আমিরুল মু’মিনীন (আ.) এর দৃষ্টিতে হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)
আমিরুল মু’মিনীন (আ.) এর দৃষ্টিতে হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)
আমিরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আ.) এর নিকট হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) এর মর্যাদা ও স্থান এ বিষয়টি তাঁর (আ.) দৃষ্টিতে নারীর স্থানের বিষয়টিকে স্পষ্ট করে এবং এ বিষয়ের প্রমাণস্বরূপ যে, একজন নারী এমন সুউচ্চ স্থানে পৌঁছাতে সক্ষম যে, স্বয়ং ইমামের গর্বের কারণ হতে পারে।
যদিও আমিরুল মু’মিনীন (আ.) এর দৃষ্টিতে হযরত ফাতেমা (সা. আ.) বিষয়টি স্বতন্ত্র গবেষণা দাবীদ্বার, কিন্তু এখানে সংক্ষেপে এ বিষয় ভিত্তিক কিছু আলোচনা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে হযরত যাহরা (সা. আ.) এর সুমহান মর্যাদার বিষয়টি অধিক স্পষ্ট হয়।
হযরত আলী (আ.) এর ন্যায় মহান ব্যক্তিত্ব, হযরত ফাতেমা যাহরা (সা আ.) এর জীবনসঙ্গী হতে পেরে গর্ববোধ করেন, এ বিষয়কে অন্যের উপর তার প্রাধান্য লাভ এবং এর কারণে মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে তিনি অধিক যোগ্য ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেন। হযরত আলী (আ.) নিজের সত্যতার প্রমাণে হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) এর স্বামী হওয়ার বিষয়কে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। এ বিষয়ে কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নে উল্লেখ করা হল :
* তিনি মুয়াবিয়া’র পত্রের উত্তরে, নিজের যে সকল শ্রেষ্টত্বের কথা উল্লেখ করেছেন তম্মধ্যে একটি হচ্ছে তাঁর (আ.) হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) এর জীবনসঙ্গী হওয়ার বিষয়টি। তিনি লিখেছেন : ‘বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী আমাদের মধ্য হতে এবং হাম্মালাতাল হাতাব তথা যে দোযখের আগুনের জ্বালানী কাঠ বহন করে সে [আবু লাহাবের স্ত্রী] তোমাদের মধ্য হতে’। (১)
* দ্বিতীয় খলিফা তার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের জন্য যে ছয়জনের একটি কমিটি নির্বাচন করেছিলেন, হযরত আলী (আ.) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন : ‘তোমাদের মধ্য হতে এমন কেউ আছে কি যে, বিশ্বের নারীদের সর্দারের জীবনসঙ্গী স্বামী?’ তারা সকলেই উত্তর দিয়েছিলেন : না। (২)
* হযরত আলী আলাইহিস সালাম, মুয়াবিয়াহ’র অপর এক পত্রের উত্তরে লিখেছিলেন : ‘মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি) এর কন্যা আমার সহধর্মিনী, তার মাংস আমার রক্ত ও মাংসের সাথে মিশে গেছে। হযরত আহমাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি) এর দৌহিত্ররা হচ্ছে ফাতেমা [আলাইহাস সালাম] হতে আমার সন্তানেরা, তোমাদের মধ্যে হতে কে আমার মত এমন বৈশিষ্ঠের অধিকারী।(৩)
* সাকীফাহ’র ঘটনায় তিনি তার শ্রেষ্ঠত্বের বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ ও মহানবী (স.) এর পর মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব তার দায়িত্বে বর্তায় এ কথা উল্লেখ করে আবু বকরের উদ্দেশ্যে বলেন : ‘তোমাকে আল্লাহর শপথ দিচ্ছি! আল্লাহর রাসূল (স.) যাকে তাঁর কন্যার জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্ধারণ করেছেন এবং বলেছেন, মহান আল্লাহ তাকে তোমার [আলী] জীবসঙ্গী হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, সে কি আমি নাকি তুমি? আবু বকর বললেন : তুমি। (৪) ফাতেমা হযরত আলী (আ.) এর রুকুন
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে যে, তিনি আলী (আ.) এর উদ্দেশ্যে বলেন :
«سلام علیك یا ابا الریحانتین، فعن قلیل ذهب ركناك.»
অনুবাদ : হে দু’টি ফুলের পিতা [যায়নাব ও উম্মু কলসুম] তোমার উপর সালাম হোক, অতি শীঘ্রই তোমার দু’টি রুকুন তোমার নিকট হতে চলে যাবে’। (৫)
হযরত মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি) এর শাহাদাতের পর হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘তিনি ছিলেন আমার জন্য দু’টি রুকুনের একটি’। তিনি হযরত যাহরা (সা. আ.) এর শাহাদাতের পর বলেন : ‘সে ছিল আমার দ্বিতীয় রুকুন’
আল্লাহর আনুগত্যে সহায়তাকারী
নবীগণ (আ.) ও নিষ্পাপ ইমামগণ (আ.) মানবজাতির সৌভাগ্য ও সাফল্যতাকে শুধুমাত্র আল্লাহর আনুগত্যের মাঝে নিহীত বলে জানতেন, এ কারণেই তাদের সর্বোত্তম বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন তারাই যারা তাদেরকে এ পথে সহযোগিতা করতেন।
হযরত আলী (আ.) মহানবী (স.) প্রশ্ন করলেন : ‘তোমার সহধর্মীকে কেমন পেয়েছো? তিনি উত্তরে বললেন : মহান আল্লাহর আনুগত্য করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সহযোগী। (৬)
হযরত আলী (আ.), হযরত যাহরা (সা. আ.) এর বাক্যের শরণাপন্ন হয়েছেন
আরবায়া মেয়াহ’ (চারশত) হাদীসে হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন : মৃত ব্যক্তিদের [দাফনের জন্য] প্রস্তুত করার সময় উত্তম কথাবার্তা বল, তিনি বলেন :
হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি) এর ওফাতের পর বানী হাশিমের নারীরা হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) কে সহযোগিতা করছিলেন, তখন তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন : এ অবস্থা ত্যাগ করে এবং দোয়া ও প্রার্থনা করো’। (৭)
মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ নারী হযরত ফাতেমা যাহরা মৃত্যু পূর্বে ওসিয়ত ও কথাবার্তার সময় হযরত আলী (আ.) তাঁর উত্তরে বলেন : আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তুমি এ বিষয়ের চেয়ে অধিক জ্ঞানী, পরহেজগারী, সম্মানিত ও সত্কর্মশীল যে, তুমি নিজেকে সংযত করার জন্য আমি তোমায় ভর্ৎসনা করবো। তোমার বিরহ ও তোমার শূন্যতা আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টের, কিন্তু এ বিষয় হতে পলায়ন সম্ভব নয়। আল্লাহর কসম তুমি বিদায় নিয়ে মহানবী (স.) এর বিয়োগের ব্যাথা পূনরায় জাগিয়ে তুলেছো। নিঃসন্দেহে তোমার মুসিবত অত্যন্ত বৃহৎ যার সান্ত্বনা কোন ব্যক্তি কোন কিছুর মাধ্যমেই দিতে সক্ষম নয় এবং কোনকিছুই তার স্থান দখল করতে পারবে না।
যদিও হযরত আলী (আ.) ছিলেন একজন মাসুম ইমাম এবং তার সকল কথাই ছিল হুজ্জাত [দলীল স্বরূপ এবং যার পালন অত্যাবশ্যক] তা সত্ত্বেও তিনি নিজের কথার সাথে সাথে জন্য হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) এর বাণীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আর এ বিষয়টি হযরত সিদ্দিকায়ে তাহেরা (সা. আ.) এর ইসমাত তথা নিষ্পাপত্ব এবং তার সকল কাজকর্ম ও বাণী যে হুজ্জাত তার প্রমাণ স্বরূপ, আর এ বিষয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
ফাতেমা (সা. আ.) এর ক্রোধে মহান আল্লাহ্ ক্রোধান্বিত হন
হযরত আলী (আ.), মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহ হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন :
«انَّ اللهَ عَزَّوَجَلَّ لَیَغضِبُ لِغَضِبِ فاطِمَه وَ یَرضی لِرِضاها»
‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ ফাতেমা’র ক্রোধে ক্রোধান্বিত এবং তার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন’।(৮)
এটাই ছিল মহান আল্লাহর ইচ্ছা যে, হযরত যাহরা (সা. আ.) সকলের পূর্বে মহানবী (স.) এর সাথে মিলিত হবে। তার পরে আমার ধৈর্য ফুরিয়ে এসেছে এবং আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু আপনার মৃত্যুতে যেভাবে ধৈর্যধারণ করেছি, আপনার কন্যার মৃত্যুতেও ধৈর্যধারণ ছাড়া কোন উপায় নেই, ধৈর্যধারণ আমার জন্য খুবই কষ্টকর। তাঁর পরে আসমান ও যমীন আমার নিকট অত্যন্ত ঘৃনিত ও নোংরা হয়ে গেছে এবং আমার অন্তর হতে দুঃখ কখনই দূর হয় না। আমার চোখ নিদ্রাহীন এবং দুঃখের আগুনে আমার অন্তর দগ্ধ হয়েছে, [এ আশা রাখি যে,] মহান আল্লাহ (অতিশীঘ্রই) আমাকে আপনার নিকট অবস্থান দান করবেন। যাহরা’র মৃত্যু আমার জন্য এমনটি আঘাত স্বরূপ যা আমার অন্তরকে ক্লান্ত করেছে এবং আমার ব্যাথাকে দীর্ঘায়িত করেছে...
তিনি অন্য একটি হাদীসে হযরত ফাতেমা (সা. আ.) এর উদ্দেশ্যে বলেন :
« انَّ اللهَ لَیَغضِبُ لِغَضَبِكِ وَ یَرضی لِرِضاكِ»
‘মহান আল্লাহ্, তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট’। (৯)
নিজের চাওয়ার উপর ফাতেমা’র চাওয়াকে প্রাধান্য প্রদান
হযরত যাহরা (সা. আ.) যখন ইমাম (আ.) কে তিনি ওসিয়ত করছিলেন, তখন উভয়েই ক্রন্দন করলেন। অতঃপর ইমাম (আ.) তাঁর মাথাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে বললেন : ‘যা কিছু ওসিয়ত করতে চাও করো, নিশ্চয়ই আমি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করবো, যা কিছু নির্দেশ দেবে তা পূরণ করবো এবং তোমার নির্দেশকে নিজের মতামতের উপর প্রাধান্য দেব’। (১০)
তথ্য সূত্র :
(১) বিহারুল আনওয়ার, ৪১তম খণ্ড, পৃ. ১৫১ ও ২২৪।
(২) নাহজুল বালাগাহ।
(৩) তাবারসী, আল ইহতিজাজ (বৈরুতে প্রকাশিত, প্রকাশক : মুয়াসসাসাতুল আ’লামী লিলমাতবুয়াত, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশকাল ১৯৮৩), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৫।
(৪) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২৩।
(৫) আল্লামা হাফেজ মুহিদ্দীন তাবারী, যাখায়েরুল উকবা ফি মানাকিবি যাভিল কুরবা (দারুল মা’রেফাহ কর্তৃক বৈরুতে প্রকাশিত), পৃষ্ঠা ৫৬।
(৬) বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৪৫, পৃষ্ঠা ১১৭।
(৭) জাওয়াদী আমোলী, যান দার আয়িনেয়ে জালাল ও জামাল, পৃষ্ঠা ৪২।
(৮) কানযুল উম্মাল (মোয়াসসাসাতুর রেসালাহ বৈরুত কর্তৃক প্রকাশিত), ১২তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১১।
(৯) প্রাগুক্ত।
(১০) প্রাগুক্ত।
(১১) প্রাগুক্ত।
(মূল : নাহজুল বালাগাহ গবেষণা বিষয়ক পত্রিকা হতে গৃহীত) সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন