ইমাম আলি (আ.) এর সন্তানদের নামকরণের রহস্য
ইমাম আলি (আ.) এর সন্তানদের নামকরণের রহস্য
এস, এ, এ
অনেকের মনে প্রশ্নের সঞ্চার হতে পারে যে, যদি রাজনৈতিকভাবে হজরত আলি (আ.) এর সাথে বিভিন্ন ব্যাক্তিদের মতানৈক্য ছিল তাহলে কেন তিনি উক্ত ব্যাক্তিদের নামে নিজেদের সন্তানদের নামকরণ করেছিলেন?
উক্ত বিষয়টি জানতে হলে আগে আমাদের একটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। আর তা হচ্ছে সত্যিই কি ইমাম (আ.) তার সন্তানদের নাম হজরত আবু বকর, উমর এবং উসমানের নাম অনুযায়ি নামকরণ করেছিলেন? নাকি অন্য কোন কারণও উক্ত নামকরণের মূলে নিহিত ছিল? আসুন জেনে নেই নামকরণের আসল কারণটি কি ছিল?
আবু বকর নামকরণ:
১- যদি ইমাম আলি (আ.)এর কোন সন্তানের নাম আবু বকর হতো তাহলে তিনি তার আসল নাম “আব্দুল কাবা বা আতিক” রাখতেন না। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, হজরত আলি (আ.) এর উক্ত সন্তানটির আসল নাম আবু বকর ছিল না।
২- আবু বকর ছিল হজরত আলি (আ.) এর সন্তানের উপনাম। আর উপনাম নির্বাচনের অধিকার সন্তানের রয়েছে। যা সে স্বিয় জিবনের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজের নামকরণ করতে পারে।
৩- ইমাম আলি (আ.) তাঁর উক্ত সন্তানের নাম রেখেছিলেন আব্দুল্লাহ। আর কারবালাতে যখন আব্দুল্লাহ শাহাদত বরণ করে তখনতার বয়স ছিল ২৫ বছর।
আবুল ফারাজে ইস্ফাহানি লিখেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আলি ইবনে আবি তালিব কারবালাতে ২৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন এবং তার কোন সন্তান ছিল না। (মাকাতেলুত তালেবিন, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২২)
উমর নামকরণ:
১- হজরত উমরের একটি অভ্যাস ছিল নাম পরিবর্তন করা। ঐতিহাসিকদের বর্ণনামতে হজরত উমর হজরত আলি (আ.) এর উক্ত সন্তানের নাম পরিবর্তন করে উমর রাখে এবং পরে সে উক্ত নামেই ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে।
বালাজুরি তার “ইনসাবুল আশরাফ” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হজরত উমর হজরত আলি (আ.) এর উক্ত সন্তানের নাম নিজের নাম অনুযায়ি নামকরণ করে। (ইনসাবুল আশরাফ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৯৭)
যাহাবি তার “সিরা আলামিন নোবালা” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আলি (আ.) এর উক্ত সন্তানটি যখন জন্মগ্রহণ করে তখন হজরত উমর তার নাম নিজের নামের অনুকরণ করে নামকরণ করে। (সিরা আলামিন নোবালা, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৩৪)
এছাড়াও ইতিহাসে একাধিক প্রমাণ রয়েছে যে, হজরত উমর অন্যান্যদের নামকে পরিবর্তন করেছে। নিন্মে যাদের নামকে তিনি পরিবর্তন করেছিলেন তাদের প্রকৃত নামকে উল্লেখ করা হলো:
১- ইব্রাহিম বিন হারেস
ইব্রাহিমের পিতা তার নাম ইব্রাহিম রেখেছিল কিন্তু হজরত উমর তার নামকে পরিবর্তন করে রাখে আব্দুর রহমান। (আল এসাবা ফি তামিযিল সাহাবা, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৯)
২- আজদাআ বিন মালিক
আজদাআ-এর পিতা তার নাম রেখেছিল আজদাআ কিন্তু হজরত উমর তা পরিবর্তন করে রেখেছিলেন আব্দুর রহমান। (আল এসাবা ফি তামিযিল সাহাবা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮৬)
৩- সাআলাবা বিন সাআদ
সাআলাবার নাম পরিবর্তন করে হজরত উমর তার নাম রাখে মোআল্লা। (আল ইনসাব, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৫০)
এছাড়াও ইবনে হাজার তার গ্রন্থ এসাবা নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হজরত উমর প্রায় ২১ জন সাহাবির নামকে পরিবর্তন করেছিলেন। নিন্মে রাসুল (সা.)এর উক্ত সাহাবিদের নাম উল্লেখ করা হলো:
১- উমর বিন হাকামিস সুলামি।
২- উমন বিন হাকাম বাহযি।
৩- উমর বিন সাআদ আবু কাবাসাতুন আনমার।
৪- উমর বিন সাঈদ বিন মালেক।
৫- উমর বিন সুফিয়ান বিন আব্দুল আসাদ।
৬- উমর বিন আবু সালামা বিন আব্দুল আসাদ।
৭- উমর বিন আকরামা বিন আবু জেহেল।
৮- উমর বিন আমরু আল লাইসি।
৯- উমর বিন উমাইর বিন আদি।
১০- উমর বিন উমাইর।
১১- উমর বিন আউফ নাখয়ি।
১২- উমর বিন লাহেক।
১৩- উমর বিন মালেক।
১৪- উমর বিন মাবিয়া আল গাযেরি।
১৫- উমর বিন ওহাব সাকাফি।
১৬- উমর বিন ইয়াযিদ আলকাআবি।
১৭- উমরে আসলামি।
১৮- উমরে নাজয়ি।
১৯- উমরে খাসআমি।
২০- উমরে ইয়ামানি।
২১- উমর বিন খাত্তাব। (আল এসাবা ফি তামিযি সাহাবা, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫৮৭- ৫৯৭)
হজরত উসমানের নামে নামকরণ:
১- সে যুগে অনেক জনের নাম উসমান ছিল তার অর্থ এ নয় যে, সকলেই হজরত উসমানকে পছন্দ করতো। বরং উসমান বিন মাযউন (রা.) ছিল রাসুল (সা.) এর একনিষ্ঠ একজন সাহাবি। তার মৃত্যুর পরে রাসুল (সা.) তার দেহকে চুম্বন দেন। আর উক্ত কাজটি দ্বারা স্পষ্ট যে রাসুল (সা.) তাকে অনেক বেশি পছন্দ করতেন। অনেকে উসমান বিন মাযউন (রা.)এর নামকে অনুকরণ করে নিজের সন্তানদের নাম উসমান রেখেছিল। (মাকাতেলুত তালেবিন, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৩)
২- ইবনে হাজার আসকালানি ২৬ জনের নাম উল্লেখ করেছেন যাদের নাম ছিল উসমান। তার মানে এই নয় যে, সকলেই হজরত উসমানকে পছন্দ করতেন। বরং সে যুগে আরবদের মধ্যে উসমান নামটি অতি প্রচলিত ছিল। নিন্মে উক্ত ব্যাক্তিদের নাম উল্লেখ করা হলো:
১- উসমান বিন আবু জাহম আসলামি।
২- উসমান বিন হাকিম বিন আবুল আওকাস।
৩- উসমান বিন হামিদ বিন যোহাইর বিন হারেস।
৪- উসমান বিন হানিফ বিল মোহমালা।
৫- উসমান বিন রাবি বিন আহবান।
৬- উসমান বিন রাবিয়া সাকাফি।
৭- উসমান বিন সাঈদ বিন আহমার।
৮- উসমান বিন সামাস বিন শারিদ।
৯- উসমান বিন তালহা বিন আবু তালহা।
১০- উসমান বিন আবুল আস।
১১- উসমান বিন আমের বিন আমরু।
১২- উসমান বিন আমের বিন মোঅতাব।
১৩- উসমান বিন আব্দে গানাম।
১৪- উসমান বিন উবাইদুল্লাহ বিন উসমান।
১৫- উসমান বিন উসমান বিন শারিদ।
১৬- উসমান বিন উসমান সাকাফি।
১৭- উসমান বিন আমরু বিন রাফাআ।
১৮- উসমান বিন আমরু আনসারি।
১৯- উসমান বিন আমরু বিন জামুহ।
২০- উসমান বিন কাইস বিন আবুল আস।
২১- উসমান বিন মাযউন।
২২- উসমান বিন মাআয বিন উসমান।
২৩- উসমান বিন নওফেল যাআম।
২৪- উসমান বিন ওহাব মাখযুমি।
২৫- উসমানে জাহনি।
২৬- উসমান বিন আফফান। (আল এসাবা ফি তামিযি সাহাবা, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৪৭- ৪৬৩)
উক্ত আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে,
১- একমাত্র আল্লাহ তায়ালার নাম ব্যাতিত কোন ব্যাক্তিই বলতে পারবে না উক্ত নামটি অমুক ব্যাক্তির সাথে সম্পৃক্ত। সে যুগে আরব দেশগুলোতে আবু বকর, উমর, উসমান নামটি ছিল বহুল পরিচিত। আর তাই আমরা ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই যে, রাসুল (সা.) এবং তার অনেক সাহাবিদের নামকে অনুকরণ করে সে যুগের মুসলমানগণ নিজেদের সন্তানদের নামকরণ করতো। যেমনটি ইমাম মোহাম্মাদ বাকের ও জাফর সাদিক (আ.)এর কিছু সাহাবি ছিলেন যাদের নাম ছিল আবু বকর, উমর এবং উসমান যেমন: আবু বকর খাযরামি, আবু বকর বিন আবু সাম্মাক, আবু বকর আইয়াশ, আবু বকর বিন মোহাম্মাদ।
অনুরূপভাবে ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)এর কিছু সাহাবি ছিল যাদের নাম ছিল উমর বিন আব্দুল্লাহ সাকাফি, উমর বিন কাইস, উমর বিন মেয়মার।
অনুরূপভাবে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)এর কিছু সাহাবি ছিল যাদের নাম ছিল উমর বিন আবান, উমর বিন আবান কালবি, উমর বিন আবু হাফস, উমর বিন আবু সোঅবা, উমর ইবনে আযিনা, উমর বিন বারাআ, উমর বিন হানযালা, উমর বিন সালামা।
অনুরূপভাবে ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)এর কিছু সাহাবি ছিল যাদের নাম ছিল উসমান আআমা বাসারি, উসমানে জাবাল, উসমান বিন যিয়াদ।
অনুরূপভাবে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)এর কিছু সাহাবি ছিল যাদের নাম ছিল উসমানে আসবাহানি, উসমান বিন ইয়াযিদ, উসমানে নাওয়া।
২- এতে কোন সন্দেহ নেই যে, শিয়া মুসলমানগণ ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়াকে ঘৃণা করে। কিন্তু তারপরেও দেখতে পাই যে, ইমাম (আ.)দের কিছু সাহাবি ছিলেন যাদের নাম ছিল ইয়াযিদ যেমন: ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.) এর সাহাবি ইয়াযিদ বিন হাতেম। ইমাম বাকের (আ.) এর সাহাবি ইয়াযিদে সায়েগ, ইয়াযিদে কানাসি। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এর সাহাবি ইয়াযিদে সোঅরা, ইয়াযিদ ইবনে খালিফা, ইয়াযিদ বিন খালিল, ইয়াযিদ বিন উমর বিন তালহা, ইয়াযিদ বিন ফুরকাদ, ইয়াযিদে মওলা হাকাম।
এমনকি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এর একজন সাহাবির নাম ছিল শিমর বিন ইয়াযিদ। (জামেউর রোওয়াত ওয়া ইযাহাতিল ইশতেবাহাত আনিত তারাকি ওয়াল ইসনাদ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪০২)
উক্ত নাম দ্বারা কি প্রমাণ করা সম্ভব যে ইমাম (আ.) এবং তাঁদের শিয়ারা এজিদকে পছন্দ করে? কখনই না। সুতরাং নামকরণের মাধ্যেমেই এটা প্রমাণ করা সম্ভব না হজরত আলি (আ.) বিভিন্ন ব্যাক্তিদেরকে পছন্দ করতেন তাই তাদের নাম অনুযায়ি তাঁর সন্তানদের নামকরণ করেছিলেন।
৩- যদি পিতা মাতা তাদের সন্তানদের নাম ইসলামের প্রিয় এবং বিশেষ ব্যাক্তির নাম অনুযায়ি নামকরণ করতো তাহলে সকল মুসলমানদের নাম রাসুল (সা.) এর নাম অনুযায়ি হতো। আর যদি এমনটিই হতো তাহলে কেন হজরত উমর প্রচার করে যে, কোন ব্যাক্তি রাসুল (সা.) নামে নামকরণ করতে পারবে না?
৪- শেইখ মুফিদ (রহ.)এর বর্ণনা অনুযায়ি ইমাম হাসান (আ.) এর একজন সাহাবির নাম ছিল আমরু। তাহলে কি আমরা বলতে পারবো যে তাঁর সাহাবিরা আমরু ইবনে আবদাউদ অথবা আমরু ইবনে হেশাম (আবু জাহল) এর নামের অনুকরণ করে নিজেদের নাম রেখেছিল?
৫- উক্ত আলোচনা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাচ্ছি তা হচ্ছে যে কোন এক ব্যাক্তিকে কেন্দ্র করে নামকরণ করা হয় না। বরং উক্ত নাম সমূহ ছিল আরবি দেশ ও ভাষায় প্রচলিত নাম। আর এ কারণে আরববাসিরা উক্ত নামগুলোকে নিজেদের সন্তানদের জন্য নির্বাচন করতো। সাদ্দাম হুসাইন যে হাজার হাজার মুসলমানদেরকে হত্যা করেছে। তার নামের শেষেও হুসাইন রয়েছে তাই বলে কি মুসলমানরা তাদের সন্তানদের নাম হুসাইন রাখছে না। কেউ এটা বলতে পারবে না যে, হুসাইন যেহেতু আমাদের জান্নাতের যুবকদের সর্দরের নাম সেহেতু কোন অপরাধি ব্যাক্তি নিজের নাম হুসাইন রাখতে পারবে না। আর নাম রাখলেই কেউ হুসাইনও হতে পারবে না। আর এ কারণে যদি কেউ বলে যে, হজরত আলি (আ.) রাজনৈতিক বিভিন্ন ব্যাক্তিকে ভালবাসতো বা পছন্দ করতো তাই তাদের নামের অনুকরণ করে তার সন্তানদের নাম রেখেছিলেন আবু বকর, উমর এবং উসমান, তাহলে এটা হবে একটি ভ্রান্ত চিন্তা। কেননা নাম রাখলেই ভালবাসা প্রমাণিত হয় না।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন