোন উত্তর না পাওয়ায় ইমাম আবার বললেন, তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছোনা ? তোমাদের মধ্যে একজন মুসলমানও কি নেই । কিন্তু পাষাণ হৃদয়গুলোতে কোন ভাবান্তর হলো না । শত্রুবাহিনী তীর ছুড়ে তার জবাব দিল । শেরে খোদার সন্তান মহাবীর হোসেন স্থির থাকতে পারলেন না । আমার মৃত্যু ব্যতীত যদি মোহাম্মদের ধর্ম টিকে না থাকে তাহলে হে তরবারী আমাকে গ্রহণ কর । একথা বলে প্রচন্ড হুংকারে তিনি শত্রুদের দিকে ছুটে গেলেন । শেরে খোদার পুত্রকে রণমূর্তীতে দেখে এজিদ বাহিনী ভয়ে পিছু হটতে লাগল । ইমাম হোসেন প্রচন্ড বেগে তলোয়ার চালাতে চালাতে শত্রুদের দিক বিদিক ছত্রভঙ্গ করে দিলেন । তার তলোয়ারের প্রচন্ডতায় কেউ টিকতে পারছে না । শত্রু সেনারা পালিয়ে যাবার পথ পাচ্ছে না । ওমর সাদ, শিমার, সেনান, প্রমুখ দুরাচার পাপিষ্ঠরা সৈন্যদের উসকে দিতে লাগল একযোগে ইমামের উপর আঘাত হানতে । এদিকে তীরের আঘাতে জর্জরিত ইামামের দেহ থেকে প্রচুর রক্ত ক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে তার দেহ নিস্তেজ হয়ে আসছিল । তিনি আর তলোয়ার চালাতে পারছিলেন না । একসময় তিনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন । এ সময় পাপিষ্ঠরা চারদিক থেকে তার উপর আক্রমণ চালায় । ইমাম হোসেন তার বুক থেকে তীরের ফলা টেনে বের করে শেষবারের মত বিশ্ব প্রভুর দরবারে ফরিয়াদ জানালেন, হে আল্লাহ ! দেখ তোমার হোসেনের প্রতি এরা কেমন আচরণ করল । ওমর সাদের নির্দেশে এজিদের নিষ্ঠুর সৈনিকরা মহানবী (সঃ) এর দৌহিত্রের শির মোবারকও কেটে ফেলে । সেনান বা মতান্তরে শিমার জিলজওশান নামের নরাধম এই নিষ্ঠুরতম কাজটি করেছিল । ইমামের শির যখন কেটে বর্শার আগায় বিদ্ধ করা হয় তখনো ইমামের পবিত্র কন্ঠ দিয়ে উচ্চারিত হলো , আল্লাহু আকবার । এভাবে নিষ্ঠুরতার বিকট উল্লাসের মোকাবেলায় আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত মহাকালের পাতায় চির উজ্জল হয়ে থাকল । ইমাম হোসেন ও তার সাথীরা নতুন করে যেন স্থাপন করলেন লা ইলাহা কালেমার ভিত্তি ।
তারপরের ঘটনা আরো করুণ ও হৃদয়বিদারক । কারবালার শহীদদের পবিত্র দেহ থেকে শির ছিনড়ব করে নেয়া হয় এবং অশ্ববাহিনী ছুটিয়ে পবিত্র দেহগুলো দলিত মথিত করা হয় । এরপর এজিদের বর্বর সেনারা ইমাম পরিবারের মহিলাদের তাবু লুট করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয় । নবী বংশের অসহায় নারী ও শিশুরা আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে এবং বহু শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায় । ইতিহাসের করুণ ও ভয়াল রাত নেমে এলো । কারবালার আকাশ আজ রাতে রক্তিম আভায় আবৃত । ইতিহাসে এ রাত "শামে গারিবান" নামে পরিচিত । সত্যিই এর চেয়ে করুণ আর হৃদয়বিদারক আর কি হতে পারে ? ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম পরিবারের সদস্যরা অভিভাবকহীন অবস্থায় পোড়া তাবুগুলোর মধ্যে বসে শহীদদের স্মরনে কাঁদছিলেন,আহাজারী কোরছিলেন । রাসুলে খোদা তার জীবনের প্রতিদান হিসেবে চেয়েছিলেন মুসলিম উম্মত যেন তার বংশদল ও আহলে বাইতকে ভালোবাসে । অথচ তার আহলে বাইতের প্রতি মুসলিম নামধারীদের এ কি আচরণ ! একদিকে এজিদী সৈনিকদের অট্টহাসি আর শরাব পানের উন্মত্ততা আর অন্যদিকে মস্তকবিহীন শহীদদের পবিত্র লাশ ঘিরে নবী বংশের নারীদের বুকভাঙ্গা বিলাপ । এ রাতে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পাপীও দুফোটা অশ্র" না ফেলে পারে না । পরদিন এজিদের সৈন্যরা পৈশাচিক উল্লাসে আহলে বাইতের নারী ও শিশুদেরকে বেঁধে গলায় দড়ি লাগিয়ে খালি উটের পিঠে তুলে দেয় । ৭২জন শহীদের মস্তক বর্শার ফলায় বিদ্ধ করা হয় । নবী বংশের সম্মানিতা মহিলাদের পর্দা কেড়ে নেয়া হয় । কথিত আছে অসুস্থ ইমাম জয়নুল আবেদীনকে কাটাওয়ালা লোহার বেড়ি পরিয়ে দিয়ে খালি পায়ে টেনে হিঁচড়ে কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয় । এসময় মহিয়সী নারী যয়নাব এবং ইমাম জয়নুল আবেদীন ( আঃ) আশুরার এই বিপ-বের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন । কারবালার এই নিষ্ঠুর অত্যাচার অবিচারের কাহিনী জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেন । ইসলামের বিপ্লবী নায়িকা হযরত জয়নাব যদি না থাকতেন তাহলে কারবালার আত্মত্যাগের কাহিনী মানুষের কাছে অজানা থেকে যেত । সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসেন ইসলামী বিপ্লবের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন তার পরবর্তী আরাধ্য কাজ অঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন হযরত জয়নাব । হাল মিন নাসেরিন ইয়ানসুরনা । অর্থাৎ আমাদের সাহায্য করার কেউ আছে কি ? ইমাম হোসাইনের এই কালজয়ী আহবানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন হযরত জয়নাব । আজো সেই আহবান মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয় আশুরার বিপ্লব থেকে শিক্ষা নেয়ার, এবং ইসলামকে নতুন করে জানার ।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন