ইমাম আহমাদ হাম্বাল ও হাম্বালী ফিকাহ্
ইমাম আহমাদ হাম্বাল ও হাম্বালী ফিকাহ্
জীবন বৃত্তান্ত
আব্দুল্লাহ্ বিন মোহাম্মদ বিন হাম্বাল ইবনে হেলাল শাইবানি মারুযি, আরব বংশের শাইবান বিন যুহাল অথবা বনী যুহাল বিন শাইবান পরিবার থেকে ছিলেন। তিনি ১৬৪ হিঃ বরাবর ৭৮০ ইং সনে জন্ম গ্রহণ করেন। ইবনে হাম্বালের জীবন, অভাব ও দারিদ্র্যর মধ্যে কেটেছে এবং জীবিকা নিবার্হ করার জন্য তিনি বুননের কাজ করতেন। প্রথমে তিনি কোরান শিক্ষা গ্রহণ করেন, তারপর ফিকাহ্ শাস্ত্র অধ্যয়নে সময় ব্যয় করেন। অতপর লেখা লেখির কৌশলগত জ্ঞান অজর্নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
কিছু সময় তিনি আহ্লে রা’ইদের বই পুস্তক পড়তে মশগুল থাকেন। আহমাদ হাম্বাল হাদীসকে প্রমাণ করার বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতেন। কেননা হাদীসকে তিনি দ্বীনের মূল ও ভিত্তি মনে করতেন। তিনি ১৮৬ হিঃ বরাবর ৮০২ ইং সনে হাদীসের জ্ঞান অনুসন্ধানে বসরা, কুফা, হেজায, ইয়েমেন ও শাম সফর করেন।
শিক্ষকবৃন্দঃ
ইমাম আহ্মাদ হাম্বাল ওয়া’কি, ইয়াহ্ইয়া বিন আদাম, ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ ক্বাহ্তান ও ইয়াহ্ইয়া বিন মোঈন প্রমূখের কাছ থেকে প্রচুর হাদীস সংগ্রহ করেন। আবু হানিফার শিষ্য আবু ইউসুফ ও মিসামের সাহচর্যে থেকেও লাভবান হন। অবশ্য শাফেঈকেও তার শিক্ষকদের একজন হিসাবে মনে করা হয়।
ছাত্রবৃন্দঃ
আহ্মাদের ছাত্রবৃন্দ, যারা তাকে হাদীস বর্ণনাতে সাহায্য করত, তারা হচ্ছে: আবুল আব্বাস ইসতাখরি, আহমাদ বিন আবী খাইসামা, আবু য়া’লী মুসেলি, আবু বকর আসরাম, আবুল আব্বাস সা’লাব, আবু দাউদ সাজিসতানি ও ...
তিনি ২৪১ হিঃ বরাবর ৮৫৫ ইং বগদাদ শহরে মৃত্যু বরণ করেন।
হাম্বালী ফিক্বাহর বিশেষতঃ
এই মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা নিজেকে এমন ভাবে হাদীস সংগ্রহ করাতে ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পযার্লোচনায় মনোযোগী করলেন যে, জনাব তাবারির মত অনেকের মতে মূলতঃ তার আলাদা কোন ফিক্বাহ নেই। কিন্তু দাবী করা যেতে পারে যে, অন্যান্য মাযহাবের তুলনায় হাম্বালী ফিক্বাহ নামে স্বতন্ত্র ও আলাদা ফিক্বাহ আমাদের কাছে রয়েছে, যার আসল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নবী করিম (সা.) এর হাদীসসমূহে মনোযোগ ও গুরুত্ব দেয়া।
হাম্বালী ফিক্বাহর উৎসসমূহঃ
এই মাযহাব কোরান ও সুন্নাতকেই তাদের ফিক্বাহর মূল ভিত্তি হিসেবে মনে করে। এই ফেরকার মহান ব্যক্তিরা কোরান ও সুন্নাতের মধ্যে কোন পার্থক্যে বিশ্বাসী নন। আর যারা এই দুটোকে একটা অপরটার থেকে আলাদা মনে করেন আর একটার জন্য অন্যটাকে উৎসর্গ করেন তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন। এই ফিক্বাহ মতাদর্শের সধারণ বৈশিষ্ট্য হল, যে কোন ধরনের ইজতেহাদ ও রা’ইয়ের বিরোধীতা করা ও হাদীসকে নিরঙ্কুশ প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করা। সাহাবায়ে কেরাম ও ফক্বিহদের উক্তিও হাম্বালীদের নিকট হুজ্জত (প্রমাণ স্বরুপ) হতে পারে।
আরও কিছু বিষয় রয়েছে যাদের গুরুত্ব কোরান ও সুন্নাত ও সাহাবায়ে কেরাম ও ফক্বিহদের উক্তির তুলনায় কম কিন্তু ফিক্বাহতে এই বিষয়সমূহকে প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করা যেতে পারে এসব হচ্ছে: ক্বিয়াস, ইজমা, মসালেহে মুরসালা ও সদ্দে যারায়ে ইত্যাদি।
হাম্বালীরা যঈফ হাদীস সমূহের ব্যবহারকে সে সব জায়গায় জায়েজ মনে করেন যেখানে কোরান ও সুন্নাতের সাথে দ্বন্দ্ব না হয়। অন্য আরেক বৈশিষ্ট্য যা তাদের ফিক্বাহতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, তা হচ্ছে ইবাদত, কেনা - বেচা ও পবিত্রতার প্রতি কঠোরতা। এই কঠোরতার একটি উদাহরণ হল ওজুর মধ্যে কুলকুচা করা ও নাকে পানি দেওয়া হচ্ছে ওয়াজিব কাজ।
মুফতির শর্তসমূহ ও প্রয়োজনীয়তাঃ
তাদের অন্যান্য পার্থক্যের মধ্যে যা পছন্দনীয় কাজ মনে হয় তা হচ্ছে একজন মুফতি সম্পর্কে শর্তসমূহ ও তার সীমা নির্ধারণ করা। তার কয়েকটি নমুনা আমরা এখানে উল্লেখ করবোঃ
১। একজন মুফতিকে অবশ্যই জ্ঞানী, ধৈযর্শীল ও গাম্ভীর্য সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হতে হবে।
২। একজন মুফতির অবশ্যই খুলুস নিয়্যত বা একনিষ্ঠতা থাকতে হবে।
৩। তাকে অবশ্যই যুগের হাল - অবস্থা ও পরিস্থিতি ও তার শর্তাবলী ও জনগণের সাথে পরিপূর্ণ ওয়াকিফ হাল থাকতে হবে।
৪। কোরান ও সুন্নাত ও হাদীস সংক্রান্ত জ্ঞানে দক্ষ হতে হবে।
৫। ফতোওয়া দেওয়ার ব্যাপারে তাকে পযার্প্ত যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে যাতে করে জনগণ তার উপর বিক্ষুদ্ধ না হয়ে পরে।
হাম্বালী ফিক্বাহ, সামাজিক বিষয়েও বিশেষ মনোযোগ দেয় আর সে সম্পর্কে যথাযথ ফিক্বাহর হুকুম আহ্কামও জারি করে। যার কয়েকটি নমুনা নিম্নরূপঃ
- যদি কোন ব্যক্তি ফকির ও অসহায়দের জন্য কোন জমি ওয়াকফ করে, তার থেকে আয় - উপার্জনসমূহতে যাকাত ওয়াজিব নয়।
- যে সব আত্মীয়দের নাফাক্বা বা ভরণ - পোষণ যে ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তা হচ্ছে সমস্ত সামর্থহীন আত্মীয়, যাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয় এবং সব দুরের ও নিকট আত্মীয়দেরকে এরসের (মৌরুসী সম্পত্তি) অংশীদার করে দেয় সেটা জরায়ু সম্পর্কের হোক বা মূল বা শাখা প্রশাখাই হোক।
অধিকার প্রমাণ করার কারণসমূহ সম্পর্কে হাম্বলী ফিকাহ্র দৃষ্টিভঙ্গিঃ
১। ইক্বরার বা স্বীকারোক্তি সম্পর্কেঃ হাম্বালীরা বিশ্বাস করে যে, কোন বোবা ব্যক্তির পক্ষে শব্দ, লেখা বা ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে ইক্বরার বা স্বীকারোক্তি প্রহণযোগ্য হবে।
২। কসম সম্পর্কেঃ আমি যদি কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন কিছুর দাবী করি এবং আমার কথা প্রমাণ করার মত কোন দলীল বা যুক্তি না থাকে, কাযি বা বিচারক আমার বিপক্ষ লোককে সেই বিষয়ে কসম খাওয়ার জন্য বাধ্য করবে যে, তার বিরুদ্ধে সেই কথা ঠিক নয়।
৩। শাহাদাত বা সাক্ষ্যঃ হাম্বালীদের বিশ্বাস হচ্ছে যে, সাতটি বিষয়সমূহে সাক্ষ্যর প্রয়োজন হয় তা হচ্ছে ; জেনা বা ব্যভিচার ও লাওয়াতে (পুরুষের সাথে পুরুষের কুকর্ম) সাক্ষী, যা চারজন পুরুষের মাধ্যমে হয়। কোন ব্যক্তি যদি নিজের দারিদ্র্য হওয়ার দাবী করে, তবে তিনজনের সাক্ষী সাপেক্ষে তা কবুল করা হবে। কিছু কিছু হুদুদ বা শাস্তি যেমনঃ ক্বাযফ, মদ খাওয়া ও ডাকাতি বা লুটতরাজের জন্য দুই ব্যক্তির সাক্ষ্যর প্রয়োজন। নিকাহ্ (বিয়ে) ও তালাকের মত বিষয়ে দুইজন পুরুষ ব্যক্তির সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। কোন ব্যক্তিকে অথবা পশু ডাক্তারের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোন জীব জন্তুকে আহত ও জখম করার ব্যাপারে দুইজন সাক্ষী (পুরুষ) অথবা একজন পুরুষ ও দুইজন নারীর সাক্ষী গ্রহণ করা হবে। এমন কিছু বিষয়ে যার খবর পুরুষ ব্যক্তিরা রাখে না যেমনঃ মহীলাদের বিশেষ দোষ ত্রুটিসমূহতে একজন মহীলার সাক্ষী গ্রহণযোগ্য হবে।
৪। ক্বোর’আ বা লটারীঃ এই মাযহাবে ক্বোর’আ বা লটারীর অবস্থান হচ্ছে হুকুম করার মত এবং নিকাহ্ ও তালাক ও গোলামকে আযাদ করা ও মালামাল ও কয়েকজন স্ত্রীর মধ্যে শয্যা সঙ্গিনী ও তাদেরকে সঙ্গে করে ভ্রমণের জন্য এবং যেসব বিষয়ে ঝগড়া বিবাদ বা শত্রুতা সংঘটিত হয় এমন সব বিষয়ে আসে। ইসহাক্ব বিন ইব্রাহীম ও জাফার ইবনে মোহাম্মদের রেওয়ায়েতে আহমাদ হাম্বাল বলে ক্বোর’আ বা লটারী হচ্ছে যায়েজ।
দ্বীনি ও কালাম শাস্ত্রীয় আকায়েদ
যেহেতু ইমাম আহমাদ হাম্বাল ও তার সহযোগীরা হাদীসী তরিকার সমর্থক তাই তাদেরকে কালাম শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না এবং তাদেরকে কালাম শাস্ত্রীয় মশহুর ব্যক্তিবর্গও বলা চলে না। তাই আকাঈদের ব্যাপারে যা কিছু তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা কিতাব ও সুন্নাতের শিক্ষার অর্জন।
হাম্বালীরা সাধারণত ইর্জা তরিকাতে বিশ্বাসি। যেমনঃ তাক্ফিরের বিষয়ে তারা মুরজে’আদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। খোদার কালাম কোরানকে সৃষ্টিকৃত মনে করে না (গাইরে মাখলুক মনে করে) ঈমানের বিষয়ে কাউল ও আমলের (কথা ও কাজকে) শর্ত মনে করে। রুইয়্যাত বা খোদাকে দেখার বিষয় তাদের জন্য হক্ব কেননা সহীহ হাদীসে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
চার মাযহাবের মধ্যে আজ হাম্বালীর অনুসারীদের সংখ্যা খুবই কম। অবশ্য এই ফেরকার ওলামারা এমন ভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন যে, ওয়াহাবী ও সালাফীর চিন্তার যথাযথ বিকাশ ঘটছে এবং ওয়াহাবীর মত কিছু ফেরকা উৎস হিসেবে নিজেকে হাম্বালীর সাথে সম্পৃক্ত করছে।
সুত্রসমূহঃ
১। ফেক্বহে তাতবিক্বি, সাঈদ মানসুরি (আরানি)।
২। চাহার ইমামে আহ্লে সুন্নাত ওয়া জামাআত, রাউফ তাওয়াক্কুলি।
৩। তারিখে ফেরাক্বে ইসলামি, ১’ম খন্ড, ডাক্তার হোসেন সাবেরী।
৪। আল্ আয়েম্মাতুল আরবা’আ, ডাক্তার আহমাদ আশ্শারবাসি।
৫। তাহ্ক্বিক দার তারিখ ওয়া ফালসাফেয়ে মাযাহেবে আহলে সুন্নাত, ইয়ুসুফে ফাযাঈ।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন