মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ

মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ
কার্যকারণ নীতি সৃষ্টিজগতকে ব্যতিক্রমহীনভাবে শাসন করছে। এ সৃষ্টিজগতের সর্বত্রই এ নীতি বলবত রয়েছে। কার্য-কারণ নীতি অনুসারী এ বিশ্বের সকল কিছুই তার সৃষ্টির ব্যাপারে এক বা একাধিক কারণ বা শর্তের উপর নির্ভরশীল। আর ঐসব কারণ বা শর্ত সমূহ (পুর্ণাঙ্গ কারণ) বাস্তবায়নের পর সংশ্লিষ্ট বস্তুর বাস্তব রূপ লাভ (ফলাফল) অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। আর তার প্রয়োজনীয় কারণ বা শর্ত সমূহের সবগুলো বা তার কিছু অংশের অভাব ঘটলে সংশ্লিষ্ট বস্তুর সৃষ্টি লাভ অসম্ভব হয়ে পড়ে।

উপরোক্ত বিষয়ের বিস্তারিত বিশেষণের মাধ্যমে নিম্নোক্ত দু’টো বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ঃ১. যদি আমরা কোন একটি সৃষ্টি বস্তুকে (ফলাফল) তার সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ কারণ সমূহের সাথে আনুপাতিক তুলনা করি, তাহলে ঐ সৃষ্ট বস্তুর (ফলাফল) অস্তিত্ব এবং তার কারণ সমূহের (পূর্ণাঙ্গ) অনুপাত হবে অপরিহার্য তা কিন্তু আমরা যদি ঐ সৃষ্টি বস্তুকে তার সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ কারণের সাথে তুলনা না করে বরং তার আংশিক কারণের সাথে তুলনা করি, তাহলে সেক্ষেত্রে ঐ সৃষ্ট বস্তুর অস্তিত্ব (ফলাফল) আর তার আংশিক কারণের অনুপাত হবে সম্ভাব্যতা। কেননা, অসম্পূর্ণ বা আংশিক কারণ তার ফলাফল সংঘটনের ক্ষেত্রে শুধু সম্ভাব্যতাই দান করে মাত্র, অপরিহার্যতা নয়। সুতরাং এ সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুই তার সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ কারণের উপর আবশ্যিকভাবে নির্ভরশীল। এই আবশ্যিকতা ও বাধ্যবাধকতা সৃষ্টিজগতের সর্বত্রই ক্ষমতাসীন। আর এর কাঠামো এক ধরণের আনুক্রমিক ও আবশ্যিক গুণক সমূহের দ্বারা সুসজ্জিত। তথাপি প্রতিটি সৃষ্ট বস্তুর (যা তার সৃষ্টির আংশিক কারণের সাথে সম্পর্কিত) মধ্যে তার সৃষ্টির সম্ভাব্যতার বৈশিষ্ট্য সংরক্ষিত থাকবে। পবিত্র কুরআনে এই আবশ্যিক নীতিকে ‘ক্বাযা‌ বা ‘ঐশী ভাগ্য’ হিসেবে নামকরণ করেছে। কেননা, এই আবশ্যিকতা স্বয়ং অস্তিত্ব দানকারী স্রষ্টা থেকেই উতসারিত। এ কারণেই ভাগ্য এক অবশ্যম্ভাবী ও অপরিবর্তনশীল বিষয়। যার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম বা পক্ষপাত দুষ্টতা কখনোই ঘটার নয়। মহান আল্লাহ্‌‌ পবিত্র কুরআনে বলেন: “(জেনে রাখ) সৃষ্টি ও আদেশ দানের অধিকার তো তাঁরই” (সুরা আল্‌ আ’রাফ, ৫৪ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ বলেন ঃ “যখন তিনি কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন হও, আর তা হয়ে যায়” (সুরা আল্‌ বাকারা, ১১৭ নং আয়াত।)মহান আল্লাহ্‌‌ আরও বলেন ঃ “আর আল্লাহ্‌‌ই আদেশ করেন যা বাধা দেয়ার (ক্ষমতা) কারো নেই” (সুরা আর্‌ রা’দ, ৪১ নং আয়াত।)২। পূর্ণাঙ্গ কারণের প্রতিটি অংশই তার নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী বিশেষ মাত্রা ও প্রকৃতি দান করে। আর এভাবেই সম্মিলিত কারণ সমূহের (পূর্ণাঙ্গ কারণ) প্রদত্ত মাত্রা ও প্রকৃতি অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ কারণ নির্দেশিত পরিমাণ অনুযায়ী কারণ সমূহ (পুর্ণাঙ্গ কারণ) প্রদত্ত মাত্রা ও প্রকৃতির সমষ্টিই এই অনুকুল ফলাফল (সৃষ্টবস্তু)। যেমনঃ যেসব কারণ মানুষের শ্বাসক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা শুধুমাত্র নিরংকুশ শ্বাসক্রিয়ারই সৃষ্টি করে না। বরং তা মুখ ও নাকের পার্শ্বস্থ নির্দিষ্ট পরিমাণ বায়ুকে নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার শ্বাসনালী দিয়ে ফুসফুস যন্ত্রে পাঠায়। একইভাবে যে সমস্ত কারণঃ মানুষের দৃষ্টিশক্তি দান করে, তা কোন শর্ত বা কারণবিহীন দৃষ্টিশক্তির জন্ম দেয় না, বরং একটি নিদিষ্ট নিয়মে ও পরিমাণে ঐ দৃষ্টিশক্তির সৃষ্টি করে। এ জাতীয় বাস্তবতা সৃষ্টিজগতের সকল সৃষ্টিনিচয় ও তাতে সংঘটিত সকল কর্মকান্ডেই বিরাজমান, যার কোন ব্যতিক্রম নেই। পবিত্র কুরআনে এ সত্যটিকে ‘কাদ্‌র’ বা ভাগ্য হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আর সকল সৃষ্টির উৎস মহান আল্লাহ্‌র প্রতি এ বিষয়টিকে আরোপিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কুরআনে বলেন ঃ “আমি প্রতিটি বস্তুকেই তার (নির্দিষ্ট) পরিমাণে সৃষ্টি করেছি”। (সুরা আল্‌ কামার, ৪৯ নং আয়াত।) অন্যত্র মহান আল্লাহ্‌‌ বলেছেন ঃ “আমারই নিকট রয়েছে প্রত্যেক বস্তুর ভান্ডার এবং আমি তা পরিজ্ঞাত পরিমাণেই সরাবরাহ করে থাকি”। [ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদিক (আ.) বলেনঃ “মহান আল্লাহ্‌ যখন কোন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি তা নির্ধারণ করেন। নির্ধারণের পর তিনি তা মানুষের জন্যে ভাগ্যে পরিণত করেন। এরপর তা তিনি বাস্তবায়ন করেন।” (বিহারূল আনোয়ার , ৩য় খন্ড, ৩৪ নং পৃষ্ঠা)] (সুরা আল্‌ হাজার, ২১ নং আয়াত।) একারণেই মহান আল্লাহ্‌র নির্ধারিত ভাগ্য অনুযায়ী যে কোন কাজ বা ঘটনারই উদ্ভব ঘটুক না কেন, তার সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এভাবে আল্লাহ্‌র নির্ধারিত ভাগ্য অনুযায়ী যা কিছু সৃষ্টি বা সংঘটিত হোক না কেন, তা অবশ্যই আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিশেষ পরিমাণ ও মাত্রা অনুযায়ীই হবে। এব্যাপারে সামান্য তম ব্যতিক্রমও কখনো ঘটবে না।
মানুষ ও স্বাধীনতা
মানুষ যে সকল কাজ সম্পাদন করে, এ সৃষ্টি জগতের অন্যসব সৃষ্টির ন্যায় তাও এক সৃষ্টি। তার সংঘটন প্রক্রিয়া ও এজগতের অন্য সকল সৃষ্টির মতই পূর্ণাঙ্গ কারণ সংঘটিত হওয়ার উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। কারণ, মানুষও এসৃষ্টি জগতেরই অংশ স্বরূপ। এ জগতের অন্য সকল সৃষ্টির সাথেই তার নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই তার সম্পাদিত ক্রিয়ায় সৃষ্টির অন্য সকল অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে মনে করা যাবে না। যেমন ঃ মানুষের একমুঠো ভাত খাওয়ার কথাই চিন্তা করে দেখা যাক। এ সামান্য কাজের মধ্যে আমাদের হাত, মুখ, দৈহিক শক্তি, বুদ্ধি, ইচ্ছা সবই ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ভাতের অস্তিত্ব ও তা হাতের নাগালে থাকা, তা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন বাধা বিঘ্নের অস্তিত্ব না থাকাসহ স্থান-কাল সংক্রান্ত অন্যান্য শর্তের উপস্থিতির প্রয়োজন। ঐসব শর্ত বা কারণের একটিও যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে ঐ কাজ সাধ্যের বাইরে চলে যায়। আর ঐ সকল শর্ত বা (পূর্ণাঙ্গ কারণের উপস্থিতি) কারণ সমূহের উপস্থিতির ফলে সংশিষ্ট কাজটির সম্পাদন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। পূর্বে যেমনটি আলোচিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ কারণের উপস্থিতির ফলে সংশ্লিষ্ট ক্রিয়ার সংঘটন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। তেমনি কোন ক্রিয়া মানুষের দ্বারা সম্পাদিত হওয়ার সময়, মানুষ যেহেতু পূর্ণাঙ্গ কারণের একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত, তাই মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্রিয়ার সম্পর্ক হচ্ছে ‘সম্ভাব্যতার’ সম্পর্ক। (কারণ মানুষ একাই পূর্ণাঙ্গ কারণ নয়। বরং মানুষও ঐ ক্রিয়ার অন্যান্য অপূর্ণাঙ্গ কারণগুলোর মতই একটি আংশিক কারণ মাত্র।) কোন ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা রয়েছে। ঐ ক্রিয়ার সাথে সামগ্রিক (পূর্ণাঙ্গ কারণ) কারণের সম্পর্ক হচ্ছে ‘অপরিহার্যতার’ (অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ কারণ ঘটলেই এ ক্রিয়ার সংঘটিত হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে) সম্পর্ক।কিন্তু মানুষ নিজে যেহেতু একটি অপূর্ণাঙ্গ বা আংশিক কারণ, তাই তার সাথে ক্রিয়ার সম্পর্ক অবশ্যই ‘অপরিহার্যতা মূলক’ হবে না। মানুষের সহজ-সরল নিষ্পাপ উপলব্ধিও উপরোক্ত বিষয়টিকে সর্মথন করবে। কারণ, আমরা দেখতে পাই যে, মানুষ সাধারণতঃ খাওয়া পান করা, যাওয়া আসাসহ ইত্যাদি কাজের সাথে সুস্থতা, ব্যাধি, সুন্দর হওয়া বা কুশ্রী হওয়া, লম্বা হওয়া বা খাটো হওয়া ইত্যাদির মত বিষয়গুলোকে এক দৃষ্টিতে দেখে না। প্রথম শ্রেণীর কাজগুলো মানুষের ইচ্ছার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। ঐসব কাজ করা বা না করার ব্যাপারে তার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। ঐ ধরণের কাজ সম্পাদনের ব্যাপারে মানুষ আদেশ, নিষেধ, প্রশংসা বা তিরস্কারের সম্মুখীন হয়। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর (সুন্দর বা কুশ্রী হওয়া, লম্বা বা খাটো হওয়া) কাজ বা বিষয়গুলোর ব্যাপারে মানুষের আদৌ কোন দায়িত্ব নেই। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের’ মধ্যে মানুষের সম্পাদিত কাজের ব্যাপারে দু’টো বিখ্যাত মতাবলম্বি দলের অস্তিত্ব ছিল। তাদের একটি দলের বিশ্বাস অনুসারে মানুষের সম্পাদিত কাজসমূহ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ মানুষ তার কাজকর্মের ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে পরাধীন। তাদের মতে মানুষের ইচ্ছা ও স্বাধীনতার কোন মূল্যই নেই। আর দ্বিতীয় দলটির মতে মানুষ তার কাজের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কাজের সাথে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। তাদের দৃষ্টিতে মানুষ আল্লাহ্‌‌ নির্ধারিত ভাগ্য সংক্রান্ত নিয়মনীতি থেকে মুক্ত। কিন্তু আহলে বাইতগণের (আ.) শিক্ষানুযায়ী (যাদের শিক্ষা পবিত্র কুরআনের শিক্ষারই অনুরূপ) মানুষ তার কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। তবে এক্ষেত্রে সে সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্বের অধিকারী নয়। বরং মহান আল্লাহ্‌‌ আপন স্বাধীনতার মাধ্যমে ঐ কাজটি সম্পাদন করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ মানুষের কাজ নির্বাচন করার স্বাধীনতা অন্যান্য অপূর্ণাঙ্গ কারণসমূহের মতই একটি আংশিক কারণ মাত্র। তাই কারণের পূর্ণতা অর্জন মাত্রই তা বাস্তবায়নের ‘অপরিহার্যতা’ আল্লাহ্‌‌ই প্রদান করেছেন এবং তা আল্লাহ্‌ ইচ্ছারই প্রতিফলন। তাই এর ফলে আল্লাহ্‌র এ ধরণের ইচ্ছা, ‘অপরিহার্য’ ক্রিয়াস্বরূপ আর মানুষও ঐ ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষেত্রে স্বাধীন বটে। অর্থাৎ ঐ ক্রিয়া সম্পাদিত হওয়ার ক্ষেত্রে তার সামগ্রিক (পূর্ণাঙ্গ) কারণ সমূহের মোকাবিলায় ক্রিয়ার বাস্তবায়ন অপরিহার্য। আর মানুষের কার্যনির্বাচন বা সম্পাদনের স্বাধীনতা তার কার্য সম্পাদনের অসংখ্য অসম্পূর্ণ কারণগুলোর মত একটি আংশিক কারণ মাত্র। তাই তার ঐ স্বাধীনতা (যা পূর্ণাঙ্গ কারণের একটি অংশ মাত্র) পেক্ষাপটে ঐ কাজটি ঐচ্ছিক ও সম্ভাব্য (অপরিহার্য নয়) একটি বিষয় মাত্র।ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন ঃ “মানুষ তার কাজে সম্পূর্ণ পরাধীনও নয় আবার সম্পূর্ণ সার্বভৌমও নয়। বরং এ ক্ষেত্রে মানুষ এ দু’য়ের মাঝামাঝিই অবস্থান করছে”। [হযরত ইমাম যাফর সাদিক (আ.) বলেনঃ “মহান আল্লাহ্‌ তার সৃষ্টির প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। তাই তাদেরকে পাপ কাজে লিপ্ত হতে তিনি কখনোই বাধ্য করেন না, যাতে তারা পাপ জনিত কঠিন শাস্তিভোগ না করে। মহান আল্লাহ্‌র শক্তি ও ক্ষমতা এর চাইতে অনেক উর্ধ্বে যে, তিনি কিছু ইচ্ছা করবেন, আর তা বাস্তবায়িত হবে না”। (বিহারূল আনোয়ার, ৩য় খন্ড, ৫ ও ৬ নং পৃষ্ঠা।)হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) আরও বলেন ঃ “মানুষের ক্ষমতার বাইরে কোন দায়িত্ব তার উপর চাপিয়ে দেয়ার চেয়ে আল্লাহ্‌র উদারতা অনেক বেশী। মহান আল্লাহ্‌ এতই পরাক্রমশালী যে, তাঁর রাজত্বে তাঁর ইচ্ছে বিরোধী কোন কিছু ঘটার বিষয়টিই কল্পনাতীত”। (বিহারূল আনোয়ার, ৩য় খন্ড, ১৫ নং পৃষ্ঠা।)]
লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যগণ হেদায়েত
যদি একটি ধানের বীজ উপযুক্ত পরিবেশে মাটির বুকে পোঁতা হয়, তাহলে তাতে দ্রুত অংকুরোদ্‌গম ঘটে ও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন ঐ অংকুরটি প্রতি মূহুর্তেই একেকটি নতুন অবস্থা ধারণ করতে থাকে। এভাবে প্রকৃতি নির্ধারিত একটি সুশৃংঙ্খল পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পথ অতিক্রম করে তা একটি পূর্ণাঙ্গ ধান গাছে রূপান্তরিত হয়, যার মধ্যে নতুন ধানের শীষ শোভা পেতে থাকে। এখন আবার যদি ঐ ধানের শীষ থেকে একটি ধানের বীজ মাটিতে পড়ে, তাহলে তাও পুনরায় পূর্ব বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী ঐ নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করে অবশেষে তা একটি পূর্ণাঙ্গ ধান গাছে রূপান্তরিত হবে। একটি ফলের বীজ যদি মাটির বুকে প্রবেশ করে, তাহলে এক সময় তার আবরণ ভেদ করে সবুজ ও কচি অংকুর বের হয়। এরপর ঐ কচি অংকুরটিও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় এবং সুনির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করার পর একটি পূর্ণাঙ্গ ও ফলবান বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়। প্রাণীজ শুক্রানু যদি ডিম্বানু বা মাতৃগর্ভে স্থাপিত হয়, তাহলে তা দ্রুত বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। এরপর তা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট পরিবেশে এবং নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্তের পর তার পূর্ণবিকাশ ঘটে এবং তা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়। উক্ত সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও পথ অতিক্রমের নির্দিষ্ট একটি পরিণতিতে উন্নীত হওয়ার এই নিয়ম নীতি এ সৃষ্টিজগত ও প্রকৃতির সর্বত্রই বিরাজমান। ধানের বীজ বিকশিত হয়ে কখনোই একটি গরু বা ছাগল বা ভেড়ায় রূপান্তরিত হয় না। তেমনি প্রাণীর বীর্য্য সমগোত্রীয় প্রাণীর গর্ভে স্থাপিত হয়ে কখনোই তা ধান বা ফল গাছে পরিণত হবে না। এমনকি ঐ গাছ বা প্রাণীর গর্ভ ধারণ ক্রিয়ায় যদি ত্রুটিও থেকে থাকে, তাহলে দৈহিক ত্রুটিসম্পন্ন গাছ বা প্রাণীর জন্ম হতে পারে কিন্তু তার ফলে বিষম গোত্রীয় প্রাণী বা উদ্ভিদের জন্ম লাভ ঘটবে না।এ প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু, উদ্ভিদ বা প্রাণীর মধ্যেই একটি সুশৃংখল ও সুনির্দিষ্ট বিকাশ প্রক্রিয়ার নিয়মনীতি নিহিত রয়েছে। এ জগতের প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে সুপ্ত বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট বিকাশ প্রক্রিয়া ও তার নিয়মনীতির অস্তিত্ব এক অনস্বিকার্য ও বাস্তব সত্য। উল্লেখিত সুত্র থেকে দু’টো বিষয় আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেগুলো নিম্নরূপঃ ১। জগতের প্রতিটি সৃষ্টিই তার জন্মের পর থেকে শেষ পর্যন্ত বিকাশ লাভের যে স্তরগুলো অতিক্রম করে, সেগুলোর মধ্যে অবশ্যই একটি গভীর ও সুশৃংখল সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। যারফলে বিকাশ লাভের প্রতিটি স্তর অতিক্রমের পর তা তার পরবর্তী স্তরের দিকে অগ্রগামী হয়।২। বিকাশের এ স্তরগুলোর মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক সংযোগ ও সুশংখল সম্পর্কের কারণেই তার সর্বশেষ স্তরে উপনীত হওয়ার পর ঐ নির্দিষ্ট উদ্ভিদ বা প্রাণীর পূর্ণাঙ্গরূপই লাভ করতে দেখা যায়। আর এ নীতির বৈপরীত্য সৃষ্টি জগতে বা প্রকৃতির কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। যেমনঃ পূর্বেই বলা হয়েছে ধানের বীজ বিকশিত হয়ে কোন প্রাণীতে পরিণত হয় না। তেমনি নির্দিষ্ট কোন প্রাণীর বীর্য্য বিকশিত হয়ে কোন উদ্ভিদ বা অন্য কোন প্রাণীর জন্ম দেয় না। প্রকৃতির সর্বত্রই সকল প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রত্যেকেই তার সুনির্দিষ্ট বিকাশ প্রক্রিয়ায় তার গোত্রীয় স্বকীয়তা বজায় রাখে। পবিত্র কুরআনে, প্রকৃতিতে বিরাজমান এই সুশৃংখল নীতির পরিচালক হিসেবে মহান আল্লাহ্‌‌কেই পরিচিত করানো হয়েছে। তিনি এ প্রকৃতির একমাত্র ও নিরংকুশ প্রতিপালক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ঃ “যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথ নির্দেশনা দিয়েছেন।” (সুরা আত্‌ ‘ত্বা’‘হা’ ৫০ নং আয়াত।) পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে ঃ “যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন এবং যিনি সুপরিমিত করেছেন এবং পথ প্রর্দশন করেছেন।” (সুরা আল আ’লা, ২ ও ৩ নং আয়াত।) মহান আল্লাহ্‌‌ এর ফলাফল স্বরূপ বলেন ঃ “প্রতিটি জিনিসেরই একটি লক্ষ্য রয়েছে, যে (দিকে) লক্ষ্য পানে সে অগ্রসর হয়।” (সুরা আল বাকারা, ১৪৮ নং আয়াত।) “আমরা নভো-মন্ডল ও ভূমডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ক্রীড়াচ্ছলে (লক্ষ্যহীন ভাবে) সৃষ্টি করিনি; আমরা এ গুলোকে যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি (প্রত্যেকটি বস্তুর মধ্যে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে) করেছি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বোঝে না।” (সুরা আদ্‌ দুখান ৩৯ নং আয়াত।) বিশেষ হেদায়েতএটা একটা সর্বজনবিদিত ব্যাপার যে, মানব জাতিও এ সকল সাধারণ ও সার্বজনীন নীতি থেকে মুক্ত নয়। সৃষ্টিগত ঐশী নির্দেশনা নীতি যা সমগ্র সৃষ্টিজগতের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে আছে, তা মানুষের উপরও প্রভুত্ব বিস্তার করবে। যেমন করে এ বিশ্বের প্রতিটি অস্তিত্ব তার সর্বস্ব দিয়ে পূর্ণত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথে অগ্রগামী হয় এবং নির্ধারিত পথও প্রাপ্ত হয়। একইভাবে মানুষও ঐ প্রাকৃতিক ঐশী পথ নির্দেশনার মাধ্যমে প্রকৃত পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের পথে পরিচালিত হয়। একই সাথে উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের সাথে মানুষের যেমন অসংখ্য সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি অসংখ্য বৈসাদৃশ্যও তার রয়েছে। ঐ সব বৈসাদৃশ্য মূলক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই মানুষকে অন্য সকল উদ্ভিদ বা প্রাণী থেকে পৃথক করা যায়। বুদ্ধিমত্তাই মানুষকে চিন্তা করার ক্ষমতা দান করেছে। আর এর মাধ্যমেই মানুষ তার নিজের স্বার্থে মহাশূন্য মহাসাগরের গভীর তলদেশকেও জয় করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষ এই ভূপৃষ্ঠের সকল বস্তু প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের উপর তার প্রভুত্ব বিস্তার করে, তাকে নিজ সেবায় নিয়োজিত করতে সমর্থ হয়েছে। এমনকি যতদুর সম্ভব, মানুষ তার স্বজাতির কাছ থেকেও কম বেশী লাভবান হয়।মানুষ তার প্রাথমিক স্বভাব অনুযায়ী নিরংকুশ স্বাধীনতা অর্জনের মাঝেই তার বিশ্বাসগত সৌভাগ্য এবং পূর্ণত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত রয়েছে বলে মনে করে। কিন্তু মানুষের অস্তিত্বের গঠন প্রকৃতিই সামাজিক সংগঠন সদৃশ।মানব জীবনে অসংখ্য প্রয়োজন রয়েছে। এককভাবে ঐসব প্রয়োজন মেটানো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। একমাত্র পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সামাজিক ভাবেই এই মানব জীবনের ঐসব অভাব মেটানো সম্ভব। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে মানুষ তার স্বজাতীয় স্বাধীনতাকামী ও আত্মঅহংকারী মানুষের সহযোগিতা গ্রহণে বাধ্য। এর ফলে মানুষ তার স্বাধীনতার কিয়দংশ এ পথে হারাতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে মানুষ অন্যদের কাছ থেকে যতটুকু পরিমাণ লাভবান হয়, তার মোকাবিলায় সমপরিমাণ লাভ তাকে পরিশোধ করতে হয়। অন্যদের কষ্ট থেকে সে যতদুর লাভবান হয়, অন্যদের লাভবান করার জন্য ঐ পরিমাণ কষ্টও তাকে সহ্য করতে হয়। অর্থাত পারস্পরিক সামাজিক সহযোগিতা গ্রহণ ও প্রদানে মানুষ বাধ্য। নবজাতক ও শিশুদের আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই এ সত্যের মর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। নবজাতক শিশু শুধুমাত্র কান্না এবং জিদ্‌ ছাড়া নিজের চাহিদা পূরণের জন্য আর অন্য কোন পন্থার আশ্রয় নেয় না। কোন নিয়ম-কানুনই তারা মানতে চায় না। কিন্তু শিশুর বয়স যতই বাড়তে থাকে ততই তার চিন্তা শক্তির বিকাশ ঘটতে থাকে। এর ফলে ক্রমেই সে বুঝতে শেখে যে, শুধুমাত্র জিদ ও অবাধ্যতা এবং গায়ের জোর খাটিয়ে জীবন চালানো সম্ভব নয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্রমেই সে সমাজের লোকজনের সংস্পর্শে আসে। এরপর ধীরে ধীরে ক্রমবিকাশের মাধ্যমে সে পূর্ণাঙ্গ এক সামাজিক বিশ্বাসত্বে রূপান্তরিত হয় এবং এভাবে সে সামাজিক আইন-কানুনের পরিবেশের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সমাজ মেনে নেয়ার পাশাপাশি মানুষ আইনের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে। যে আইন সমগ্র সমাজকে শাসন করবে, এবং সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিতে দায়িত্বও নির্ধারণ করবে। সেখানে আইন লংঘনকারীর শাস্তিও নির্দিষ্ট থাকবে। উক্ত আইন সমাজে প্রচলিত হওয়ার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিই সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। সত ব্যক্তি তার প্রাপ্য হিসেবে উপযুক্ত সামাজিক সম্মানের অধিকারী হবে। আর এটাই সেই সার্বজনীন আইন, যা সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত মানব জাতি যার আকাংখী ও অনুরাগী হয়ে আছে। মানব জাতি চিরদিন তার ঐ কাংখিত সামাজিক আইনকে তার হৃদয়ের আশা-আকাংখার শীর্ষে স্থান দিয়ে এসেছে। আর তাই মানুষ সব সময়ই তার ঐ কাংখিত আইন প্রতিষ্ঠার জন্যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তাই এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ঐ কাংখিত আইন প্রতিষ্ঠা যদি অবাস্তব হত, এবং মানব জাতির ভাগ্যে যদি তা লেখা না থাকতো, তাহলে চিরদিন তা মানব জাতির কাংখিত বস্ত হয়ে থাকতো না। [এ জগতের সবচেয়ে কম বুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষটিও তার প্রকৃতিজাত স্বভাবের দ্বারা একজন আইন প্রণেতার প্রয়োজন অনুভব করে। যার ফলে এ বিশ্বের সকল প্রাণীই নির্বিঘ্নে শান্তি ও সৌহার্দের মাঝে নিরাপদ জীবন-যাপন করতে পারে। দর্শনের দৃষ্টিতে চাওয়া, আগ্রহ ও ইচ্ছা পোষণ করা এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা অতিরিক্ত ও পরস্পর সম্পর্কমূলক। অর্থাৎ এধরণের বৈশিষ্ট্য প্রান্তের সাথে সম্পর্কিত। এক কথায় ঐ বৈশিষ্ট্য দু’টো প্রান্তের মধ্যে অবস্থিত। যেমনঃ ঐ বৈশিষ্ট্য (কামনা), কামনাকারী ও কাংখিতবস্তু, এ দু’প্রান্তদ্বয়ের মাঝে বিদ্যমান। তাই এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে কাংখিতবস্তু অর্জন যদি অসম্ভব হয়, তাহলে তার আকাংখা অর্থহীন হয়ে পড়ে। অবশেষে সবাই এ ধরণের বিষয়ের (আর্দশ আইন) অভাব বা ত্রুটি উপলব্ধি করে। আর পূর্ণতাও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন যদি অসম্ভবই হত, তাহলে অপূর্ণতা বা ত্রুটির অস্তিত্বও অর্থহীন হয়ে পড়ত।]মহান আল্লাহ্‌ এই পবিত্র কুরআনে মানব সমাজের এই সত্যতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেনঃ ‘‘আমরাই তাদের মধ্যে জীবিকা বন্টন করি তাদের পার্থিব জীবনে এবং এক জনকে অন্যের উপর মর্যাদায় উন্নিত করি, যাতে একে অন্যের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে।’’ [যেমন ঃ একজন ঠিকাদার তার শ্রমিককে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য করতলগত করে। একজন নেতা তার অনুসারীদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। ভাড়াটে অর্থের বিনিময়ে মালিকের সত্ত্ব ভোগ করার মাধ্যমে তার উপর কর্তৃত্ব লাভ করে। একজন ক্রেতা বিক্রেতার স্বত্বের উপর অধিকার লাভ করে। এ ভাবে মানুষ বিভিন্নভাবে পরস্পরের উপর প্রভুত্ব বা শাসন ক্ষমতা বিস্তার করে। (-সুরা আয্‌ যুখরূফ, ৩২ নং আয়াত।)]মানুষের আত্ম-অহমিকা ও স্বার্থপরতার ব্যাপারে মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কুরআনে বলেছেন ঃ “মানুষতো অতিশয় অস্তিরচিত্ত রূপে সৃষ্টি হয়েছে। যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে, তখন সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয় অতিশয় কৃপণ।” (সুরা আল্‌ মাআ’রিজ, ২১ নং আয়াত।)

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন